রোদ্দুর — কী ভীষণ মিষ্টি ভোরের বেলায়
রোদ্দুর — চোখে গেলেই কান্না পায়
রোদ্দুর — নদীর জলে জল যায় ঝলসে
রোদ্দুর — সারাজীবন আমার চাই
জন ডেনভার মারা যান বিমানপতনে। এই-তো অক্টোবর মাসেই, ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে, দেখতে-দেখতে গেল চলে বছর-পনেরো। চলে গেল কুড়ি কুড়ি বছরের পার। তখন, ওই যে-বছর ডেনভার মারা গেলেন প্লেনক্র্যাশ হয়ে, আমরা কেউ গণিত কেউ পদার্থ কেউ রসায়ন কেউ অর্থনীতি কেউ ইংরেজি কেউ বাংলা অধ্যয়ন করছিলাম সুউচ্চতর আর সবাই মিলে গাইছিলাম গানের-পর-গান। প্রচুর শো করে বেড়াচ্ছিলাম এখানে-ওখানে, এমসি কলেজের দিঘিপারে এ-ওর পিঠ-উরু চাপড়ে, ছাত্রাবাসের শ্রীকান্ত-হ্যলে গেস্টার্টিস্ট হয়ে, ভিসির বাংলোর উঁচু টিলার ঢালুতে চিৎ শুয়ে, মেসের কিচেন-ম্যাটেরিয়াল ইউজ করে, টিলাগড় পয়েন্টের চাদোকানগুলোর টেবিল বাজিয়ে, গাছতলায় ও নিত্য বৈকালিক জঙ্গল পরিভ্রমণকালে মুখে মুখে ইনস্ট্রুমেন্টাল এফেক্ট এনে, কলেজবাসের সিট থাপড়িয়ে এবং সর্বোপরি বাড়িতে গোসলঘরে পার্ফোর্ম করে বেড়াচ্ছিলাম অতিগাগনিক হার্ডরক। প্রচুর শো পাচ্ছিলামও তখন, লোকজন খুব সমুজদার হয়ে উঠেছিল আমাদের এন্টায়ার লাইফের ওই কয়েকটা বছরের একটা স্লট শুধু, পরে আমাদের ডিমান্ড পড়ে যায় এবং দল যায় ভেঙে। একের অধিক লোক হলেই হয়ে যেত কঞ্চার্তো, হয়ে যেত ডোভারলেন ম্যুজিক কনফারেন্স আমাদের। মাকসুদ-বাচ্চু-সুমন-নচিকেতা-অঞ্জন, মহীনের ঘোড়া আর চন্দ্রবিন্দু, দুই বব যথাক্রমে ডিলান ও মার্লে এবং অবিসংবাদিত জন ডেনভার। সংক্ষেপে এ-ই আমার, আমাদের, মিউজিক্যাল ক্যারিয়ারের একটা অ্যাট-অ্যা-গ্ল্যান্স গ্র্যাফ।
২
জানালা ভরতি আলো! ঝলমল জরির মতো আলো। চোখে-মুখে-মনে এবং সমগ্র শরীরে এসে ঝাঁপায়ে পড়ছে মুহুর্মুহু অনাবিল আলো ও তার সফেন ঊর্মিমালা। এ এমন আলো, রোদ্দুরের হৃদয়ের মোম ও কুসুম দিয়ে যেন গড়া তার তরঙ্গগুচ্ছ, রোদ রয়েছে এ-আলোতে রোদ্দুরের ঝাঁঝ নেই মোটে। কেবল আলো, শুধুই আলো, আদি ও আসল আলো, মোমের মতো নরম ও শুভ্র-সফেদ বিশুদ্ধ আলো। রৌদ্রতেজে রণরঙ্গিনী আলো নয় এ, এ নয় ছায়ার আশ্রয়ে আচ্ছাদিতা স্যাঁতস্যাঁতা আলো। অনুত্তেজ, স্নিগ্ধ, পরিচিতা নারীটির ন্যায় চিরদরদিয়া, মায়াজাগানো। সকালের আলো, আলোর সকাল, ফুরফুরে থরোথরো। দ্যাখো এই হয় হেমন্তসকাল। আর এই দ্যাখো হেমন্তসকালের আলো। শোনো কলস্বর শিশুদের রক্-ন্-রল্। কলকলিয়ে বেরোচ্ছে হেমন্তফুর্তি শিশুদের জুতো-ঝুমঝুম আর জামা-ঝামঝাম থেকে। এই দ্যাখো শৈশব আমার, দ্যাখো আমার ভ্রাতৃষ্পুত্রীর খিলখিল থেকে একথোকা রাধাচূড়া ছড়িয়ে পড়ল ঘরে ও উঠোনে! দ্যাখো ছোটবোনের গটগটানো-ভঙ্গিমায় দৃপ্ত চলার ভেতর আমার তরুণ দিনগুলো হরিণের ন্যায় ঘাই দিয়ে উঠছে-নামছে, দ্যাখো ছোটভাইয়ের বন্ধুসৌহার্দ্য ও বারো-ইয়ারি গুলতানির ভেতর থেকে জিরাফের মতো গলা উঁচাচ্ছে যৌবন আমার! দ্যাখো আমার একটুও জরা নাই আজ আর! দ্যাখো আমি মৃগেল মাছের কায়দায় কেমন জলসাবলীল লিখছি হৃদয়সংবাদ এই! দ্যাখো আমি আবার সৃজনস্বাপ্নিক সেই তীব্র কত-কী-করতে-এসেছি-ভবে হেন উদ্যমে প্রথম-লিখতে-ব্রতী দিনগুলোর মতো অদম্য-অবধ্য! শোনো, অয়ি ভদ্রে, অটম-স্যোনাটা আমার!
