পূর্বধলা সরকারি কলেজের পাশেই রাজধলা বিল। বলা উচিত, বিশাল রাজধলা বিলের এক পাড়ের কিয়দাংশে পূর্বধলা কলেজ। বিলের চারপাশে কৈবর্তদের আবাস। এই আবাস থেকেই কৈবর্তরা ছোট ছোট দলে দলে মাছ ধরছে বিলে। সেই মাছ নিয়ে আসছে ঘাটে। খুবই নান্দনিক সেই ঘাট। ঘাটের সৌন্দর্য এবং বিলের বিশালত্ব দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে আসছেন পর্যটকবৃন্দ। সেই পরিতৃপ্ত উৎসুক দর্শনার্থীদের জন্যই বিলপাড়ে গড়ে উঠেছে কফিশপ। সেই কফিশপে বসেই কথা হচ্ছিল ইতিহাসবিদ, লেখক, গবেষক আলী আহম্মদ খান আইয়োবের সঙ্গে। হাওরাঞ্চলের এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভৌগোলিক সীমায়তন, ভাষা, সংস্কৃতি, লোকাচার ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় তিনি পথিকৃৎ। তিনি এমন বিষয়ে গবেষণা করেছেন এবং লিখেছেন — যে-বিষয়ে ইতোপূর্বে কেউ গ্রন্থের অবতারণা করেননি।
‘প্রান্তিক নৃগোষ্ঠীর বিদ্রোহ’, ‘গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ : নেত্রকোনা জেলা’, ‘বাংলাদেশের হাজং সম্প্রদায়’, ‘গারো সম্প্রদায়ের ধর্মচিন্তা’, ‘ময়মনসিংহের সাময়িকী ও সংবাদপত্র’, ‘ডালু হদি ও বানাই সম্প্রদায়ের সমাজ ও সংস্কৃতি’, ‘কোচ সম্প্রদায় : সমাজ ও সংস্কৃতি’, ‘নেত্রকোনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’, ‘ময়মনসিংহে রবীন্দ্রনাথ’, ‘নেত্রকোনা জেলার ইতিহাস’ প্রভৃতি আলী আহম্মদ খান আইয়োবের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
সাক্ষাৎকারের প্রশ্নগুলো ঘন কালির হরফে এম্বোল্ডেন এবং আলী আহম্মদ খান আইয়োবের কথাগুলো পাৎলা কালির হরফে স্বাভাবিক রাখা হয়েছে। রেকর্ড-করা আলাপ অনুসরণপূর্বক শ্রুতিলিখনের শ্রমসাধ্য ও মনোনিবিষ্ট কাজে সহযোগিতা করেছেন সানজিদা হেলেন ছুটি ও মোতাসিম বিল্লাহ। অনুলিখন-সহযোগী উভয়ের প্রতি ঋণস্বীকার কর্তব্য। সাক্ষাৎকারদানে সম্মত হয়েছেন ও সময় দিয়েছেন বলে জনপদ ও জনজাতির ইতিহাস গ্রন্থনাকারী আলী আহম্মদ খান আইয়োবের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার অন্ত নাই।
সাক্ষাৎকার সংঘটিত হয় ২০২৩ মার্চ/এপ্রিল নাগাদ। — সরোজ মোস্তফা
বহুদিন ধরে ভাষা, সংস্কৃতি, লোকাচার, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করে চলেছেন। লিখেছেন কত কত বই। এই জনপদে থেকে বহু চ্যালেঞ্জ নিশ্চয়ই অতিক্রম করতে হয়েছে। সেসব নিয়ে নিজের আত্মজীবনী লেখার কথা ভাবেন?
আত্মজীবনী লেখার মতো তেমন কোনো অর্জন আমার নেই। আত্মজীবনী লেখার চিন্তাও আমার নেই। আমার মতো মানুষের আত্মজীবনী হয় না।
আত্মজীবনী কাদের লেখা উচিত বলে মনে করেন?
