পাথরে লিখো নাম …পাথর ক্ষয়ে যাবে
বুলেটে লিখো নাম … রক্তে ধুয়ে যাবে
বুলেটে লিখো নাম … কার্তুজখোসা পড়ে র’বে
দেয়ালে লিখো নাম … নগর-পুরসভা এসে মুছে দিয়ে যাবে।
দেয়াল এক নাগরিক প্রাকার, পৌরাণিক পাহাড়ের কাল্পনিক আকার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দুই বা ততোধিক দালানের মাঝে, আম-পাবলিক আর ক্ষমতার মাঝখানে, গতকাল আর সমকালের মধ্যেখানে। দেয়ালের চারা প্রকৃতিতে আপনা থেকে রোপিত হয়ে থাকবে আদিমকাল থেকেই, পরে সেই দেয়াল ছড়িয়ে গেল ঠাকুরের সংগীতের মতো সবখানে। যেমন কী … হালের অন্তর্জালিক সামাজিক যোগাযোগীয় মাধ্যমের সংস্কৃতিতেও দেয়াল হাজির, তার গতরে অক্ষরের মালা, ছবি দিয়ে ইতিহাস লেখার পটভূমি হিসেবে।
প্রাগৈতিহাসিক মানুষ থেকে আজকের শিশু — সবার কাছেই দেয়াল মনের কথার এক উদাম মাঠ। তাই, যুদ্ধ-বিগ্রহ, সভ্য-অসভ্য, দাস-ক্যাপিটাল, প্রভু-ধান্দাবাজ, বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগের সাতসমুদ্র তেরো হাঙ্গরনদীগ্রেনেড পার করে জরাবিধ্বস্ত মানুষ যখন নিজেকে নব্য বাস্তবতায় রাজনৈতিক প্রাণীরূপে ঠাহর করে নিতে পারল; আরও পারল ক্ষমতার ভালোবাসায় মত্ত শাসক-শোষক গোষ্ঠীকে চিনে নিতে … সেদিন দেখতে পেল ঢাউস ঢাউস সংবিধানবহিতে আহত-নিহত আত্মার রক্ত দিয়ে, মানুষকে নিয়ে অনেক মিঠা কথা লেখা হলেও, মানুষের পক্ষের কথা, মানুষের জন্যে কথা লিখা হয়েছে সামান্যই। পরন্তু, মানুষ তো জেনে গেছে সে রাজনৈতিক প্রাণ, তার আছেগলা চড়াবার দেমাগ, টুঁটি চেপে ধরলে উন্মাদ আস্ফালনের স্পর্ধা আর কপাল খারাপের রাতে ঠিক গুম হয়ে যাওয়ার আগে দেয়ালকে চিরকুট বানিয়ে, ভয়শূন্য চিত্তে যুতের কথা লিখে রেখে যাওয়ার শক্তি।
তো এই মর্মে, আজকের বাংলাদেশে দেওয়ালে পোস্টার লাগানো/লেখা নিষেধের আদেশমূলক সতর্কবাণীর কালে দেয়াল যখন শুধুমাত্রই ক্ষমতার গদিনসীনের দেশ এগিয়ে চলছে মূলক সংখ্যাতাত্ত্বিক মিঠে কথার কলেবর, তখন সেখানে জনমনের রোষ, ক্ষোভ, চাওয়া-না-পাওয়ার বাক্য ফুটে উঠতে দেখা যায় না। যদিও, পরিস্থিতিটা মানে দেয়াললিখন চর্চার হালতটা এমন ছিল না দেশভাগপরবর্তী পূর্ব-বাঙলায় এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে।
রাজনৈতিক ডামাডোল ও রাজনীতিসচেতন ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০-এর সময়কাল এবং স্বাধীন বাংলাদেশের নগর-বন্দর-গ্রামজনপদে দেয়ালে দেয়ালে রটিয়ে দেয়া হতো মজলুমের কথা, জালিমের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারের আর মুক্তির স্লোগান। যেমন মনে করা যাক, ভাষাআন্দোলেনের রব উঠার অব্যবহিত ক্ষণ থেকে দেশের দেয়ালে দেয়ালে ‘রাষ্ট্রভাষা বাঙলা চাই’ স্লোগানটি অষ্টপ্রহর ফুটে থেকেছে আত্মপরিচয়ের চিহ্নরূপে। আরও, দেখা যেত ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।’ একই সময়ে স্লোগান থেকে দেয়ালের বুকে ঠাঁই করে নেয় ‘জয় বাঙলা’ বা আপামর জনতার স্বায়ত্তশাসনের প্রতীক। রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে গোটাগোটা বোকাবোকা অক্ষরগুলোর মৃতদেহে নতুন দিনের আছর পড়ে, বধির দেয়াল ভাষা খুঁজে পায়। এ-সময়ের আরেকটি চেতনায় শাণ দেয়া স্লোগান দেয়াললিখনে জায়গা করে নেয়, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ আরও ছিল ‘তুমি কে, আমি কে, বাঙালি, বাঙালি।’ এক্ষণ, লক্ষ করা যাক এসব দেয়াললিখনে কথামালা বারংবার ব্যবহার করা হলেও চিত্রসম্বলিত প্রথম দেয়াললিখন উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসানের হাতধরে — ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে।’ বলা বাহুল্য, এসব স্লোগান, দেয়াললিখন তৎকালে জনমত গঠনে ও জুলুমবাজ-অন্যায় পরিস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধে সক্রিয় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।
অসংকোচ, ঠোঁটকাটা দেয়াললিখনের এ-প্রবাহ জারি থাকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও। ১৯৭০, ১৯৮০, ১৯৯০-র দশক জুড়ে গণপ্রজাতন্ত্র, একদল, সামরিক শাসন, স্বৈরাচার, বহুদলীয় গণতন্ত্র — সকল অবস্থাতেই দেয়াললিখন আওয়াজ দিয়ে গেছে অবদমিত শাসনবাস্তবতার বিরুদ্ধে হক –কথার সংস্কৃতিকে। এই ভাগে ভরপুর অঞ্জর বেদনা-ভারাতুর বিহ্বল বাংলাদেশে রাজনীতি বা অধিকার নিয়ে জবান চালানোর পরিসর সীমিত হয়ে পড়ে। তারপরও শহর ঢাকার এ-দেয়ালে সে-দেয়ালে দেখা যেত ‘বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস’, ‘মার্কিন দালাল হুঁশিয়ার’। রানের চিপায় আটকে-পড়া গণতন্ত্রকে উদ্ধার করতে যখন বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা-কর্মজীবী-শ্রমজীবী মানুষ পথে নামে, তখন সেই যাত্রায় সামরিক শাসনের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দেয় ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগানটি, এটি দেয়াললিখনের বিস্মৃত ইতিহাসে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৯০/২০০০ সন অবধি দেয়াললিখনের সাথে রাজনৈতিক বার্তা, রাজনৈতিক কর্মসূচি, আঁকিয়ে/লিখিয়েদের মাঝে রাজনৈতিক কর্মীদের অংশগ্রহণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় ঘটে থেকেছে। অর্থাৎ, দেশের দশের অধিকার, দাবিদাওয়া, ইনসাফের প্রশ্নে রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক সঙ্ঘ সমাজের কণ্ঠস্বর হিসেবে ভূমিকা রক্ষার চেষ্টায় রত ছিল। এরপর মানে নব্বইয়ের পর দেয়াললিখা/আঁকার সবচেয়ে বড় দেয়াল বার্লিন-ওয়ালের পতন ঘটে, স্নায়ুযুদ্ধের বরফ-গলা নদীতে ভাসতে দেখা যায় অনেক অবসরপ্রাপ্ত বামদের। আন্তর্জাতিক দুনিয়া হয়ে ওঠে বৈশ্বিক পৃথিবী, ব্যক্তিমানুষ সরকারের ছায়াবীথিতলে পাঠ নিতে শুরু করে নব্য-উদারনৈতিক বাস্তবতার, যেখানে রাষ্ট্রের কামাই সরকারের, ব্যক্তির টাকাও সরকারের।