৩
সারাজীবন যে-মানুষটা আচ্ছন্ন ছিল উঁচা উঁচা পাহাড়, ঘন বনভূমি, উপত্যকা-গিরিখাত আর গাঙ-সমুদ্রের প্রেমে, মুখর ছিল কলোরাডো-মন্টানা পার্বত্য অঞ্চলের প্রকৃতিনিসর্গের প্রণয়গানে, সেই কান্ট্রিবয় যে মনে করত লাইফ ইজ নাথিং বাট অ্যা ফানি রিডল এবং বলত থ্যাঙ্ক গড আ’য়্যাম অ্যা কান্ট্রিবয়, তার দেহাবশেষ ছড়িয়ে রয়েছে কোনো-এক পর্বতারণ্যের নিঝুম অঞ্চল জুড়ে, ক্যুল্-ন্-গ্রিন-ন্-শেইডি মাউন্টেনসাইড ব্যেপে, এরচেয়ে ম্যাগ্নিফিসেন্ট আর কী হতে পারে! ডেনভারের আত্মা এরচেয়ে ভিন্ন কোনো মরণোত্তর উপায়ে কী ব্যবস্থায় শান্তি পেত বলে মনে হয় না। তাঁর মৃত্যুসংবাদ তখনকার বাংলা দৈনিকগুলোতে বেশ সসম্মান ছাপা হয়েছিল, ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেরি উপকূলের কাছাকাছি একটা জায়গায় ব্যক্তিগত সেস্না বিমান উড়োকালে ১২ অক্টোবর দুর্ঘটনাটা ঘটে এবং স্পটেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ডেনভারের শরীর, ওইদিনের পত্রিকাবাহিত সমস্ত নিউজ ও ভিউজ আমি প্রিজার্ভ করে রেখেছিলাম। খুঁজলে এখনো ওই স্মৃতিপ্রিজার্ভিং বাকশোখানা বার করতে পারব। তখন তো কল্পনাতেও ছিল না আজকের হেন প্রযুক্তিস্ফীতি, চিন্তাও করিনিকো এমনধরনে অ্যাপ্সযুগ সম্ভবিবে কভু, ফলে তেন পত্রিকাকাটিং জমানো। তৎক্ষণাৎ যে বিপুলা বিষাদের আর হাহাকারের অনুভূতি আমার হয়েছিল, জগৎ ফুঁড়ে মনখারাপের যে-স্তম্ভ উঠেছিল, মনে করতে পারি ক্লিয়ার্লি আজও। মনে হয়েছিল, মানে আমি ভেবেছিলাম, মানুষ তবে মনপ্রাণ ঢেলে কিছু-একটা চাইলে পরে সেইটা পায়ই পায়! মানুষের প্রাণজ আকাঙ্ক্ষা অপূরণ থাকে না তাহলে! ডেনভারের লেখা, সুর-করা ও গাওয়া গানের মুগ্ধমগ্ন শ্রোতাপ্রেমিক আমরা অনেকেই। তার গানে ঘুরেফিরে আসে এই বিমান, ঈগল, ওড়ার আকাশ আর উপর থেকে তাকিয়ে দেখা পাথুরে এলাকার বনভূমি-গিরি ও উপত্যকা-অধিত্যকার গহনতা। আমরা তার গান শুনতে শুনতেই টিলা-পাহাড় দেখামাত্র সমতলে শুয়ে শুয়ে সেই টিলা ও পাহাড়ের টপ-অ্যাঙ্গেল শট ক্যাপ্চার করার কৌশল শিখে ফেলি। সেই থেকেই শুরু চোখে-দেখা সমস্তকিছুর একটা প্যানোরামিক ভিয়্যু সংগ্রহণের। আমরা থাকতাম টিলা আর ক্ষীণস্রোতা খালের ন্যায় টলমলে জলের চ্যানেলবেষ্টিত এলাকায়, যে-জলচ্যানেলগুলোর লোক্যাল নেইম ছড়া। নার্সারিরাইমের মতোই মিষ্টি, টুইঙ্কল-টুইঙ্কল বালিচিকচিকে স্বচ্ছতোয়া জলাশয়, সেই কারণেই বিশেষ এই জলপ্রবাহ লোক্যাল লোকের কাছে ছড়া ডাকনামে আদর কুড়িয়ে আসছে আবহমান। হয়তো।
৪
