আমি বছরের প্রথম দিন নিয়ে মাতামাতি নিরতিশয় অপছন্দ করি || আন্তোনিও গ্রামসি

আমি বছরের প্রথম দিন নিয়ে মাতামাতি নিরতিশয় অপছন্দ করি || আন্তোনিও গ্রামসি

[আন্তোনিও গ্রামসি (১৮৯১-১৯৩৭) তাঁর প্রস্তাবিত ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্য’ (ইংরেজিতে যাকে কালচারাল হেজিমনি বলে) সংক্রান্ত বোঝাপড়া ও লেখাকরার জন্য বোধহয় অধিক পরিচিত, যতটা না ইতালীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং এককালীন সর্দার হিসেবে আগ্রহী ও উৎসাহী সুধীমহলে আলোচিত হয়ে থাকেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ফ্যাসিস্ট দণ্ডনায়ক বেনিতো মুসোলিনি তাকে গায়ের জোরে কারাবাস করাইছেন। কিন্তু, বান্দার মুখ বন্ধ করাইতে পারেন নাই। সেই সময়ে লেখা ‘প্রিজন নোটবুক্স’-এর কথা স্মরণ করি। এই কথাও জারি থাকুক যে, কবি, দার্শনিক, ভাবুক ও মহাপ্রাণ গ্রামসির স্বল্পদৈর্ঘ্য কর্মতৎপরতার দ্বারা যারা যারা প্রভাবিত হয়ে থাকবেন তাদের মধ্যে তাত্ত্বিক লুই আলথুসার, চলচ্চিত্রকার পিয়ের পাওলো পাসোলিনি এবং সমাজ-সংস্কৃতিবীক্ষক স্টুয়ার্ট হল-কে স্মরণ করা হয়ে থাকে। নামের এই ফর্দি আরো লম্বা আর কী। আর্কাইভের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, শতবর্ষী লেখাটি ১৯১৬ সনের ১ জানুয়ারি ‘আভান্তি’ পত্রিকার তুরিন থেকে প্রকাশিত সংস্করণে পয়লা প্রকাশিত হয়। গ্রামসি ‘আভান্তি’-তে সত্তো লা মোলে  (বাংলা করলে দাঁড়ায় তিলের নিচে) শিরোনামে যে কলাম লিখতেন তার আধারে আলোচ্য লেখাটি কালো হরফের আকার পায়। ছোট্ট কিন্তু টাইট এই লেখাটির তর্জমা ইংরেজি বছরের প্রথম দিনে পাঠিকা ও পাঠক আপনাদের নেক নজরের সামনে তুলে ধরা গেল। পার্সোনাল অবসরে তাফসিরের দায় আপনার। সেলাম। — ইমরান ফিরদাউস]


অদিও ইল কাপোদান্নো / আই হেইট নিউ ইয়ার্স ডে
আমি বছরের প্রথম দিন নিয়ে মাতামাতি নিরতিশয় অপছন্দ করি
মূল : আন্তোনিও গ্রামসি
ইংরেজি অনুবাদ : আলব্যার্তো তোসকানো
বাংলা তর্জমা : ইমরান ফিরদাউস


প্রতিদিন সকালে নীল আকাশের নিচে যখন আমি ঘুম ভেঙে উঠি, আমার জন্য এইটাই নতুন বছরের প্রথম দিন।

এইজন্যই আমি হ্যাপি নিউ ইয়ারের মাতামাতি নিরতিশয় অপছন্দ করি। এই-ধরনের উচ্ছ্বাস জীবনকে একটি স্থির পরিপক্বতার দিকে ধাবিত করে, জীবন ও মানব-আত্মাকে বাণিজ্যিক বোঝাপড়ার ফাঁদে ফেলে একটা ব্যাল্যান্স শিটে পরিণত করে। যেখানে লেখা থাকে কী কী পেলাম আর নতুন বছরের একই দৌড়ের জন্য কেমন বন্দোবস্ত সঞ্চয় করে রাখা গেল তা। জীবনের এই হিসাবনিকাশ-যে আমাদের প্রাণ ও আত্মার ঘটমান বর্তমানতার মধ্যে যে-ছেদ রচনা করে দিচ্ছে, সেই খেয়াল আর থাকে না। আপনে ঐকান্তিকভাবে বিশ্বাস করে নিচ্ছেন যে, গত বছর আর এই বছরের মধ্যে নিশ্চিতভাবে একটি ছেদবিন্দু বা যতিচিহ্ন বিরাজ করে থাকে। ভেবে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন যে, নতুন বছর মানে নয়া ইতিহাস লেখার দিন; সেইমতে আপনে নিত্য-নতুন ইরাদার হাত চেপে ধরেন যেন গেল বছরের ন্যায় এই বছর উঠোনজুড়ে ব্যর্থ সঙ্কল্পমালা উপহাসের ঠাট্টাতামাশায় পর্যবসিত না হয়। মানে এই চাপানউতোর তো হয়ে আসছে আজ অবধি। আর এইখানেই তারিখ নিয়ে আমাদের যত ভুলভাল বোঝাবুঝির শুরু।

