ইচ্ছেশ্রাবণ ৪ || বিধান সাহা

ইচ্ছেশ্রাবণ ৪ || বিধান সাহা

কোকিল ডাকছে। নিচে গাড়ি চলছে হুশহুশ করে। জানালার পাশে বসে লিখছি যখন, একটা মৃদু হাওয়া এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে। পাশের বিল্ডিঙের ছাদে চমৎকার কিছু নয়নতারা ফুল ফুটেছে কয়েকদিন হলো। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক, শ্মশ্রুমণ্ডিত, সকালে দেখলাম তাদের পরিচর্যায় ব্যস্ত।

প্রাণায়াম শেষ করে চোখ মেলতেই দেখি একজোড়া চড়ুইদম্পতি ছাদের কার্নিশে এসে বসেছে। এদিক-সেদিক কিচিরমিচির করতে করতে ফুস করে উড়ে গেল। কোথায় উড়ে যায় ওরা? ওদেরও কি সমস্ত দিনের কাজের হিসেব করতে হয়? সমস্ত দিন রুটিনে রুটিনে ভাগ হয়ে আছে?

ছাদের উপর একটা ড্রাম কেটে তাতে একটা পেয়ারা গাছ লাগানো। সেই পেয়ারা গাছের একটা ডালের শীর্ষদিকে একটা কচি সবুজ পাতা। তার উপর সূর্যের আলো পড়ে আরো সবুজ দেখাচ্ছে। আলোর ধর্ম কি তবে এই, যেখানে সে পড়বে সেটাকেই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তুলবে? আমার এখন ওই সবুজ পাতাটি হয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে। কেমন আলতো বেঁধে আছে ডালটার সঙ্গে। সমস্তদিন, সমস্তরাত ওই ডালটাই তার আশ্রয়। দিনের বেলা সূর্যের আলোয় সে উদ্ভাসিত হবে। রাতের বেলা চাঁদের কিরণে সে সিক্ত হবে। প্রজাপতি, ফড়িং — কত কত পতঙ্গ এসে তার উপর ভর করবে। আর এসবের কিছুই যখন হবে না, তখন এই পাতাগুলো উজ্জ্বল পরীর মতো ডানা মেলে দেবে আকাশের দিকে। সবুজ পরী হয়ে ঘুরে বেড়াবো নগরের প্রতিটি ছাদ থেকে ছাদে।

পাতাটি আত্মমগ্ন হয়ে আটকে আছে ডালে। তার সবুজ রং নিরাসক্তভাবে ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীতে। পাতাটির নিজস্ব পৃথিবীর রঙ কী, তার মৃত্যুশোক কেমন, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে।

যেখানে বসে আছি সেই জানালা দিয়ে ওপারের রাস্তার গাছগুলোর একাংশ দেখা যায়। সোনালু, রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, গগনশিরিষ … ঝেঁপে ফুল এসেছে। রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়াই বেশি। ওই ওই হলুদ মঞ্জরীর ভেতর থেকেই কোকিলের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। কুউউ… কুউউ… কুউউ… যেন আজন্ম সন্ধান করে চলেছে সে। হাহাকারে ভরা আর্তরব। যেন হারিয়ে গেছে তার গোপন মণিহার। সহস্র কুঠুরি ও কোণঠাসা ভেদ করে এই রব ছড়িয়ে পড়ছে ভ্রান্তি ও ভূগোলে।

আকাশটা আজ কী যে দারুণ স্বচ্ছ! রুলে টানা মেঘের মতো সাদা সাদা মেঘ। তার উপরেই অবাধ নীল। যেন কেউ সাদা মেঘের সাথে নীল আকাশটাকে তেলরঙের মতো ঘষে ঘষে মিলিয়ে দিয়েছে। একটু আগেই একটা হেলিকাপ্টার উড়ে গেল ওই নীলসাদার উপর দিয়ে। একঝাঁক নাম-না-জানা পাখি উড়ে যাচ্ছে এই মুহূর্তে। — ও পাখি ও পাখি, কোথায় যাচ্ছিস পাখি রে?

নিচ থেকে ঝুনঝুন করে একটা ছুটে-যাওয়া শব্দ ভেসে এল। বেশ বুঝতে পারছি মোটরচালিত রিকশা যাচ্ছে। এই করোনার কালে ইদানীং পাখির ডাকগুলো, রিকশার শব্দ, শালিখ পাখির ডাক, বাতাসে পাতার ওড়াউড়ি সব স্পষ্ট শোনা যায়। ঢাকা শহরের এই ইটকাঠের খাঁচায় এই শব্দগুলো মানুষ কতদিন আগে এমন স্পষ্ট শুনেছিল আমার জানা নেই।

গাড়ি চলছে না। হর্ন নেই। হেল্পারের চিৎকার চেঁচামেচি নেই। যেন কোনো বিদেশ! বন্ধুদের কাছে শুনেছি বিদেশে গেলে দেশের জন্য মন কেমন করে! আমার এখন খুবই মন কেমন করছে। আমি কি তবে বিদেশ আছি?

খুবই মনে পড়ছে একবার একটা ছবিটা তুলেছিলাম টাঙ্গাইলের ভূয়াপুর টু এলেঙ্গার মধ্যবর্তী কোনো-এক জায়গা থেকে। সিএনজির ভেতর থেকে। যেখানে গরম-পাগলার মাজার।

একটা স্নিগ্ধ দুপুর, অবিরাম সবুজ, মানুষের কোলাহলহীন — কেবল সিএনজির ওই ছিচ্‌কাঁদুনে শব্দ ছাড়া তেমন কিছুই যখন আর কানে আসে না। তখন।

অনেকগুলো ছবি তুলেছিলাম। পরে সেগুলো পিসিতে নামানোর সময় একটা একটা করে দেখিয়েছিলাম তাকে। প্রাজ্ঞ ব্যক্তির মতো ভ্রু কুঁচকে বলেছিল, ‘ভালো… তবে…’।

এর পরে আমি তারও কিছু ছবি তুলেছিলাম জুলাইয়ের পনেরো তারিখ। সেদিন আমরা নিরুদ্দেশে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম প্রকৃত অর্থে। আমরা নিরুদ্দেশের খোঁজে বের হয়েছিলাম।

সেদিন আকাশ ছিল মেঘলা। বাতাস ছিল প্রেমময়। সেই বাতাসে ওর শ্যাম্পুকরা চুলগুলো উড়ে এসে যখন আমার মুখকে ঢেকে দিচ্ছিল — আমি দেখছিলাম বাতাসের সাথে মিশে যাচ্ছে দুজন মানুষের শিশুতোষ উচ্ছ্বাস। যেন জন্মের পরে প্রথম পৃথিবী ভ্রমণে বের হওয়া দুটো শিশু। যেন কোথাও কোনো সুতরাং নেই আজ আর। যেন পৃথিবী তার সমস্ত ক্রূরতা নিয়ে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছে।

আমরা সুবিল পার হয়ে গিয়েছিলাম আরো আরো পূর্বদিকে। ওইদিকে। ওই ওই ও-ই দিকে! যেখানে গভীর শালবন, সূর্যের আলো ঘননীল হয়ে পড়ে আর গোলেমনবিবির ভিটা থেকে কোনো কোনো মেঘলা দুপুরে কান্নার শব্দ ভেসে আসে।

লোকে বলে, ওইদিকে যারা যায় তারা কেউই আর স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসে না। যা আসে সবই তাদের ছদ্মবেশ।

প্রচ্ছদ : অসীম দাস

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you