কী সুন্দর সমস্ত অ্যালবামের নাম! ‘রাইমস অ্যান্ড্ রিজনস’ দিয়া তার ডেব্যু, পরে একে একে অনেক, চমৎকার শিরোনামসম্বলিত অ্যালবামগুলোর মধ্যে মেনশন করা যায় যেমন ‘পোয়েমস, প্রেয়ার্স অ্যান্ড্ প্রোমিজেস’, ‘ফেয়ারোয়েল অ্যান্ড্রোমিডা’, ‘সিজনস অফ দি হার্ট’, ‘অটোগ্র্যাফ’, ‘ক্রিসমাস, লাইক অ্যা লালাবাই’, ‘ড্রিমল্যান্ড এক্সপ্রেস’, ‘উইন্ডসং’, ‘দ্য ফ্লাওয়ার দ্যাট শ্যাটার্ড দ্য স্টোন’ প্রভৃতি। ডেনভার যখন অলমোস্ট হ্যাভেন স্বরে গাইতে শুরু করেন ‘কান্ট্রিরোডস টেইক মি হোম টু দ্য প্লেইস আই বিলোং’, পূর্বভার্জিনিয়া এলাকার সেই আঁকাবাঁকা পাথুরে-খর পথগুলো ও পথিপার্শ্বের দাবাগ্নিদগ্ধ ঘাসপাতাগুলোর গন্ধ নাকে এসে ঝাপ্টা মারে, সেই খনিশ্রমিকের গিন্নি, সেই শেনাঁডোয়া নদী আর নীলপ্রান্তরেখার পর্বত, সেই বৃক্ষপ্রাচীন কিন্তু পর্বতনতুন আবহমান জীবনের ঢেউ এসে দোলা দেয় আমাদেরও দেহে। এই একটা গান আমার বয়সী মানুষগুলোর জীবনবিকাশে, আমার ধারণা, সাংঘাতিকভাবে কন্ট্রিবিউশন রেখে চলেছে। একেকটা গানের সুর জড়িয়েমুড়িয়ে থাকে আমাদের জীবনের সঙ্গে। ডেনভার যখন গান করেন, অন্তঃশীলা চারণভূমি আর জলাশয়ের ঝিরিঝিরি বাতাসপ্রবাহ সম্প্রচারিত হয়, ঘিরে থাকে ছেলেবেলা আর দাদিমার গায়ের ঘ্রাণ। কী আকুতি! কী মিষ্টি হাহাকার আর মরমিয়ানা! তার একটা ব্যক্তিগত সেস্না আকাশযান ছিল, যেইটায় চেপে তিনি উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াতেন আকাশপরিধি জুড়ে, পাহাড় দেখতেন উঁকি দিয়ে নিচের ধরণীর, দেখতেন অরণ্যরাজি। বিমানবলাকা চালিয়ে শো করতে যেতেন কন্সার্টে। প্যাশনেইট অ্যাভিয়েটর ছিলেন, গানের ব্যস্ততার কারণে ওড়াউড়ি দ্বিতীয় অবস্থানে রাখতে হয় তাকে। একটা নয়, বস্তুত তার ছিল একাধিক উড়োজাহাজ, ছিলেন তিনি ভিন্টেজ উড়োযান সংগ্রাহক ও চালক। অসম্ভব ওড়ার সাধ নিয়ে তেপ্পান্ন বছর কাটিয়েছেন এই ধুলার সংসারে। সেইসব উড়ালপ্রসঙ্গ ছোপছোপ রঙ ঢেলেছে তার গানের লিরিকে। একদিন সকালে উড়তে বেরিয়ে খান-খান হয়ে ছড়িয়ে পড়েন বনভূমে, উপত্যকায়, অরণ্যমাঝারে। একটা গান খুব মেস্মেরাইজিং মনে হয় : ‘লিইভিং অন অ্যা জেটপ্লেন’ গানটা। আর ডেনভারের গানে কত-না বিচিত্রভাবে এসেছে, ঘুরেফিরে বারেবারে এসেছে, সেই চিরকেলে শুভেচ্ছা ও বিদায়দোয়ার অনুষঙ্গ! ওকে আটকাও, ওকে যেতে দিও না চলে, অ্যানি প্রিয়তমা! তাহার সকল গান তোমারেই তো লক্ষ্য করে লেখা। আহা কী-যে প্রেমমোহিত সেই উচ্চারণ : চলে যাচ্ছি উড়ে জাহাজে চড়ে না-ফেরার বন্দরে …! ও বেইব, আই হেইট টু গ্য, যেতে নাহি চাহি আমি, ঘৃণা করি চলে যেতে ছেড়ে একেবারে … কিন্তু অলরেডি আ’য়্যাম সো লোনস্যম আই কুড ডাই …
৫