তারা বলেন যে, কালানুক্রমের ধারণা ছাড়া ইতিহাসের মাজা সিধা দাঁড়ায় থাকতে পারে না। বেশ। পরন্তু, আমাদের এইটাও স্বীকার করতে হবে যে,  চার-পাঁচটা জরুরি ও দরকারি তারিখ ছাড়া আমরা অন্যতর তারিখ নিয়ে মাথা ঘামাই না। তথাপি, এইখান থেকেই ইতিহাসের ঘেরাটোপে তারিখের মামদোবাজির শুরু। এই তালিকায় নিউ ইয়ারের তারিখটাও যোগ করে রাখুন। এই নিউ ইয়ারটা কার — রোমান ইতিহাসের, নাকি মধ্যযুগের অথবা আধুনিক যুগের।

এই ধারণা এমনি আক্রমণাত্মক ও বোধিতে জীবাস্মভূত যে আমরা মাঝেমাঝে ভাবতে শুরু করি যে, ইতালিতে বোধহয় প্রাণের বিকাশের সূত্রপাত ঘটেছে ৭৫২ সন থেকে, এবং ১৪৯০ বা ১৪৯২ — এই সনগুলো অটল পর্বতসমান যার খিলান করা ছাঁদের নিচে মানবতার নিরাপদ আবাস, আকস্মিকভাবে এই ক্ষণ থেকেই যেন নতুন দুনিয়া আর নবজীবনের উত্থান। তথাপি, ‘তারিখ’ একটি প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায় যেনবা আত্মরক্ষার্থে সৈন্যবাহিনীর সম্মুখে স্থাপিত তিন পরতের প্রাচীর, যা আমাদের দেখতে দেয় না যে, ইতিহাস মানে মৌলিক ও অপরিবর্তনীয় যাত্রাপথ বরাবর উন্মোচিত হতে থাকা একটি জায়মান বাস্তবতা। এটিকে পর্দায় দেখা সিনেমা ভেবে ভ্রান্ত হবেন না, যেখানে যবনিকা পতনের পর চোখধাঁধানো আলোতে সিনেমাহল ভেসে যায়।

আর এইজন্যে আমি নিউ ইয়ার ধারণাটি ঘৃণা করি। আমি চাই প্রতিটি প্রভাত হোক আমার জন্য নতুন সালের পয়লা দিন। প্রতিদিন আমি নিজের সাথে নিজের দেনাপাওনা চুকিয়ে দিতে চাই, এবং প্রতিদিন পুনরায় নতুন করে শুরু করতে চাই। বিরাম বা আরামের জন্য কোনো দিন বা তারিখ শিকেয় তুলে রাখতে চাই না। আমার বিরতি আমি নিজেই বেছে নিতে চাই তখনি, যখন আমি বেঁচে থাকার তীব্রতায় মাতাল বোধ করি এবং জীবন থেকে নতুন প্রাণশক্তির স্ফুরণ ঘটাতে  আমি পশুত্বে ডুবে যেতে চাই।

আধ্যাত্মিকতায় কোনো সময় ব্যয় করা যাবে না। আমি চাই জীবনের প্রতিটি ঘণ্টা হোক নতুন, যদ্যপি সংযুক্ত থাকুক তাদের আত্মার সাথে যারা আজ নেই। করতে হবে, তাই করা — এমন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক আনন্দ চাই না করতে, চাই না সেই আনন্দ ভাগ করে নিতে সেইসব অপরিচিতদের সাথে যারা আমার কেউ নয়। আমার বাপ-দাদা, তাদের মা-নানী এই আনন্দফূর্তি করে গেছে বলে আমাকেও করতে হবে — এমনতর ভাবনাই একটি বিবমিষাকর পরিস্থিতি।

আর এ-কারণেই আমি প্রতীক্ষায় থাকি সমাজতন্ত্রের। কেননা, এইটাই পারবে ওইসব তারিখগুলোকে আবর্জনায় ছুঁড়ে ফেলতে যেগুলোর সাথে আমাদের অন্তরাত্মার কোনো সংযোগ নেই। যদিও অন্য তারিখগুলো নতুনতর সম্পর্ক রচনা করে, অন্তত সেগুলো আমাদের হবে। যেখানে থাকবে না পূর্বপুরুষের কাঁধ থেকে পাওয়া জিন্দালাশের খাটিয়ায় কান্ধা দেয়ার বেদরকারি ঈমানি দায়।

সিডনি / ৩ জানুয়ারি ২০২২ / সারাদিন সোমবার

দোহাই
লেখাটির সন্ধান আমি পাই লেখক ও অনুবাদক শফিউল জয়ের ইন্সটাগ্রাম স্টোরি থেকে ২০২২ সনের জানুয়ারি মাসের এক তারিখে। ইংরেজি অনুবাদটি এইখান থেকে পড়তে পারেন : https://viewpointmag.com/2015/01/01/i-hate-new-years-day/

ইফি

ইমরান ফিরদাউস রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you