হঠাৎ করেই, তখন দেশবাঙলায়, শহরঢাকায় নিঃসন্তান একক বা দম্পতির সংখ্যা বেড়ে যায়, তবে আশার কথা হলো তারা কেউই যৌনবাহিত কারণে নিঃসন্তান নয়। এরা নিঃসন্ততির মতো দুখী কারণ তদের কোনো অ্যাচিভমেন্ট নাই, জিপিএ-ফাইভ নাই, মিথ্যা বড়লোকি নাই, আদেখলেপনা নিয়ে আহ্লাদি করার মতো কোনো সুযোগ নেই। আর এইসবের চক্করে মেট্রোসেক্সুয়াল বনে যাবার তাড়াহুড়ায় ভুলে বসেছে মানবিক বোধের মতো সুকুমার বৃত্তিগুলো।
ঠিক এই সময়ে বাঙলার বুকে ঢাকার সিনায় সিনায় টানাটানা হাতের লেখায় ভাস্বর হয়ে ওঠেএকজন অজ্ঞাতনামা লেখক। পশ্চিমা পথশিল্পসংস্কৃতির ভাষায় যাকে বলা হয় ট্যাগিং অর্থাৎ যিনি একটা লাইন লিখে রেখে চলে যান। আর এই নাম-না-জানা মাস্তান অনবরত লিখে গেল ‘কষ্টে আছে আইজুদ্দিন’, সেঁটে দিয়ে গেল বেদনার সিলমোহর। কিন্তু, মানুষ ততদিনে তাদের আত্মা বিক্রি করে দিয়ে ব্যাংককে হলিডেট্যুর কিনতে শিখে ফেলেছে তাই এই নগরের পয়লা গ্রাফিতিশিল্পীরে আমাদের কবুল করা হয়ে ওঠে না। বলে রাখা ভালো, গ্রাফিতি মানে প্রতিসংস্কৃতির কালি-কলম। নন-কনফর্মিস্ট বা প্রচলবিরোধী জীবনযাপনপদ্ধতি। সময়ের মতি-গতিকে পরিহাস করা একেকটা গ্রাফিতি যেন শহরের শরীরে খোদাই-করা একেকেটা ট্যাটু। সবাই সবার মতো হতে চাওয়া ও নিজের গল্পটাই ইউনিক এমনতর বেকুব অনুভূতি নিয়ে হাইব্রিড সারে বেড়ে উঠার কালে, আমাদের সময় থাকে না গুম, হত্যা, লুটপাট, সড়ক দুর্ঘটনা, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি নিয়ে মাথা ঘামানোর। কেননা, আমরা বেচে দিছি আত্মা, কিনে নিছি সরকারি হত্যা। এমন মনোলিথিক সময়ে ঠিকই প্রতিবাদের হাতিয়ার নিয়ে হাজির হয় গ্রাফিতিশিল্পীরা। সে বা তারা স্টেন্সিলে আঁকে/লেখে ‘আই অ্যাম অভিজিৎ, কিল মি’, শান্ত বুদ্ধ নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে লিখে লিখে বলে ‘লেট মি ডাই’ বা ধর্ষণ-নিপীড়ন-যৌনসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দেয়ালে দেয়ালে এ-শহরে ভেসে ওঠে বল্লম-হাতে-আগুয়ান নারীর প্রতিকৃতি যেথায় লিখা থাকে ‘হিট ব্যাক’। এই গ্রাফিতিগুলো এই শহরের দেয়ালে ফুটে থেকেছে, চাপা পড়ে গেছে পোস্টারে বা দলীয় উন্নয়নের গুণকীর্তনে। নিউজফিড স্ক্রলিঙের ক্ষণস্থায়ী স্মৃতিশক্তি নিয়ে আমরা অপেক্ষায় থাকি ভাইরাল হবার মুহূর্তের সাক্ষী হবার জন্য। তথাপি, ভাইরাল হলেই কী পথে-আঁকা কোনো দৃশ্যপট যৌক্তিক হয়ে ওঠে কি না বা স্পষ্ট করে বললে তা গ্রাফিতি হয়ে উঠবে কি না সে-প্রশ্ন তোলার ঈমানী দায় বাংলাদেশের শিল্প ও বিদ্বৎসমাজ এড়িয়ে যায় যেন কাশফুলের নরম ছোঁয়ার মমতায়।