হৈমন্তী সকালের আলো। তো কী! হৃদয় আমার ময়ূরের ন্যায় নাচিতে চাইছে নাকি? জ্বি না, তেমন অনুভূতি হচ্ছে না যদিও, কিন্তু এই আলো এই বর্ণিত রোদ্দুর এই সকাল ভালো লাগছে। এই তাপানুকূল সকালে এসে ভালো লাগছে, এই বিভাপূর্ণ সকাল পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরে ভালো লাগছে। এই শীতপূর্ব সকাল অব্দি আয়ু পেয়ে, এইখানে এই গানের ঝরনাতলার নির্জনে নোঙর করতে পেরে, এই চিরনবীনা পৃথিবীকে কাছে পেয়ে, এই জীবিকালাঞ্ছিত গুহার আঁধারে সহসা প্রভাতপাখির সুর পশিলে, এই নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গপ্রত্যুষে, এই দীর্ণ দিনানুদৈনিক রিয়্যালিটিতে সেদিনের সেই তরুণ রবীন্দ্রনাথের মতো খুব ভালো চমৎকার লাগছে আমার। ক্যুল অ্যান্ড কাম অ্যান্ড ফ্যাব্যুলাস! বহুদিন বাদে ডেনভারের রোদ্দুরপ্রভাত জরিপ করে যারপরনাই ভালো লাগছে। বেশ লাগছে। হ্যাঁ! এই অন্যরকম ও অপরূপ সবুজ-ছুঁয়ে-আসা আরামপ্রদেতা আলোটার উৎস বুঝতে পেরেছি শেষে এতক্ষণে। এটা-না আসন্ন শীতের আগমনী, সুপর্ণা ঋতুর আবাহনধ্বনি, শীতবার্তা! বাংলার সানশাইন তো শীতকাল, যখন স্যুয়েটার আমাদেরে দেয় প্রজাপতিনিঃশ্বাসের ওম, যখন কমলালেবুরোদ্দুরে মেলে দেই আমরা আমাদের যাবতীয় জখম, যখন আমাদের শোল্ডার থেকে ঝুরঝুর ঝরে রাশি রাশি শুভেচ্ছারাঙা ঘাসফড়িঙের পাখা। আর এ হচ্ছে হেমন্তপ্রাতের আলো। সুরতে-চেহারায় এ তো অন্যরকম হবেই। এই হেমন্তে তো সমস্ততেই মিটমিটে তারার ন্যায় আলো ও ছায়ার ছিটা থাকবে। এর আলো অঝোর বৃষ্টির ন্যায় মায়াচ্ছন্ন তো হবেই। এর সকাল এর দুপুর হবেই তো সুশ্রীস্মিতা। জামদানিঝিলিমিলি দিন। ডেনভারের গানের মতো সুরেলা আলোর শীত ক্রমশ এগিয়ে আসছে এবার, আসিছেন ক্রমে তিনি, শীত মহোদয়া। তাই তো অমন হৃদি-আনচান আলো, তাই তো অমন কোমল রৌদ্রপদ্ম দুপুর। তাই তো আমি দিনভর শুনছি, গুনগুনাচ্ছি, প্রিয় কৈশোর অন-জন — ডেনভার জন ও দত্ত অঞ্জন — উদযাপন করছি জীবনের অমল-ধবল পালে মন্দমধুর হাওয়ালাগা সেই দিনগুলো …
৬
তরুণাস্থির সেই দিনরাতগুলোতে ডেনভার শুনছিলাম জুঁইস্নিগ্ধা পার্শ্ববর্তিণীর জিম্মায় হৃৎপিণ্ড জমা রেখে, সেই বিশ্বাস ও অতর্কিত বনবিষাদে বিপন্ন হয়ে-ওঠার দুর্বহ অপরাহ্নগুলোতে, সেই সময়টা লাস্ট মিলেনিয়ামের ঊনিশশ অন্তিম দশক। মরছি নিজের জ্বালায়, একটু-একটু বঙ্গজ পপম্যুজিক আর অনেকখানি ইংরেজি ডিলান-মার্লে-ডেনভার-হেন্ড্রিক্স-জোয়ানবায়েজ সঙ্গে নিয়ে, হেনকালে উদিলা ফাল-হয়ে-বেরোবার-জন্য সূচতুল্য সুমন ও অঞ্জন এবং সঙ্গীসাথী নানাবিধ নতুন বাংলাগান। অচিরেই নিয়েছি মেনে, এ-জীবনে আমলাডাক্তারমোক্তারচোরাকারবার হওয়া হচ্ছে না আর, কেউ কেউ তখন গর্বাচেভ ও ইয়েল্তসিনের পিণ্ডি চটকে রেভোল্যুশনারি চিন্তাভাবনাও শুরু করে দিয়েছি আমাদের মধ্যে। এঁচোড়ে পেকে গেলে এমন হয় কি না, তা যা বলেছেন খালা! হ্যাঁ, যা বলছিলাম। সুমন ও অঞ্জন রয়ে গেলেন সিনার ভিতর, রোদের ভিতরের রোদ হয়ে ওম দিয়ে যেতে থাকলেন আমাদের বুকের ভিটায়। ছিন্নপঙক্তিটা