মৃদঙ্গ নিয়া জানুপিঁড়ি বসেছেন দুইজন, ঢিমেতালে ঠেকা দিচ্ছেন দুইহাতের চাটি দিয়া, দুইজনেই পুরুষ। পুরুষ বললে যে-একটা দশাসই বয়স বোঝায় তা নয় অবশ্য, কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণতর দুই মৃদঙ্গবাদক। দুইহাতের তালুতে নিয়া বাজাইতে হয় এমন আরেকটা তালযন্ত্র, লোকায়ত বাংলার গানবাজনায় সাধারণদৃষ্ট একটা তালযন্ত্র, এতদঞ্চলে তালবাদ্যির এই হাতমুঠো যন্ত্রটাকে আমরা বলি করতাল, করতালির ভঙ্গিমায় হাতজড়ো তুলতে হয় তাল যেই যন্ত্রে, অনেকটাই কীর্তনমন্থর দুলকি চালে এলানো দ্রুতির করতাল পাঁচজোড়া বাজাচ্ছেন পাঁচজন বয়োজ্যেষ্ঠা নারী। এছাড়া আছে একখানা হার্মোনিয়্যম। সংগীতের আবহ তৈয়ারের প্রিপারেটোরি টুংটাং শুধু; বলিউড তখনও বহুদূর, মানে কিনা অ্যানশিয়েন্ট অর্থে দিল্লির সেই প্রবাদ; মূল অনুষ্ঠানপর্ব শুরু হবার কথা রাইত বারোটায়, ইংলিশ টাইমে শুরু হবে জেনেই গিয়েছিলাম, সেইটা বাজবার নামনিদ্রা নাই; ইনাইয়াবিনাইয়া আয়োজকদের কোনো ঘোষণাবালাই ছিল না বলেই বাঁচোয়া, হার্মোনিয়্যম-করতাল আর বয়স্ক সধবা-বিধবা নারীকণ্ঠের লেলাইয়া-লেলাইয়া গানগুনগুনানির একটা বাতাবরণে অনুষ্ঠানস্থল সুশ্রাব্য ও স্নিদ্ধ, ফলে প্রতীক্ষাপ্রহর কাটছিল মন্দ নয়, অ্যাট-লাস্ট বারোটা বাজল গিয়া কাঁটায়-কাঁটায় রাত্তির একটায়। সিলেট টু কুলাউড়া মেইলট্রেনের মতোই বিলম্বিৎ গতের সার্ভিস, তবু সুবাতাসময়, তবু চলতে শুরু করলে ট্রেনজার্নি স্নিগ্ধ ও ছন্দমুখরিত। মন্দিরচাতালের বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল মধ্যরাতের, গ্রিলঘেরা তিনদিকখোলা টাইলসঝকোমকো মন্দিরমেঝেতে অভ্যাগতরা আসনপিঁড়ি বসে আছেন মাঝখানে একটা জায়গা ফাঁকা রেখে, রাধাকৃষ্ণ যুগলমূর্তি ঠিক নাকবরাবর দোলনায় রাখা, সেই ফাঁকা জায়গায় কৃত্যাদি কিছু হবে আঁচ করা যাচ্ছিল। মনোজ্ঞ পরিবেশ, অপেক্ষার বিবিক্তি ভোলানো শ্রীময় শান্তি।
লিখছিলাম ঝুলনবিবরণী। স্মৃতি থেকেই লিখতে লেগেছি। এই বছর ২০১৮-র অগাস্ট ২৭ এবং ২৮ ছিল ঝুলনের অনুষ্ঠানমালা। আমি গিয়েছি শেষ-রজনীতে। প্রতিবছর শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে খোপায় ফুল আর মাইখুম্বি, গায়ে রেশমি ব্লাউজ, স্বর্ণালঙ্কার এবং চুমকি-জরির ঝলোমলো পোশাক পরে দেবদুলালির সাজপরিচ্ছদে মনিপুরী মেয়েরা নৃত্য পরিবেশন করেন। এই নৃত্যনৈবেদ্য চলে রাতভর, পরপর