আত্মজীবনী প্রতেক্যের লেখা উচিত। আত্মজীবনী হচ্ছে ব্যক্তির সময়যাপনের ইতিহাস। এই যে ধরেন, আপনি যদি আপনার কথাগুলো না লিখেন তবে কালের গর্ভে আপনার সময়যাপনটাও হারিয়ে যাবে। আগামীকালের পাঠক কিংবা গবেষকের জন্য বিষয়টি ক্ষতিকর। কোনোকিছুই হারিয়ে যাওয়া উচিত না। আত্মজীবনী লেখাও খুব কঠিন বিষয়। বলা হয়ে থাকে বাঙালিরা আত্মজীবনী লিখতে জানে না। আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে তারা সত্য বলতে পারে না। কিংবা নিজেদের লেখায় কল্পনা মেশাতে মেশাতে নিজেরাই নায়ক হয়ে ওঠে। সত্য-মিথ্যা নয়, আত্মজীবনীতে সময় এবং যাপনটাকে হাজির করতে হয়। কেননা মানুষ যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, সে মূলত সময়ের সাথে লড়াই করে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানুষের ইতিহাসই সময়ের ইতিহাস।
আপনার জন্ম, বেড়ে ওঠা, আপনাদের পরিবার নিয়ে কিছু বলুন।
আমার জন্ম ৭ মার্চ ১৯৬০ সালে। বাংলায় ২৪ ফাল্গুন ১৩৬৬ সন। আমার জন্মস্থান পূর্বধলা কিন্তু পৈতৃক নিবাস নেত্রকোনা সদর। সেখানে আমার পৈতৃক সম্পত্তির সবটুকুই এখনো বিদ্যমান। পূর্বে সমস্ত বাড়িটি বাবার নামে ছিল। এখন সেটা আমার নামে।
সেগুলোর এখন কি অবস্থা? দেখাশোনা কে করেন?
আমি যেহেতু বাড়িতে থাকি না তাই বাড়িটা আমার নামে করে হাওরে সমপরিমাণ জমি নিয়েছে ভাইয়েরা। অথচ তারা বাড়িটাও ভোগ করছে। এতে বাবার সম্মতি ছিল। প্রথমে আমার বাবা হেলথে চাকরি করতেন। দাদা ছিলেন গ্রামের মাতব্বর। দাদা লক্ষ করলেন বাবাকে সমাজের নিম্নবর্গের লোকেরা অনেক সম্মান দেয়। তো একদিন বাবাকে এ নিয়ে দাদা প্রশ্ন করেন এবং ভর্ৎসনা করেন, তাতে বাবা চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। তৎকালীন সময়ে সাধারণ মানুষের মনে সেনাবাহিনীর চাকরি নিয়ে বিরূপ ধারণা ছিল। বাবা যখন সেনাবাহিনীতে নন-কমিশন্ড অফিসার হিসেবে যোগদান করেন তখন পৃথিবীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলমান ছিল। বাবার চকবাজারে পোস্টিং ছিল। যুদ্ধে নিহত চকবাজারে আসা লাশগুলোর রিপোর্ট করতেন তিনি। একটা পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে চাকরি ছেড়ে দেন। পিস্তল নিয়ে চলে আসেন, তাই উনার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। বাড়িতে পুলিশ আসে যা অপমানজনক। তাই দাদা ক্ষুব্ধ হন।
উনি কি সোলজার হিসেবে যোগদান করেন?
হ্যাঁ। উনি সোলজার হিসেবে যোগদান করেন।
পড়াশোনা কতদূর ছিল?
তিনি এন্ট্রান্স পাস করেনি। তিনি নেত্রকোনায় দত্ত হাই স্কুল এবং আঞ্জুমান স্কুলে কিছুকাল পড়াশোনা করেছেন। বাবা চল্লিশা ইউনিয়নের দরিদাঘী গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে কিছুকাল শিক্ষকতাও করেছেন। চল্লিশা ইউনিয়নের বারেক সাহেব বাবার ছাত্র ছিলেন।
তিনি কি সামরিক বাহিনী থেকে পেনশন পেয়েছেন?
