উপন্যাসের খোঁজে, ব্যক্তিগত

উপন্যাসের খোঁজে, ব্যক্তিগত

ফেবুপত্রিকায় এই মিটিমিটি এন্ট্রিগুলা আরেকটু অন্যভাবে লিখে যাওয়া যায় কি না ভাবতেসিলাম। অনেকদিন ধরেই একটা আইডিয়া মাথায় খেলতেসে, এরে একবার বাইরে এনে নেড়েচেড়ে দেখা দরকার এবার। সময় বেশি নাই আর, খেলা ফুরাবার, কাজের কাজ কিসুই হবে না তা আদ্যোপান্ত জানা, তাই অন্তত ভাবনাটা রেখে যাওয়া যাক। বহুকাল বাদে একদিন হয়তো আমার নাতনি এসে এই এন্ট্রি দেখে সোল্লাস সচিৎকার বলে উঠবে : ইউরেকা!… তা, ভাবতেসি একটা চরিত্র খাড়া করাব, একটা অবিরাম অব্জার্ভার, যে-কিনা বিভিন্নকৌণিক দূরত্ব থেকে কেবলই দেখে যাবে, একনাগাড়ে দেখে যাওয়া শুধু, অবিরল অনবচ্ছিন্ন দেখা, ডান থেকে বাম থেকে সামনা থেকে পেছন থেকে পাশ থেকে তলা থেকে আগা থেকে গোড়া থেকে পাহাড় থেকে সমতল থেকে খাড়াই থেকে ঢালু থেকে শাখা থেকে শেকড় থেকে সন্ধ্যা থেকে সকাল থেকে শ্যাওড়াগাছের মগডাল থেকে একাকী বিরামহীন দেখে যাবে শুধু, চোখ খুলে চোখ বুজে চোখ উঁচিয়ে চোখ রাঙিয়ে চোখ বসিয়ে চোখ চষিয়ে চোখ ড্যাবড্যাবিয়ে চোখ পিটপিটিয়ে চোখ মিরমিরিয়ে চাক্ষুষ করে যাবে, থেকে-থেকে থেমে-থেমে চেখে-চেখে হেঁটে-হেঁটে দৌড়ে-দৌড়ে নেচে-নেচে নেড়ে-নেড়ে ঘেঁটে-ঘেঁটে দেখে যাবে, নেত্র-প্রসারিত নেত্র-নিমীলিত নেত্র-বিস্ফারিত নেত্র-অবনত পরখি নিরখিয়া যাবে সবকিসু, রসিয়ে-রসিয়ে দেখবে, তারিয়ে-তারিয়ে দেখবে, জিরিয়ে-জিরিয়ে দেখবে, ভাঁড়িয়ে-ভাঁড়িয়ে দেখবে, বিষাদ-প্রেম-দ্রোহ ও যন্ত্রণার আতশকাচের তলায় রেখে দেখে ফিরবে যে-জীবন ফড়িঙের…যে-জীবন দোয়েলের…যে-জীবন রক্তগ্রন্থির…যে-জীবন জন্তুর মতো অসহায় মানুষের…। কেবল-যে সে দেখে যাবে মাকালের মতো, ঠুঁটো জগন্নাথের মতো দরশিয়া যাবে শুধু, তা-ও নয়;— তরকারিতে ফোড়ন দেয়ার মতো মাঝেমধ্যে খুটখাট মন্তব্য যোগ করবে, দৃশ্যের অন্তরাল থেকে তুলে আনবে মাঝেমধ্যে অদৃশ্য জগৎ, অথবা কখনো রচনা করবে দৃশ্যমান আকাশকুসুম, মোদ্দা কথায় মজা করবে— মজা, আর কিসু না — চাদ্দিকের চুতিয়ামি নিয়া চান্দিছোলা বান্দ্রামি করে বেড়াবে খালি। মহৎ কোনো সুষমামণ্ডিত সাহিত্য প্রণয়নের রঙবাহার থাকবে না তার, আমাদের সেই চরিত্রের, অবিরাম সেই অব্জার্ভারের, থাকবে না খাউজানিমূলক সিরিয়াসনেস অথবা মাধ্যাকর্ষণভিত্তিক মধ্যবিত্তীয় নৈতিকতা, আবার নৃপতি কৃষ্ণচন্দ্রের দরবারি বিদূষক মহান গোপালভাঁড় হবার চান্সও অতীব অল্প। অল্পকথায় সে হবে সুকুমার-শিব্রাম-ত্রৈলোক্য আর ওয়াল্ট ডিজনির খানিকটা আদল ধরে, চ্যাপ্লিন নয় কিন্তু! অত সমাজচেতনা, শিল্পায়নবেদনা, আরূঢ় সহিসের অশ্বান্বেষণা থাকবে না। থাকবে এই তিনের সমাহার : শিব্রাম, ত্রৈলোক্য ও সুকুমার। অথবা এইটা, আমাদের রচিতব্য উপন্যাস, হবে এই ফেবুপত্রভুক্তিরই ভিন্নতর একটা ধাঁচ। নোটকের নবকল্পিত নৃত্য। হয়তো অল্প আরেকটু বোল্ড, বলিষ্ঠ একটা বয়ান, অধিকতর তৎপর ও অতিশয় লিপ্ত। অথবা অতৎপর, অবলিষ্ঠ, অসরাসরি নির্লিপ্ত। মোটমাট, উক্ত উপন্যাসপ্ল্যানের নেপথ্যে একটা কারণ এ-ই যে, নিজে উপস্থিত থেকে নিজের জবানিতে সবকিসু বলা যায় না, বলতে কেমন বাধো-বাধো ঠেকে। আমিত্বের আহুমউহুমে, আমতা-আমতা করতে করতে, কেটে যায় বেলা, আর বলবার ছিল যা-যা তা কিসুই বলা হয়ে ওঠে না শেষাবধি। এদিক থেকে প্ল্যানাধীন ফর্ম্যাটে ফেলে একটা সাধুগিরিহীন অমহৎ খাড়া-ডাকাইত চরিত্র দাঁড় করাইতে পারলেই কেল্লা হাসিল। চরিত্রস্কন্ধে চেপে তখন, সার্ভেন্তেসের কোহিতো নামের টিঙটিঙে সেই দনের মতো, স্বভুবনে বিহার করা যাবে বেশ, স্বাধীনতা ভোগ করা যাবে বেশমাত্রায় বেশি। কিন্তু উপন্যাসের শিল্পরূপ লঙ্ঘিত হবে না তাতে? সেসবের আমি কী জানি— ইএম ফর্স্টার বা রণেশ দাশগুপ্ত বা মিলান কুন্দেরারে গিয়া জিগান। তবে, একটা কথা, আমি লিখব উপন্যাস— এই ডিক্লারেশন শুনে কে কে অবজ্ঞাহাসি আর কে কে সপ্রশ্রয় মুচকিহাস্য করতেসেন, তা দেখেই কিন্তু দুইসহস্রত্রয়োদশ হালের অস্তি-নাস্তি বিতর্কের একটা হেস্তনেস্ত করা যায়। হ্যাঁ, এইবার সমবেত হাসাহাসি হতে পারে, ব্যাকগ্রাউন্ডে ক্ল্যারিনেট অবশ্যই।

জাহেদ আহমদ / ২১ এপ্রিল ২০১৩

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you