দুই রাত ভোর তক, এবং এই সময় রাধাকৃষ্ণকে দোলনায় ঝুলিয়ে কৃষ্ণকীর্তন থেকে শ্লোক ও অন্যান্য বৈষ্ণব পদাবলি পরিবেশন করা হয়। শ্রাবণের একাদশীতে শুরু হয়ে পূর্ণিমায় গিয়ে শেষ হয় এই উৎসব। সিলেটে প্রতিবছরই মনিপুরী সম্প্রদায়ের লোকেরা ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে এই উৎসব পালন করেন। মূলত মৈতৈ গোষ্ঠীর মনিপুরীরাই এই উৎসবে বেশি পার্টিসিপেইট করে থাকেন। তবে মৈতৈ নয় শুধু, কথা বলে জানা গেল যে বিষ্ণুপ্রিয়ারাও এই উৎসব পালন করে থাকেন। সিলেট নগরীর মনিপুরী রাজবাড়ি ও শিবগঞ্জ এলাকার মনিপুরী মন্দিরে এই উৎসব ঘিরে ব্যাপক আয়োজন করা হয় ব্যত্যয়হীন প্রত্যেক বছর। খাদিমনগরের মনিপুরী মণ্ডপেও ঝুলন ঘিরে ব্যাপক আয়োজন হয়ে থাকে। এছাড়া আরও যত জায়গায় মনিপুরী কমিউনিটি রয়েছে, যেমন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ ইত্যাদি উপজেলায় বেশ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মনিপুরীদের বংশপরম্পরায় নিবাস ও সমৃদ্ধ লোকাচার, সবখানেই ঝুলনে ব্যাপক উৎসবমুখরতা আমরা লক্ষ করি।
স্মৃতি থেকেই লিখছি যেহেতু, নোটফোট নিই নাই, ভুলভ্রান্তি পয়েন্টার দিয়া দাগাইয়া পড়া যাবে না কাজেই। কিছু তথ্য তো সকলেরই জানা, কাজেই সেসব বলা বাহুল্য, আর কিছু কথাবার্তা বানিয়ে বানিয়েই লিখি। কিন্তু বানিয়ে লেখা মানে বানোয়াটি নয়, অনুষ্ঠানভেন্যুতে যা দেখেছি তা খানিকটা নিজের পূর্বাভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা। আন্দাজ যেটুকু করেছি সবটুকুই মেইনস্ট্রিম সনাতনী কৃত্যচর্যার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা। কাজেই নিবন্ধটা আদৌ সন্দর্ভ নয়, এক দর্শকের দেখনাভিজ্ঞতা। আস্বাদন করেছি ঝুলন পয়লাবারের মতো, কনফেশন করে রাখি গোড়াতেই। নিবন্ধটি পড়ে আপনিও মিলিয়ে নেবেন আপনার দেখাদেখিটুকু, শুধরে দেবেন নিবন্ধকারকে, যদি কারো চোখে পড়ে এই লেখা। আদৌ নজরে কারো পড়বে বলে মনে হয় না। যাকগে। লেগেছি পুরামাত্রায় এম্পিরিক্যাল রচনা লিখতে। এক্ষেত্রে থিম্যাটিক হিস্ট্রি বা মিথ খানিকটা জানা থাকা আবশ্যক শর্ত হলেও বক্ষ্যমাণ নিবন্ধকারের জানাশুনো অতটা নাই স্বীকার করতেই হয়।