না। কারণ তিনি পালিয়ে এসেছিলন। বাবা পরবর্তীতে কয়লার খনিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। উর্দু জানায় ও কিছুটা শিক্ষিত হওয়ার দরুণ অফিসার বাবাকে ট্যালি ক্লার্ক পদে উন্নীত করে। তিনশ ট্যালি থেকে পাঁচশো ট্যালি বানানোর মতো চুরির সাথে জড়িত থেকে এক সময় তিনি হাঁপিয়ে ওঠেন। এ কাজ করতে অস্বীকার করলে তারা বাবাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। যখন বেশি অত্যাচার শুরু করে তখন পিস্তল দিয়ে ভয় দেখিয়ে সেখান থেকে চলে আসেন। কিছুদিন ফুফুর বাড়িতে অবস্থান করেন। সেখান থেকে ভারত চলে যান। সেখানে পান্ডা সিনেমায় কাজ করেছেন। বাবা ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি, ফারসি ও বাংলা ভাষা জানতেন। আমি ইংরেজিটা কম জানি। এক পর্যায়ে আবার তিনি সামরিক বাহিনীর সিভিলে চাকরি পান কিন্তু বাবা চাকরিতে অসম্মতি জানালে তারা বাধ্য করে আনসার বাহিনীতে যোগ দিতে। বাবা তাতেও অসম্মত হলে স্কুলশিক্ষক পদে নিয়োগ দিয়ে নেত্রকোনায় পাঠানো হয়। তখন তিনি বিয়ে করেন। মামার অকাল মৃত্যু হওয়ায় শ্বশুরবাড়ি অবস্থান ও শিক্ষকতা করেন। কিন্তু তাতেও মন টেকেনি, শুরু করেন ধান-পাটের ব্যবসা। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত নেত্রকোনাতেই ব্যবসা চালিয়ে যান। আমি তখন পূর্বধলাতে পড়াশেনা করছি। আমার শৈশবের অনেক সুন্দর সময় কাটিয়েছি বাবার সাথে।
উনি তো পড়াশোনায় আগ্রহী ছিলেন। উনি কি আপনাকেও অনুপ্রেরণা দিয়েছেন?
আমার বাবা পুঁথি পড়তে খুব পছন্দ করতেন। বড়চাচা পড়াশোনা জানতেন না। বাবার পাশে বসে উনিও পুঁথিপাঠ শুনতেন। মানুষকে সাহায্য করা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় খুব সচেষ্ট ছিলেন। পুঁথিপাঠের সাথে দুজনেই গভীরভাবে মিশে যেতেন। করুণ দৃশ্যগুলোতে উনাদের চোখ অশ্রুসিক্ত হতো। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না-থাকা সত্ত্বেও বাবার পুঁথিপাঠে গভীর অনুরাগ আমাকে অনুপ্রাণিত করত।
আপনাদের বংশের উপাধি ‘খান‘, সেটা কীভাবে?
গৌরিপুরের একটা গ্রাম কুল্লাতলি। আমাদের পূর্বপুরুষের বাসভূমি ছিল ওই গ্রাম। ওইখান থেকে একটা অংশ চলে আসে দরিজাগী গ্রামে আরেকটা অংশ বামনমোহা গ্রামে। ওখান থেকে আমরা চলে আসি পূর্বধলায়। আমার পূর্বপুরুষ কখন হিন্দু ছিল সেই ইতিহাস জানি না। বাবা জানলে বলত। এটা আসলে কখনো অনুসন্ধান করা হয়নি।
আপনার মধ্যে গবেষণা করার আগ্রহটা জন্মালো কীভাবে?