অবশ্য জেমসের গানের, সে-তো আরেক লণ্ডভণ্ড কাহিনি, কিন্তু স্যম-আদার-ডে এই চিঠির লেফাফা খোলা যাবে। যে-কারণে ডেনভার ও ডিলান রয়ে গেলেন আমার সঙ্গে, এই বিফলা আমার এ-বয়সে সমস্ত থিতিয়ে আসার পরে, একই কারণে সুমন ও অঞ্জন রয়ে গেলেন বুকপকেটে এবং ঠোঁটে ও গলায় হৃদয়ে। একসময়, একদম পয়লাপত্থম, অঞ্জন নিয়ে জোর ঝগড়া হতো বন্ধুবৃত্তে। ডেনভার এবং অন্যান্য আংরেজি কান্ট্রিসিঙ্গারের কপি বলে অঞ্জনকে রিবিউক করত আমাদের বন্ধুদের কেউ কেউ, কিন্তু ম্যারিয়্যান-স্যামসন-জেরেমি-মিস্টারহ্যল না-গাইলে তো সন্ধ্যাও নামত না, অচিরে এইটা বুঝে ফেলি যে এসব ইনডিড অঞ্জনকে অপবাদ দেয়া ছাড়া শার্প কোনো ক্রিটিক নয়। এইটা আলবৎ মিছা না যে, অঞ্জনের সাউন্ডট্রেক ও টিউনফর্ম্যাট ওয়েস্টার্ন এবং মূলত ইন্সপায়ার্ড বাই ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিমিউজিক। কিন্তু সেগুলো বাংলাগান হয়েছে, বেফায়দা বাণীচিত্রের বুজরুকি নয়, এতে ডাউট অল্প। মৌলিকত্বলোলুপদের কাছে কাঠগোলা বা মাটিঢেলা হলেও নো-প্রব, শুধু মৌলিক হইতে হইবে, ব্বাস, খালি অরিজিন্যাল হো-না চাহিয়ে। নিজে বেজে উঠলাম কি না, বাজাতে পারল কি পারল-না গানটা বা কবিতাটা আমাকে, সেই বিবেচনা কে-আর করে। সেদিকটা আন্ডার-কন্সিডারেশনে রেখে কেউ যদি রিওয়াইন্ড করে অঞ্জন, অন্তত আমার সময়ের কেউ, তো তার পুরা জিন্দেগানির মধ্যে প্ল্যাটিনাম দিনগুলো তথা তার কৈশোর-তরুণসুর সে এক্সটেইসি নিয়ে সেলেব্রেইট করে উঠবে। ডেনভার ও অঞ্জন পাশাপাশি পরপর শুনে যেতে আমার কখনো অস্বস্তি-অনারাম হয় নাই। টু বি অনেস্ট, রোলিংস্টোনস্ বা আরও অন্যান্য রক্-ন্-রল্ কি আরএন্ডবি কি হিলিবিলি জ্যাজ-ব্লুজ পাঙ্ক-সাইকেডেলিক শুনে এবং প্রভূত উপভোগ করে শেষে ইংলিশে ডেনভার ও ডিলান যেমন রয়ে যান আমাদের আড্ডায় রিন্যুয়েবল সোলার এনার্জি হয়ে, বাংলায় তেমনি সুমন ও অঞ্জন। সুমন হইলেন কবি, যেমন ডিলান, কবিতার সিগ্ন্যাল ট্রান্সমিট করেন তারা গানে গানে। তেমনি অঞ্জন ছোটগাল্পিক, ডেনভারও তা-ই। চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয় কত কত অঞ্জনের-ডেনভারের গান শুনে, সেই ব্যথাও সর্ট-অফ হিলিং এফেক্ট জেনারেইট করে। একটা-দুইটা শব্দে ক্যারেক্টার ভিশ্যুয়ালাইজ করা অঞ্জনের, অ্যাজ ওয়েল অ্যাজ ডেনভারের, বিশিষ্ট পরিচয়চিহ্ন। গল্পে গল্পে এগিয়ে চলেন অঞ্জন, ডেনভারও। একজন বলেন দার্জিলিঙের, অন্যজন কলোরাডো ও তৎপার্শ্ববর্তী ভার্জিনিয়া-আলাস্কা টেরিটোরির গল্প। অন্যদিকে সুমন-ডিলান অনুচ্চ স্বরে ফোড়ন কাটলেও সেইটা বারুদ, আরডিএক্স, লোকালয়ের মানুষ সেই এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার করে বহিরাক্রমণ থেকে নিজেদেরে রক্ষাকল্পে। ডেনভার