মৃদঙ্গ, করতাল আর হার্মোনিয়্যম সহযোগে প্রলম্বিত স্বরে মেয়েলি গীতিকা গাওয়া হচ্ছিল। মনিপুরী রাজবাড়ির মন্দিরথানের মেঝেয় হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছি শ্রীযুক্ত সুতীর্থ পরিবেশে। একটা বাজবার দুই মিনিট পরে শুরু হলো মূল অনুষ্ঠান তথা নাচ। অবশ্য শুরুর আধাঘণ্টা আগে থেকেই শিল্পীরা সারিবদ্ধ দাঁড়িয়েই ছিলেন একঠায়। বেচারাদের যেটুকু স্ট্যামিনা তা আধাঘণ্টা ওয়েইটিঙেই নিকেশ হয়ে যাবার কথা। আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ভালোই স্টার্ট করলেন তারা।
স্টার্টআপ ড্যান্স ১২ জন কিশোরী (আন্দাজে কিশোরীই ধরছি) আর ৯ জন শিশুর সমবায়ে শুরু হলো। সব মিলিয়ে একুশ/বাইশজনের নৃত্য। যথেষ্ট দীর্ঘ। খুব ডিটেইলে ড্যান্স বর্ণনার টেক্নিক্যাল স্কিল অফ এক্সপ্রেশন এই নিবন্ধকারের নাই, তা-ও যদি কেউ উপস্থাপন করতেন নাচের ইতিবৃত্ত তবে হয়তো-বা খানিক ডিপে যেয়ে রসাস্বাদন করা যেত। ঘোষণাবিহীন নিরবচ্ছিন্ন নাচমালা, কাজেই শিরোনামবিভাজনের মধ্য দিয়ে একটা নাচের সঙ্গে আরেকটা নাচের পার্থক্য করবার সুযোগটাও নিতে পারছি না।
নাচের সময় স্টেপআপ-স্টেপডাউনগুলো শুধু লক্ষ করে যাচ্ছিলাম। সঙ্গে যে-গান গাওয়া হচ্ছিল সবই মনিপুরী ভাষায়, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মনিপুরী অনুবাদ হবে নিশ্চয়, ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যারিয়ার থাকার কারণে গানের বাণী ডিটেক্ট করতে পারছিলাম না, নাচের মুদ্রাগুলোরও কোনটার কি মিনিং ডিনোট করা যাচ্ছিল না তাই। বাংলায় আমরা গানের বাণীর সূত্র ধরে নাচের মুদ্রা ঠাহর করে ফেলতে পারি। বৃষ্টির গানের লিরিকে ড্যান্স হলে কদমফুল বা মেঘসাজ কি বিরামহীন বরিষন তথা বিরহিনী প্রেমিকার হৃদয়ার্তি ঠিকই মুদ্রা দেখে বুঝে নিতে পারি। কিন্তু এক্ষেত্রে সেই সুবিধাটা পাচ্ছিলাম না। খালি অনুমান করছিলাম সমস্ত নাচই কৃষ্ণ ও তার প্রণয়িনীর প্রতি নিবেদিত ভক্তি। মিস্টিক নৃত্য, কণ্ঠের মোচড়েও মরমী নিবেদন স্পষ্ট বুঝতে পারা যাচ্ছিল।
পয়লা নাচের কথা ধরা যাক। অত্যন্ত সুস্নিগ্ধ ধীর গতির নাচ। স্টেপআপ-স্টেপব্যাক-স্টেপআপ। দুই-দুই ফর্মেশনের পদবিক্ষেপ। স্টেপিং শিফট হচ্ছিল সিঙ্গেল পদসঞ্চালনায়। এবং হুয়ির্লিং। ঘূর্ণন। ময়ূরের মতো পোশাকের পেখমবিস্তার সেই ঘূর্ণনকালে এমন এক নয়নাভিরাম দৃশ্য সঞ্চার করছিল যা সাধ্যাতীত বর্ণনা দেয়া। ফার্স্ট ড্যান্সের এন্ডিং হলো সহসা, অ্যাব্রাপ্টলি, নিশ্চয় তা পার্ট অফ কোরিয়োগ্র্যাফিপ্ল্যান হবে। অ্যানিওয়ে। সেকেন্ড