আমি ম্যাট্রিক পাশ করে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হই। তখন পূর্বধলায় কেউ সাংবাদিক ছিল না। পূর্বধলার ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে একটি প্রতিবেদনের দায়িত্ব আমার ওপর বর্তায়। তখন আমি পূর্বধলায় টিএনও আবুবক্কর সিদ্দিক কর্তৃক আয়োজিত টুর্নামেন্ট থেকে তথ্য সংগ্রহ করি। লেখাটা ততটা ভালো না-হওয়া সত্ত্বেও প্রকাশিত হয়। অনেকে প্রশংসা করে। সেখান থেকে সাংবাদিকতা আর লেখালেখির প্রতি আগ্রহ জন্মায়। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে নানান বিষয়ের খোঁজ পাই। সেইসাথে অনুসন্ধানও শুরু করি। এখান থেকেই ধিরে ধিরে আমার ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ জন্মে।
আপনার ইতিহাস লেখার শুরুটা আমাদের নেত্রকোনা থেকে, নাকি অন্য কোথাও থেকে?
প্রথমে পূর্বধলা থেকেই শুরু করেছি। পরবর্তীতে নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত পৌষমেলায় দত্ত উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বক্তৃতা দিয়েছি। সময়টা ছিল ১৯৮৮। বাবা আর কাকাও উপস্থিত ছিলেন। আরো কিছু বক্তা বক্তৃতা করেছিল। তারা নেত্রকোনা সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করে। কিছু অকাট্য বিষয়কে রঙঢঙ লাগিয়ে উপস্থাপন করেছেন। আমি পাল্টা বক্তৃতায় সেসবকে ডিফেন্স করি। আর তখনই বুঝতে পারি এখানকার ইতিহাসে নানা গরমিল আর প্রচুর ভ্রান্ত ধারণা আছে। সেখান থেকেই…
আপনি যে ইতিহাস লিখেছেন, তখন তো নেত্রকোনা জেলার ইতিহাস বিষয়ক তেমন কোনো বইও পওয়া যেত না। তো আপনি এত বড় একটা ইতিহাস লিখলেন কীভাবে? তখন ময়মনসিংহ জেলার ইতিহাসও সেভাবে লেখা হয়নি। তখন সিলেট, পাবনা, বিক্রমপুর, চট্টগ্রাম, ঢাকার ইতিহাস লেখা হয়েছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে আপনি কি উক্ত গ্রন্থগুলো থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন? আপনি তো কোনো অ্যাকাডেমিক লোক নন। আমাদের একটা বাজে ধারণা আছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক না হলে কেউ অ্যাকাডেমিক কাজ করতে পারে না। আপনি অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতিও পাননি। সেই হিসেবে আপনি একটা ইতিহাস গ্রন্থ কী করে লিখলেন?
ইতিহাস লেখার আগে আমি কেদারনাথ মজুমদারের বইটি পড়েছি। শ্রদ্ধার সঙ্গে বলছি যে বিশাল একটা কাজ করেছেন। ইতোমধ্যেই বের হয়েছিল দর্জি আব্দুল ওয়াহাবের ময়মনসিংহের জীবন-জীবিকা।
আপনার বইটি কবে প্রকাশিত হয়েছে?
আমার বইটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৭ সালে। একটা বই লিখতে অনেক সময় লাগে। আমি বিভিন্ন সেমিনারে দেওয়া বক্তৃতা থেকে নেত্রকোনার ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা লাভ করি। গোলাম এরশাদুল রহমান, যতীন সরকার, আশরাফ সিদ্দিকী, ফজলুল কাদেরের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা বক্তৃতা দিতেন। বিশেষ বাড়ির লোকেরা ও ঢাকার লোকজন আসতেন। তাদের বক্তব্য শুনে নেত্রকোনার গুণী ব্যক্তি সম্পর্কে আমার ধারণা হয়ে গেছিল। ইতোমধ্যে জানতে পারি নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক দেওয়ান আফসার উদ্দিন বিশজন সদস্যের ইতিহাস মনোনয়ন কমিটি গঠন করেন। তখনও আমার নাম কেউ জানে না। সেই সময়ে আমার ইতিহাস বিষয়ক লেখালেখি ময়মনসিংহের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে।
পরে বইটি করলেন কীভাবে?