ধরা যাক, সুবোধ ধারার পথচিত্রের কথা। এখানে গ্রাফিতির বয়নবিন্যাস অনুসরণ করে পথচিত্রটি করা হয়েছে — এটি উন্মুক্ত স্থানে, অ্যানোইনিমাস শিল্পীর দ্বারা, জনপরিসরে, দ্ব্যর্থবোধক শব্দচয়ন এবং শেষাবধি একটি কনফর্মিস্ট আলাপ। এবং এটি ভাইরালের মর্যাদাও পেল। আমরা নাগরিক আহ্লাদে আটখানা হলাম, ভাবলাম পেয়ে গেছি বুঝি বাঙলার শেষ বিবেক। দুঃখজনক হলেও সত্যি, গ্রাফিতির প্রতিভাস দিয়ে গড়া বস্তু গ্রাফিতির মতো দেখতে বলেই তাকে গ্রাফিতি বলা চলে না। আর, এই বলা বা কওয়ার ভেতর দিয়ে বরং আরও প্রকটিত হয় নগরবাসীর অন্তঃসারশূন্যতা। প্রমাণিত হয় কত সহজেই তাদের ছেলে-ভুলানো প্রপাগান্ডায় ভুলানো যায়। কেননা, এই তথাকথিত গ্রাফিতি সমস্যার মূলকে প্রশ্ন করে না, বলে না কেন পালাব বা পালাব কোথায় — গ্রামগুলো তো মুছে ফেলেছি স্থায়ী ঠিকানার ঘর থেকে। যে হানা দিলো নির্বিবাদী জীবনে তাকে জায়গাজমিন দিয়ে আমি কেন পালাব? বরং, এই দেয়ালে-আঁকা চিত্র বুঝিয়ে দিলো আমরা এখন অনেক চৌকস নিয়োলিবারেল মেশিনে উত্তীর্ণ হতে পেরেছি, যে-মেশিন জানে কীভাবে পলায়নবাদী হতে হয় শিল্পের মেকী দোহাই দিয়ে। হালে রাজনৈতিক শুদ্ধতা ও রাজনৈতিক যথাযথতা চর্চার কালে মানুষ ভুলে যাচ্ছে অবলীলায় — হারানোর কিছুই নেই শৃঙ্খল ছাড়া।
ইদানীং বৈশ্বিক সংস্কৃতির পিঠে চেপে চালু অনেক শব্দ মানুষ আমরা পকেটে পুরতে শিখেছি বিনা দোহাইয়ে; বিনা তালাশে যা পকেটে ভরছি তা আমার ঘরেই আছে বা ছিল কি না তার খোঁজ ব্যতিরেকে। তাই নিছক পথচিত্র ভাইরালের সুবাসে মত্ত জমানায় বলতে হয় বাংলাদেশের জন্মপূর্বাপর সময় থেকেই এ-অঞ্চলের দেয়ালের কান আছে, মুখ আছে। আছে অবদমিত শাসনব্যবস্থার গালে ঝামা ঘষে দেয়ার ঐতিহ্য, আছে ইনসাফের স্লোগান তোলার সিলসিলা। বিজয় দিবসের প্রভাতে তাই উষ্ণ করমর্দন তোলা থাকুক অজ্ঞাতকুলশীল সেইসব গ্রাফিতি আঁকিয়ে/লিখিয়েদের প্রতি যারা ধারণ করে যৌবনের ভাষা, রচনা করে শ্লেষের পঙক্তিমালা। সিস্টেমের শ্যেন নজর উপেক্ষা করেছড়িয়ে দিচ্ছে, দিবে নিঃশব্দ স্লোগানের অস্থিরতা।
লেখার সঙ্গে সাঁটা ঢাকার পথচিত্র ও দেয়াললিখনগুলার ফটোগ্রাফসমূহ লেখকের সাইট সিনেমাকিচেন থেকে সংগ্রহ করা
*লেখক : চলচ্চিত্রনির্মাতা, সংস্কৃতিবীক্ষক ও কলাসমালোচক। ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনিতে ফিল্মস্টাডিজে পিএইচডি করছেন।
- পলিটিক্স অফ বেঙ্গল : দৃশ্যবাস্তবতার রাজনীতিতে কিছু গরহাজির আত্মা || অরিজিন্যাল : জেমস লিহি / অনুভাষ্য ও অনুবাদ : ইমরান ফিরদাউস - November 22, 2024
- চেতনার ভিত নাড়িয়ে দেয়া চলচ্চিত্র || ইমরান ফিরদাউস - September 29, 2024
- সুমন মুখোপাধ্যায় : এক মেইকার || ইমরান ফিরদাউস - September 25, 2024
COMMENTS