আইটেমে দেখা গেল পয়লা নাচদলের শিল্পীরাই পার্ফোর্ম করলেন সবাই। হুয়ির্লিং হলো। খুব হাই পিচে হার্মোনিয়্যম বাজল। ভালো লাগল। থার্ড সেগ্মেন্টে দেখা গেল ওই একই নৃত্যয়িত্রীদলের সবাই গোল হয়ে বসা। সামনে রাধাকৃষ্ণ। দোল খাচ্ছেন যুগল হরষে। একটু কি পুলকের রেখাপাত লক্ষ করা গেল যুগলমূর্তির অবয়বে? ড্যান্সদল থেকে একজন নৃত্যয়িত্রী রাধাকৃষ্ণমূর্তির দিকে মুখ করে নেচে নেচে ভক্তি দিলেন পরিবেশনার অন্তিমে। এরপরের নাচটায় একই শিল্পী একক নৃত্যনৈবেদ্য হাজির করলেন। এইভাবেই চলছিল। ওই অর্থে উত্তেজনা নাই, কিন্তু স্যুদিং একটা এফেক্ট সারাক্ষণ টের পাওয়া যাচ্ছিল নাচগুলো থেকে।
এর আগে এই নিবন্ধকার বিভিন্ন সময়ে বেশকিছু মনিপুরী নৃত্যায়োজন আস্বাদিবার সুযোগ পেয়েছিল। মনিপুরী নৃত্যকলা নান্দনিকতায় এতই স্ট্রং যে তা নৃত্য-উপভোক্তাদের নজর মোহিত করে রেখে দিতে পারে দীর্ঘক্ষণ। উত্তেজনার স্থূলতা ছাড়া নাচের বিউটি এবং এলিগ্যান্স মনিপুরী নৃত্যের বিশেষ ফিচার বলেই মনে হয়। এই নিবন্ধকার তার জীবনের একটা বড় সময় সিলেটে কাটানোর কারণে বিভিন্ন সুযোগে মনিপুরী নৃত্য দেখবার মওকা পেয়েছে। সেহেতু বলা যায় যে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে নাচ ফর্মটার খুবই সূক্ষ্ম প্রয়োগ সহজেই চোখে পড়ে। এবং নাচ হচ্ছে তাদের দেবারতি নির্ণয়ের বাহন। দ্রুত গতির নাচ যে একেবারেই নাই মনিপুরীদের, তা হয়তো নয়; কিন্তু প্রশমিত আবেগের নাচই প্রণিধান পায় তাদের মধ্যে; এবং নাচগুলো উদ্দাম বল্গাহারা নয়, যেন উড়ে উড়ে বেড়ানোর স্বপ্নবাস্তবিকতায় সৃজিত মনিপুরী নৃত্যমালা। বীররসের নাচের মধ্যে ছেলেদের মৃদঙ্গ নাচ এমন একটা কাজ যেখানে অ্যাক্রোব্যাটিক স্কিলের বিউটি পরখ করা যায়। এর আগে বিভিন্ন সময়ে এই নিবন্ধকারের দেখা তাদের উল্লেখযোগ্য নৃত্যরচনাগুলোর মধ্যে একটি ছিল ‘মাইবি’, নৃত্যশাস্ত্র অনুসারে মাইবি হচ্ছে পূজারীদের নাচ তথা নাচের মধ্য দিয়ে দেবতাকে নিবেদিত অর্ঘ্য, নৃত্যনৈবেদ্যের মাধ্যমে দেবতাতুষ্টি অর্জন এই নৃত্যের অভীষ্ট। ‘দশাবতার’ শীর্ষক অন্য একটি নৃত্যরচনায় বিমোহিত হতে হয় যে-কাউকেই; মনিপুরী নৃত্যসাহিত্যের বয়ানে এই নৃত্যখণ্ডটিও ভক্তিরসের অবলম্বনে একটি বীরবন্দনামূলক দুর্গতিনাশন বরাভয়ের কলাকাজ। যখনই প্রথাগত ধর্মের মোড়কে গ্লানি ও হানাহানির কূটিলতায় আবিল হয়ে