জি। বিভিন্ন লোকজনের অর্থায়নে এটি বের হয়েছে। ওনার বইটা থেকে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমিই প্রথম যুদ্ধে শহিদ হওয়া সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করেছি।
‘হাজং সম্প্রদায়’ বইয়ের ওপর কীভাবে কাজ করলেন?
নেত্রকোনা জেলার কাজটা করতে গিয়ে হাজং সম্প্রদায় নিয়ে কাজ করার চিন্তা মাথায় আসে। তাদের তথ্য সংগ্রহ করার জন্য ইংরেজি জানা আবশ্যক। কলমাকান্দা, দুর্গাপুর গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছি। আমি জানি না আমার আগে সীমান্ত-অধিবাসীদের নিয়ে কেউ এতটা ভেবেছে কি না। আমি বৃহত্তর ময়মনসিংহের ছয়টি উপজাতি নিয়ে কাজ করার টার্গেট করেছি। এর মধ্যে গারোদের কাজটা সম্পন্ন করেছি। গারোদের কাজ করতে গিয়ে তপন বাগচী বলল গারোদের ওপর বাংলায় কোনো বই নাই, আমি কেন আরেকটা বই বাড়াচ্ছি না। তখন আমিও চিন্তা করলাম আরেকটা বই প্রকাশ করলে ভালো হয়। নেত্রকোনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক নইমুদ্দিনের সহায়তায় বই কম্পোজ করে ঢাকায় নিয়ে যাই। এবার বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে বইটি প্রকাশ করতে মনস্থির করি। তপন আমাকে বারবার বাধা দেওয়ার পরও আমি মানিনি। তপন একজনকে রেফার করল। তিনি বাংলা অ্যাকাডেমির পরিচালক ছিলেন। আমি তার কাছে গেলাম এবং কপিটা দেখালাম। বলল খুব ভালো কাজ হয়েছে। কিছু দিকনির্দেশনাও দিলো। আমি যেন পুনরায় অধ্যায়গুলো যাচাইবাছাই করে দেখি। দেখলাম। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরও বই ছাপা হচ্ছিল না, সেই নিয়ে একদিন বাংলা অ্যাকাডেমির মনসুর মুসা সাহেবের সাথে একটু মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। আমি সংস্কৃতিসচিব মোদাব্বের হোসেন সাহেবের দ্বারস্থ হলাম। উনাকে জানালে মোদাব্বের হোসেন সাহেব জামালপুরের সাইদুর রহমান (উপপরিচালক) মনসুর মুসা সাহেবকে কল দিয়ে বলেন বই ছাপানো হবে কি না সেটা ঠিক করবে রিভিউয়াররা। পরে আবার গিয়ে আমি হান্নান সাহেবের পরিচয় দিতেই রেখে যেতে বলল। তারা খবর পাঠাল পাণ্ডুলিপিটা ফটোকপি করে ভাষা পরিবর্তন করে রেখে আসতে। তপন তার এক বন্ধুকে দিয়ে কম্পোজ করে বের করে। আমি পরে জানতে পারি। জানতে পেরে ঢাকায় গিয়ে সূচিপত্র সংশোধন করে দিয়ে আসি। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ আমার বইটা বের হলো। আর কাজটা করে দিয়েছেন শিহাব শাহরিয়ার। আমি প্রথম কপিটা মনসুর মুসা সাহেবকে দিলাম। পরবর্তীতে তিন বছর ঘুরিয়ে কয়েকটা অধ্যায় বাদ দিয়ে গতিধারা থেকে আবার বের হয়েছে বইটি।
বই বের হওয়ার পর সম্মানি কি রকম পেয়েছেন?