তো শুনছিলাম সুরসংশ্রয়ে গ্রেফতার হয়ে, সেইভাবে তখন লিরিক্যাল ভ্যালু খোঁজতামও না, সুরমোহিত হলেই তবে শুনতাম সেই গান। কত আর বয়স, বলো! তখন কৈশোরোত্তীর্ণ সদ্য। পয়লা তারুণ্য। অঞ্জন এলেন। শুরু হলো কৈশোর রোমন্থন। সেই যে শুরু হলো কুক্ষণে, এরপর আর থামাথামি নাই, একসময় দেখি হয়ে উঠেছি জীবজগতে ইনটল্যারেবল রোমন্থনরাক্ষস! অঞ্জনে, এবং ডেনভারে, সেলেব্রেইট করি আমরা আমাদের কাকাতুয়া কৈশোর। আর, ডিলানের গানের মতো, ‘টু বি অন মাই ঔন / কমপ্লিট আননৌন / লাইক অ্যা রোলিং স্টোন’ আমরা বাইছিলাম ঝিলমিল-ঝিলমিল ময়ূরপঙ্খিনাও সময়দরিয়ায়।
৭
ইয়ত্তা নাই অ্যায়সা প্রাচুর্যের গান শোনা হলো এ-জীবনে, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে অনন্ত নক্ষত্রবীথি, হে লোচনদাস কারিগর, হে উমাচরণ কর্মকার, হে হাজরে-আসোয়াদ, হে হাওজে-কাওসার, হে গেইটফুল, হে গেহজোড়া মানিপ্ল্যান্ট, হে অর্শ-গেজ-ভগন্দর, হে মঘা-ইউনানি শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, হে কলেজরোডের টঙপ্রোপ্রাইটর টপফেব্রিট মামু! সুভা হো গায়ি রে মামু, মুন্নাভাই এমবিবিএস, শুনতে শুনতে গানাবাজানা। গান শুনতে শুনতে … গান শুনতে শুনতে … গান শুনতে শুনতে … ঘনালো সন্ধ্যা। পাটে বসলেন সূর্যদেব, জীবনের। গান শুনে শুনে গেল চলে একটা লাইফ। গাওয়া আর হলো না আমার। ও আল্লা, নামাজ আমার হইল না আদায়। এবং সেই ওয়াইল্ডার্নেস, অফ মাই লস্ট ডেইজ, বুনো অর্গ্যানিক সেই ডেনভার দিনগুলো, অ্যাক্যুস্টিক বাদ্যমত্ততার সেই নিবিড় নাচানাচির দিনগুলো সম্বল। এই জেলখানার সম্বল তো ওই গানগুলোই, থালাবাটিকম্বল তো ওই গানগুলোই, এছাড়া অন্যকিছুই তো সঞ্চয়যোগ্য নয় এখানে। কেবল সকাল আর সন্ধ্যায় দুইটি রুটির জন্য সশ্রম ভুগছি, ও আমার মুজিব পরদেশী, ইঁদারা পাহারা দিচ্ছি দিবারাত একপায়ে খাড়া। মা গো, ওগো স্যুইটহার্ট মধুহৃদিকা, আমি বন্দী কারাগারে … মা…আ…আ… প্রেমিকা! না-হলে তো গরাদের ভেতর ডাণ্ডাবেড়ি ‘শিকলপরা ছল মোদের এই’ গাহিতাম সমস্বরে। খেউড় গাইতাম মাঝেমধ্যে আর রহিতাম ব্যোমভোলানাথ হয়ে। এই কয়েদখানায় ডেনভার না-থাকলে, অঞ্জন না-থাকলে, সুমন না-থাকলে, গৌতম চ্যাটার্জি না-থাকলে, ডিলান ও মার্লে না-থাকলে, মিক জ্যাগার আর ক্লিফ রিচার্ড না-থাকলে, ল্যুসি ইন দ্য স্কাই আর সেই ড্রিমার জন লেনন না-থাকলে, মাকসুদ না-থাকলে, বাবনা আর কমল আর ওয়ারফেজ না-থাকলে, জিম মরিসন আর মাহফুজ আনাম জেমস আর মার্ক নফলার না-থাকলে, লেড জেপ্লিন আর পিঙ্ক ফ্লয়েড আর নির্ভানা না-থাকলে কেমন করে কাটাইতে হে এই যাবজ্জীবন! ইম্যাজিন অ্যা ওয়ার্ল্ড যেইখানে এরা নাই — ইম্যাজিন অ্যা হ্যাভেন অ্যান্ড হ্যেল যেইখানে এরা আছে — ক্যান য়্যু!