যায় পৃথিবীর মর্ত্যভাগ, স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু তখন মর্ত্যভুবনের কল্যাণে এবং সজ্জনসাধু সর্বজনের রক্ষার্থে এই বিভেদরক্তার্ত ধরণীতে একলাই দশ অবতারের রূপ ধরে অবতীর্ণ হন। ‘দশাবতার’ শিরোনামক অনবদ্য কম্পোজিশনে এই দৃশ্যকোলাজটিকেই নৃত্যমুদ্রায় ফুটিয়ে তোলা হয়ে থাকে। তেমনি আরেকটি বিশেষ উপভোগ্য নৃত্যকাজ বলতে হবে ‘মন্দিরা নৃত্য’। অত্যন্ত রোম্যান্টিক মেজাজের আঙ্গিক এই নৃত্যের গ্রথনে এনে দেয় ফুরফুরে এক ফল্গুধারার আমেজ। এটি আদতে একটি উৎসবনৃত্য। ঝুলন উৎসবের সময়ে রাধাকৃষ্ণ যুগলকে দোলনায় নিয়ে গোপীরা মন্দিরা বাজিয়ে এই নৃত্য করে থাকেন। প্রতিবেদনাওতায় যে-ঝুলনরজনী গৃহীত হয়েছে সেখানে এই নাচটা আগের রাতে কিংবা এই রাতেই হয়েছে কি না তা বলতে পারব না; কারণ, অনুষ্ঠান চলন্ত অবস্থায় পেটের খিদায় রাইত আড়াইটার দিকে ঘরমুখো হতেই হয় এই নিবন্ধকারকে। অ্যানিওয়ে অ্যাগেইন। ব্যুৎপত্তিবিচারে এইটুকু পরিচয় মাত্র নয়, মনিপুরী নৃত্যের শৈলীশোভা চাক্ষুষ করার ব্যাপার, চর্মচক্ষে হৃদয় জুড়িয়ে দেখার ব্যাপার, বর্ণনায় এর বিভা অল্পই বিবৃত করা যায়।
এইখানে একটা ব্যাপার উল্লেখ করে রাখি যে, সিলেটের আবহমান স্থানিক সংস্কৃতিতে ক্রমে ঐতিহ্যেরই অংশ হয়ে উঠেছে এই শিল্পঋদ্ধ অনন্যমাত্রিক মনিপুরী নৃত্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট সফরে এসে এখানকার মনিপুরী নৃত্য দেখে মোহিত হয়েছিলেন শুনতে পাই। ফিরবার সময় কাকে যেন সঙ্গে করে নিয়ে গেছিলেন শান্তিনিকেতনে এই নাচের পত্তনি করবেন বলে। সেসব বইপত্রে আছে, মেমোরিতে নাই আমার। সিলেটে অবশ্য মনিপুরী নৃত্য শিখন ও শিক্ষণের বেশকিছু উদ্যোক্তা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অ্যাভেইলেবল। এর মধ্যে অ্যাকাডেমি ফর মনিপুরী কালচার অ্যান্ড আর্টস্ এই নৃত্যানুশীলনে এবং এর প্রসারে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও রচিত নৃত্যমালা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও প্রশংসিত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান সঞ্চালক এবং কোরিয়োগ্রাফার সান্ত্বনা দেবী, যিনি রিপোর্টেড ঝুলনযামিনীতে মনিপুরী রাজবাড়ির মন্দিরমণ্ডপে উপস্থিত ছিলেন লক্ষ করেছি, কিন্তু তার কোনো কাজ পরিবেশিত হয়েছে কি না তা অবশ্য জানা যায় নাই।