বাংলাবাজারের প্রকাশকদের মধ্যে গতিধারা আমাকে বেশি সম্মানি দিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পেয়েছি। ২০০৩ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে আশি হাজার তিনশ টাকা পেয়েছি। বাংলাদেশের সাহিত্যের ওপর তাদের একটা কাজ করে দিয়েছিলাম। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও কাজ করেছে ওই সোসাইটির সাথে। আমাকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছে। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রধান হারুনর রশীদ স্যারের সাথে নানা বিষয়ে আলোচনা হতো। তিনি এখনো বেঁচে আছেন এবং সোসাইটির দায়িত্বে আছেন। এরপর হাজং সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা পাই। গারো পাহাড়ের আদিবাসীরা তিন কিস্তিতে ষাট হাজার টাকা দেয়। ‘গারো সম্প্রদায়ের উৎসব প্রভাব’ এই বইটাতে তেত্রিশ হাজার টাকা দেয়। তারপর ইন্ডিয়া থেকে একটি ভার্শন বের হয়, জেকে বুকস প্রকাশনী থেকে।
ওরা আপনাকে কত টাকা দেয়?
ওরা আমাকে ষোলো হাজার রুপি দেয়।
এখন কি নিয়ে কাজ করছেন?
এখন নেত্রকোনা জেলার সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছি।
এটা কতটুকু বিস্তৃত করার ইচ্ছে রাখেন? শুধু বোদ্ধা পাঠক নাকি যে-কারো জন্য?
আমি এটাতে অনেক টীকা ব্যবহার করার চেষ্টা করছি, যাতে আগামী প্রজন্মের গবেষকরা সহজেই সূত্রগুলো উদ্ধার করতে পারে। আমি যে কাজটা শেষ করতে পারব তা কিন্তু না, আগামী প্রজন্ম যাতে কাজটা করতে পারে। নেত্রকোনার সীমানা পরিবর্তন একটা বিষয় হতে পারে। আমি এই বিষয়ে একটি অধ্যায় যুক্ত করেছি। আমার টীকা লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো আগামী প্রজন্মকে গবেষণায় উৎসাহিত করা। আরো অনেক বিষয় আছে সেগুলোও গবেষণার অংশ হতে পারে।
একজন ইতিহাসগবেষক হিসাবে ভবিষ্যৎ পাঠকের কাছে আপনি কী আশা করেন? আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ইতিহাসকে কীভাবে সংরক্ষণ করবেন বা ইতিহাসের প্রতি দায় তারা কীভাবে পালন করবে এবং তাদের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
আমি ইতিহাসগবেষক কি না জানি না। তবে আমি আমার অতীত স্মরণ রাখতে চাই। আমি যদি আমার বাবা-মায়ের পরিচয় না-জানি তাহলে বিষয়টা খারাপ দেখায় না! তাই পরিচয় জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এমনই আমাদের জেলার ইতিহাস সবাই যে লিখবে এমন তো নয় তবে কাউকে না কাউকে তো লিখতেই হবে। আগামী প্রজন্ম আরো ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে পারে। আমাদের উচিত আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু দৃষ্টান্ত হিসেবে রেখে যাওয়া, যাতে অতীতের ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন মজবুত হয়। আমি যখন পত্রিকায় লিখতাম তখন একটা লোক আমাকে তিরস্কার করে বলেছিল, আপনি যে-জেলার সেই জেলার এমন একটা (সেতুবন্ধনের) ধারাবাহিকতা নাই। তার নামটা ভুলে গেছি। তখন আমার মনে হলো আমাদের পূর্বপুরুষরা তো অনেক জ্ঞানীগুণী ছিলেন। যেমন : সত্যপ্রেরণ, আদিত্য সরকার, যতীন সরকার, নূরুল হক, রওশন ইজদানি, সিরাজউদ্দীন কাশেমপুরী, খগেশ কিরণ তালুকদার … উনারা যদি কাজ না-করতেন তাহলে আমি কাজটা করতে পারতাম না।
খগেশ কিরণ তালুকদারের সবগুলো বই আছে আপনার কাছে?
উনার লোকায়ত সংস্কৃতি বইটা আছে আমার কাছে।
আমরা আপনার লেখালেখি নিয়ে প্রায় দুইঘণ্টা যাবৎ কথা বললাম। এতে আমাদের অনেক উপকার সাধন হয়েছে। আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। ধন্যবাদ।
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
গানপার ইন্টার্ভিয়্যু
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS