জটিলবাবু || অসীম চক্রবর্তী

জটিলবাবু || অসীম চক্রবর্তী

জোর গান পেলেই জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় (Jatileswar Mukhopadhyay) ছুটে যেতেন গঙ্গার ধারে দোতলায় তাঁর একটি গানঘরে। গানঘর এজন্যই বললাম যে ওই ঘরে তিনি যেতেন কেবল গান-সুর ইত্যাদির জন্য।

সেদিন জটিলবাবু গানটির স্থায়ী লাইন দুটো লিখলেন। তারপর সারারাত ধরে চেষ্টা করলেন সুর করতে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। কোনো সুরই মনে ধরছে না। এর মধ্যে রাত ভোর হয়ে গেছে। বুকভরা বিরক্তি আর সারারাতের নির্ঘুম রক্তজবার মতো লাল চোখ নিয়ে দোতলার সেই গানঘরের জানালায় গঙ্গার রূপ দেখতে দেখতে একটি সিগ্রেট ধরালেন।

সিগ্রেটে টান দিয়ে গঙ্গার বাতাসে ধোঁয়া ছেড়ে আনমনে বার-কয়েক সা রে গা মা পা — এই পাঁচটি স্বর আওড়ালেন। তারপরে নিজের অজান্তে মুচকি হেসে এই পাঁচটি স্বরের উপরে স্থায়ী বাণীর প্রারম্ভিক শব্দগুলোকে বসিয়ে সুরারোপ করলেন কালজয়ী গান “বঁধুয়া আমার চোখে জল এনেছে হায় বিনা কারণে …”

২.

নকশাল আন্দোলনের সময়কাল। একদিন সন্ধ্যায় গলির মোড় থেকে হেঁটেই বাড়ি ফিরছেন জটিলেশ্বর। এমন সময় কানে এল কোনো-এক বাড়ি থেকে মুক্তোর দানার মতো ভেসে আসছে সেতারের আওয়াজ। ভাটিয়াল রাগ। দুর্দান্ত হাতের বাজনা — শুনেই বোঝা যায়। তিরের ফলার মতো সুরলাগানো রাগ ভাটিয়ালের স্বর গা পা গা পা রে সা — শুনে জটিলবাবুর মাথা গেছে খারাপ হয়ে। বোকার মতো নিজেকেই প্রশ্ন করছেন, সন্ধ্যাবেলা ভোরের রাগ ভাটিয়াল বাজছে কেন? ভাবছেন কে এমন শিল্পী যে বাড়ির কাছেই থাকে অথচ জানা হলো না! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ শুনলেন, নিজের বাড়ির দিকে হাঁটলেন, তারপর অন্ধকারেই সিঁড়ি ভাঙতে লাগলেন। আচমকা মনের মধ্যে ওই সুরের পকড়ে কতকগুলো কথাও এসে গেল।

পরের দিন খোঁজ নিয়ে বুঝতে পারলেন কারো বাড়িতে পণ্ডিত রবিশংকরের রেকর্ড বাজছে।

যা-ই হোক, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আনমনেই আওড়ে চলেছেন ভাটিয়াল রাগের স্বর গা পা গা পা রে সা …

বাড়ি পৌঁছেই স্ত্রীকে বললেন, শিগগির হারমোনিয়ামটা দাও। এর ঠিক চল্লিশ মিনিট পরেই ভাটিয়াল রাগের উপরে রচিত হলো কালজয়ী সেই গান।

রচিত হলো “এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার …

… …

অসীম চক্রবর্তী

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you