কিছু ওভারঅল অব্জার্ভেশন টুকে যাই সংক্ষেপে এখানে। এক হচ্ছে, মনিপুরী সাংস্কৃতিক পরিবেশনাগুলোতে দেখা যায় নারীদের প্রাধান্য। কলাকুশলী, শিল্পী সকলেই প্রায় নারী। আরও স্পেসিফিক করে বলতে গেলে সকলেই কিশোরী। কিশোর বা পুরুষের সংখ্যা আমার দেখা বিবেচনায় নিলে বলব অঙ্গুলিমেয়। দুই নাম্বার জিনিশটা হচ্ছে, দেবতোষণ-দেবভজন ছাড়া কি নৃত্য আছে এই জনগোষ্ঠীর? ধরা যাক, ঋতুবন্দনামূলক নাচ? বা, অকারণের ঔদাস্য অথবা বৈরাগ্যের নাচ? তাদের যে একটা দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস, সেইটা উপজীব্য করে ড্যান্স বা গীতিনৃত্য কি নাই? থাকলে দেখতে পারব কিভাবে? এইসব মনে পড়ছিল ঝুলনের রাতে শান্তিবৃষ্টির ঝিরিঝিরি কৃষ্ণরাধিকামৌতাতের মণ্ডপে। এছাড়া ভাবছিলাম, ঝুলনের রিচুয়্যাল মনিপুরী কমিউনিটির বাইরে আমরা যারা মেইনস্ট্রিম সংখ্যাগুরু হিন্দু তাদের মধ্যে নেই কেন? ইস্কনের মন্দিরে যাই নাই, নিশ্চয় তারা উদযাপন করে থাকে। কিন্তু ঘরে ঘরে এইটা হতে পারত না?
আজ থেকে বহুবছর আগে, দেড়/দুইযুগ গত হয়েছে এরই মধ্যে, একটা গান শুনেছিলাম, অসহ আমাদের যৌবনে, সেই গানের একটা লাইন গুনগুন করছিলাম ফিরতে ফিরতে। সেই লাইনটা এই তো : “জানি না ঝুলনে আজো হয় কি না মিঠে কানাকানি / উত্তর আসবে না তুমি আসবেই আমি জানি” … কবীর সুমনের গান। তা, মিঠে কানাকানিরত কচি ছেলেমেয়েদেরে আড়ে-আড়ে খুঁজছিলাম। বাপচাচার শাসনচক্ষু এড়ায়ে প্রেমকামমোহিত করুণ সেই তরুণ প্রাণগুলোকে। একজনকে চোখে পড়ল, সে তার দুনিয়া-আন্ধার-করা আরেকজনকে আলগোছে চিপ্সের প্যাকেট এগিয়ে দিলো। ওদের বাপচাচার বয়সী হয়েও বিশেষ কিছু মনে করি নাই আমি। কিন্তু যে-মেয়েটা বাপের বাড়ি শেষবারের মতো ঝুলনরজনী উদযাপন করল, হয়তো নেক্সট শ্রাবণের আগেই বিয়াশাদি দিয়া দেবে তারে তার বাপভাই মিলে, কোন হার্মাদের হাতে যেয়ে পড়বে মেয়েটা ঠাকুর জানেন। পরের ঝুলনে যেন তার বাপভাইরা তারে নাইওর আনতে যায়, যেন দুপুরবেলার দুঃসহ স্মৃতিচিত্রিত রোদে মেয়েটারে করুণ সুরে গাইতে না হয় “কে যাস রে ভাটির গাঙ বাইয়া / আমার ভাইধনেরে কইও নাইওর নিতা আইয়া …
লেখা : মিল্টন মৃধা ।। স্থিরচিত্রসৌজন্য : পূজা শর্মা
[metaslider id=”6210″]
… …
- অন্তরঙ্গ কবিচিত্র - January 28, 2021
- সঞ্জীব চৌধুরী : জীবনতথ্য - November 19, 2019
- বাঁশি ও বিচ্ছেদী - November 16, 2019
COMMENTS