মায়ায়, প্রেমে, আত্মীয়তায় মগরার তীরে থাকি। এখানে-সেখানে যাই, ঘোরাঘুরি করি। মায়ার শহরে ফিরে আসি। মায়াতেই বাঁচি। এই মায়া, স্নেহ ও আত্মীয়তার উদার পরশে যতীনস্যার আমাকে আত্মীয় করে নিয়েছিলেন।
শৈশবে ব্যাকরণ পড়ানোর উছিলায় স্কুলশিক্ষকই বলেছিলেন স্যারের নাম। তারপর দত্তস্কুল কিংবা মোক্তারপাড়ার মাঠে পৌষমেলা উপলক্ষে স্যারের বক্তৃতা শুনেছি। আমি চিরকাল বিস্ময় এবং মুগ্ধতার ভেতরেই বসবাস করি। যতীনস্যারের মতো পাণ্ডিত্যপূর্ণ মানুষের বক্তৃতায় বিস্ময়স্নাত হব—এটাই স্বাভাবিক। সেই বিস্ময় থেকেই স্যারের ময়মনসিংহের ১৭, হিন্দুপল্লির বাসাতেও গিয়েছি। সে-সময়ের বিখ্যাত সাহিত্যপত্রিকা শৈলীর নিয়মিত পাঠক ছিলাম। তিনি তাঁর ছোটভাই আমার শিক্ষক অধ্যাপক মতীন্দ্র সরকার স্যারের মাধ্যমে শৈলীর কবি শামসুর রাহমান সংখ্যা এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের কথাশিল্পী আবুল বাশারের ‘ফুলবউ’ এবং ‘সিমার’ উপন্যাস দুটিও নিয়েছিলেন। কিন্তু সেসব উপস্থিতি কিংবা বই বিনিময়েও প্রেম তৈরি হয়নি।
যতীনস্যার আমাকে কিংবা আমি যতীনস্যারকে অন্তরতম করে নিয়েছিলাম নেত্রকোণার বানপ্রস্থে। আক্ষরিক অর্থেই স্যারের রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ‘বানপ্রস্থ’ নামের বাড়িটি ছিল জ্ঞানচর্চার আশ্রম। নাসিরাবাদ কলেজের শিক্ষকতার প্রাতিষ্ঠানিক কর্মজীবন শেষে স্যার তখন নেত্রকোণায় স্থায়ী হয়েছেন। ফুল-ফল সমৃদ্ধ এই আশ্রমটি নির্মাণের সময় থেকেই আমি যুক্ত ছিলাম। নেত্রকোণায় আসার পর তাঁর পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার্থী হলাম।

অগ্রজের আন্তরিকতা থেকেই প্রাণিত হয় অনুজ। নেত্রকোণায় বাস করলেও সারাদেশের তরুণেরা তাঁর এই আশ্রমে গমনাগমন করেছেন। মাধুর্যমন্ডিত প্রবীণের এই ইস্কুল থেকে শান্তি নিয়েছে, জ্ঞান নিয়েছে, ভালোবাসা নিয়েছে বেশুমার মানুষ। অত্যন্ত যত্ন ও আন্তরিকতায় স্যার প্রতিটি অনুজকেই পরিচর্যা করেছেন। যতীন সরকার শুধু প্রজ্ঞান মানুষই নন; ছিলেন উদার, সহিষ্ণু, স্নেহশীল। মানুষকে ভালোবাসতে পারার অতল মহাসিন্ধু।
আমার জীবনের শান্তির একটা পলল হচ্ছেন যতীন সরকার। ২০০৭ সালে আমি নেত্রকোণা কলেজের বাংলা বিভাগে যোগদান করি। চেষ্টা করি আন্তরিকতার সাথে শিক্ষকতা করতে। শিক্ষার্থীকে ভালোবাসি, শাসন করি, থাকি পাশাপাশি। শিক্ষার্থীরা হয়তো ভালোবাসে কিন্তু ভয় করে, দরদে সমীহ করে। দু-একবার তারা জন্মদিন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেও সফল হতে পারেনি। আমিই ভন্ডুল করে দিয়েছি। আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ হতে দেইনি। সম্ভবত ২০১৩ কিংবা ২০১৪ সালে শিক্ষার্থীরা ভিন্ন রকম একটা পরিকল্পনা করে। যতীনস্যারের সাথে মিলেমিশে এক গুপ্ত পরিকল্পনা করে তারা।
২৫/৩০ জন শিক্ষার্থী মিলে ডিসেম্বরের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে তারা আমার বাসায় হাজির হয়। আমি ঘুমাচ্ছিলাম। স্যারের কণ্ঠস্বরেই ঘুম ভাঙে। এক ঝটকায় বিছানা থেকে উঠে দেখি সত্যি সত্যি স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। শিক্ষার্থীরা অনেক পেছনে, আরো অনেকটা দূরে।
আমি তালা খুলছি। হতবাক আমার উদ্দেশ্যে স্যার বললেন, “আমরা সবাই মিলে তোমার জন্মদিন উদযাপন করতে এসেছি। তুমি ওদেরকে (পেছনের শিক্ষার্থীদেরকে দেখিয়ে বললেন) কিছু বলবে না; আমরা কেইক, মিষ্টি, ভাপা পিঠাও নিয়ে এসেছি। দরজা খোলো। এই তোমরা আসো। ভয় নেই। তোমাদের স্যার কিচ্ছু বলবেন না।”

একটা মানুষের জীবনে এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে, তার জীবনের প্রিয় এবং শ্রদ্ধার মানুষটিই যখন কুয়াশামাখা ভোরে জন্মদিনের শুভেচ্ছা এবং আশীর্বাদ নিয়ে আসেন! স্যার বাসায় এলেন। কেইক খাইয়ে দিলেন। আশীর্বাদ দিলেন। বই উপহার দিলেন। যাওয়ার সময় ১০০০ টাকার একটি নোটও পকেটে দিয়ে গেলেন পছন্দের বই কেনার জন্য।
এভাবেই স্যার প্রতিবছর শীতের ডিসেম্বরে আমার মতো একজন সাধারণের জন্মদিনের আশীর্বাদ রাখার জন্য একদল নবীন শিক্ষার্থীদের নিয়ে বাসায় এসেছেন। সম্ভবত ২০১৬ সালে আমি আগেই বলেছিলাম, আমি থাকব না, ঢাকা যাব। কিন্তু স্যার ভেবেছেন তাঁর কষ্ট হবে; এজন্য আমি না-করেছি। কিন্তু ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের সেই ভোরে স্যার ঠিকই হাজির হয়েছেন। আমার অনুপস্থিতিতে স্যার কেইক কেটে জন্মদিন উদযাপন করেছেন।
মনে হয় এভাবে চলতেই থাকত। দুরারোগ্য আথ্রাইটিস রোগও স্যারকে থামাতে পারেনি। আমার মতো ছোট্ট মানুষকে আশীর্বাদ করার জন্য স্যার আমার কুটিরে হাজির হয়েছেন। করোনার মহাকাল এই উদযাপনটা থামিয়েছে। আমার মতো চুপচাপ, দাঁড়িকমাহীন মানুষের জন্য আর কী চাই! এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার আর কি হতে পারে? ভালোবাসার এই প্রাপ্তি কেউ কি কেড়ে নিতে পারবে?
গানপারে যতীন সরকার
গানপারে সরোজ মোস্তফা
- জীবন জানাবোঝার এই অনাড়ম্বর আয়োজন || সরোজ মোস্তফা - October 23, 2025
- রকিব হাসান : অকাল প্রস্থান - October 16, 2025
- সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এক সাহিত্যিক ও সমাজশিক্ষক || সরোজ মোস্তফা - October 13, 2025

COMMENTS