৮
জন ডেনভারের কোন গানটা সবচেয়ে বেশি শুনেছি-গেয়েছি ফিরে ফিরে, এবং আজও রোজগারগৃহের ঘানি টেনে গ্লানিক্লিণ্ন পড়ন্ত দুপুরে ছাদে যেয়ে চুরট ফুঁকে আসার টুকরো-অবকাশে প্রায়শ যে-গানটা গাই, সেই গানের কথাটা একবার স্মরণ করা যেতে পারে। অ্যানির গানটা তো সর্ববঙ্গীয় অ্যান্থেম — তোমার হাসিদিঘিতে ডুবতে দাও আমায়, ওগো, মরিবারে দাও তোমার ওই বাহুভূজে — গেয়েছি তো বহুকাল, হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চাই না আর। খুব হেঁড়ে গলায় বৃন্দপরিবেশন করেছি যে-গানগুলো, তন্মধ্যে একটা ‘ড্যান্সিং উইথ দ্য উইন্ড’ — ইফ য়্যুর হার্ট হ্যাজ ফাউন্ড সাম এম্পটি স্পেইসেস, ড্যান্সিং’স জাস্ট দ্য থিং টু মেইক য়্যু হোল … ইত্যাদি লাইনওয়ালা — আরেকটা যেমন ‘সাম ডেইজ আর ডায়মন্ড, সাম ডেইজ আর স্টোন’ গানটা। তারস্বরে গেয়েছি ‘রকি মাউন্টেন হাই’, যেখানে এমন লাইন রিফ্রেনের মতো ঘুরায়েফেরায়ে গেয়েছি : “আই হ্যাভ সিন ইট রেইনিং ফায়ার ইন দ্য স্কাই’, জানি আমি সেই লোক হতদরিদ্র যে ‘নেভার স্য অ্যান ঈগল ফ্লাই’…। একলা বাড়িফেরার রাস্তায় আজও গাই ক্ষীণ তৃণফড়িঙের স্বর লাগিয়ে ‘ফলো মি’ গানখানি — কী দুর্বিষহ কঠিনই-না ছিল দিনগুলো ‘টু বি সো ইন ল্যভ উইথ য়্যু অ্যান্ড সো অ্যালোন’! মনে পড়বে, এ ছিল সেই বয়স আমাদের, দেখা হলেই একা হয়ে যেতাম যখন। অথবা দাদিমা উপজীব্য করে লেখা ডেনভারস্যংগুলো আমাদের কাছে ছিল পার্টিস্যং, ক্যালিপ্সো ও ম্যারি-গ্য-রাউন্ড দুলকি-চালের গানগুলো তো ছিলই। বিষাদ-উদাস ও উদ্ভাসনের আরেকটা গান — ব্যালাড ফর্মের, ডুয়েট উইথ অ্যা ফিমেল সিঙ্গার, ওপেরা গানের সোপ্রানো ও ব্যারিটোন ভয়েস লাগিয়ে গাওয়া — “পারহ্যাপ্স ল্যভ ইজ লাইক দ্য ওশ্যান, ফ্যুল অফ কনফ্লিক্ট, ফ্যুল অফ চেইঞ্জ … ইফ আই শ্যুড লিভ ফরেভার অ্যান্ড অল মাই ড্রিমস কাম ট্রু, মাই মেমোরিজ অফ ল্যভ উইল বি অফ য়্যু”…। অথবা ‘সিজন অফ দ্য হার্ট’ গানটাও তো, যদ্দুর মনে পড়ে, এই ধারারই। কিংবা ‘শ্যাংহাই ব্রিজেস’ গানটাই ধরা যাক, অজস্র গুঞ্জরিয়া তুলেছে একদিন এই লাইনগুলো ও তাতে লতানো সুরধুন আমাদিগেরে : “অ্যান্ড য়্যুর ল্যভ ইন মাই লাইফ ইজ লাইক হ্যাভেন টু মি, লাইক দ্য ব্রিজেস হিয়ার ইন ওল্ড শ্যাংহাই”…। নিজের জন্মভিটা অ্যাস্পেন পুনরাবৃত্ত হয়েছে লিরিকের পর লিরিকে, এমন একটা — ‘আস্পেনগ্লো’ — “সি দ্য সানলাইট থ্রু দ্য পাইন, টেইস্ট দ্য ওয়ার্ম অফ উইন্টার ওয়াইন” … ইত্যাদি। জিভে টের পাই শীতভোরে সদ্য-নামানো খর্জুররসের তীক্ষ্ণ-তাতানো চনমন ফুর্তি। ইংরেজি গানে যে-ব্যাপারটা আমরা আগ্রাসী গিলতাম, তা হলো গানের ভেতরের অন্ত্যমিল-মধ্যমিল আর অনুপ্রাস ইত্যাদি দৃষ্টিগ্রাহ্য কারিকুরি, ডেনভারে এসব প্রভূত পেয়েছি। বিস্মৃত হইনি প্যারাগ্র্যাফের শুরুর কোয়েস্ট, ইয়াপ, বলছি এবে। সেই গানটা হলো ‘ওল্ড মন্টানা স্কাই’। যদিও ‘রকি মাউন্টেন হাই’ গানটাই ডেনভারের অ্যান্থেম হিশেবে মশহুর, কিন্তু আমার ধারণা ‘ওল্ড মন্টানা স্কাই’ তার অটোবায়োগ্র্যাফিক সেল্ফ-স্ট্যাটমেন্ট হিশেবে টপমোস্ট। শুধু জন ডেনভার নন, যারাই আমরা খানিকটা অ্যালিয়েনেশনে ভুগি, টু স্যম এক্সটেন্ট আমরা যারা আউটসাইডার ইন আওয়ার প্লেইসেস অ্যান্ড এভরিহোয়ার, তাদের কাছে এই গান গোপন গরিমার, অ্যাট দ্য সেইম টাইম হামদর্দের বলারিষ্ট দাওয়াই। কী স্ট্রেইঞ্জ যে, ডেনভার তিরোধানের পর এই গান আমাদের কারো কারো কাছে মৃত্যুপূর্বকালে-কল্পিত শিল্পীর মৃত্যুবিবৃতিদৃশ্য বলেই প্রতিভাত হয়েছিল! হয় এইরকম, অনেকেরই ক্ষেত্রে, দেখেছি তো, সঞ্জীব চৌধুরীর মৃত্যুর অব্যবহিত মাসখানেক পূর্বে রিলিজ-পাওয়া অ্যালবাম ভরে কেবল মৃত্যুচিন্তা আর অ্যাডিয়্যুটোনের গানই গেয়েছেন — “যখন যেখানে নোঙর ফেলেছি সবাইকে আজ আড়ি” … ইত্যাদি।
৯
ভীষণ নয়, একটু নিষ্প্রভ ও নরম রোদ ছিল দিনভর। সঙ্গে একটু-একটু তুষারপাতের ন্যায় বৃষ্টিনৃত্য সহসা। কার্তিকের রোদ। চুপিচুপি, নিরিবিলি, মিষ্টি। জীবনানন্দে এই উচ্চারণ অনবদ্য : হাতে হাত ধরে ধরে / গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঘুরে / কার্তিকের মিঠে রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে…। স্মৃতি থেকে উৎকলিত, ফলে একশ ভাগ প্রামাণ্য না-ও হতে পারে পঙক্তিগুলো। তবে সুরটুকু ওইরকমই নিশ্চিত। কার্তিকের চিত্র জীবনানন্দে অবিরল ও অনবদ্য পাওয়া যায়। হেমন্ত ও শীত — প্রধানত — দুইটি ঋতুর দ্বারা আচ্ছন্ন জীবন দাশের সমগ্র কবিতাকাজের জগৎমণ্ডল। তথ্য হিশেবে এইটা আমরা সকলেই অবহিত। কথা হচ্ছে, এই নিবন্ধ ড্রাফ্টকালীন, সমস্তদিন রোদের নরম আভা দেখতে দেখতে জীবনের ওই পঙক্তিগুলো পড়ছিল মনে। এবং মনে পড়ছিল ডেনভারের কান্ট্রিস্যংস : সানশাইন অন মাই শোল্ডার্স মেইকস মি হ্যাপি / সানশাইন অলমোস্ট অলোয়েজ মেইক্স মি হাই…। ডেনভারের আরও কত-শত উচ্চারণ, সেসবের থেকে একটা : ল্যভ ইজ হোয়াই আই কেইম হিয়ার ইন দ্য ফার্স্ট প্লেইস / ল্যভ ইজ নাও দ্য রিজন আই মাস্ট গ্য…। অসাধারণ প্রেমোচ্চারণ! প্রথম-প্রেমে-পড়া মানুষের হৃদয়ের এই নিচুস্বর অসহায় উচ্চারণ, প্রথম-প্রেমে-ব্যর্থ প্রেমিকের রাজ্যপাট-ত্যাজিবার-মতো ঔদার্য্য — ল্যভ ইজ নাও দ্য রিজন আই মাস্ট গ্য…! প্রণয়ের তরে আমি এসেছিনু তব দ্বারে, দেবী হে, এইখানে, এই মানবজনমে, এই ধুলো ও শঠতাশাসনের সংসারে, এসেছিনু, ওগো, ভালোবাসিবারে…! ফের যদি যেতেই হয় চলে, ফের যদি ফিরে না আসি আর, জেনো সবই সেই একই কারণে। ক্যাওয়াজ করে কি হবে বলো, তোমার সনে হে বসুধা, খামাখা-খামাখা? যাব আমি, চিরকাল, ফের যদি ফিরি তবে ফিরিব আবার, একই সেই ভালোবাসিবারে। এই যাওয়া, এই ফেরা, এই চির-না-ফেরা, ভালোবাসারই সম্মানে হে! ভালোবেসে, একটুকু ভালোবেসে, বলো যদি ফিরে যেতে, ফিরে যাব। ওষ্ঠে অঙ্গুরীয় ছোঁব, সুনীল নিভৃত, মরে যাব সহাস্য বিষপান করে। সেস্না উড়োযানের উইন্ডো জুড়ে ওই তো তোমার মুখ, মহাজাগতিক মমতা আর নির্মমতায় নিরুপম সুন্দর মুরতি তোমার, সুবিশাল বিপুল সুরের-অসাধ্য বেদনা! আমারে বাঁচাতে পারে, ফের পারে বধিতে, একই জিনিশের অভিন্ন উৎসারণ — ভালোবাসা।
১০
অনেক সুরের গান লিখে গান গেয়ে মরে গেল জন। মরে গেল সুর ছড়িয়ে, ভালোবেসে, বিমানপতনে। এ যেন ওই জীবনানন্দের কবিতালাইন মনে পড়িয়ে দেবার জন্য — মনে পড়ে, অবধারিত মনে পড়ে, ডেনভারের বছর-চল্লিশ আগে দৃশ্যান্তরালে-চলে-যাওয়া জীবনেরও আয়ুসীমা অলমোস্ট ইক্যুয়াল টু স্যংরাইটার-সিঙ্গার জন — অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেল জন দাশ ও জীবন ডেনভার যতসব বধির নিশ্চল সোনার পিত্তলমূর্তিদের কানে, চেয়ে থেকে একাধারে বেদনার ও নক্ষত্রের পানে। এই পৃথিবীর পথে পথে, এই পৃথিবীকে একটু নতুন ও যথাবহমান যৌবনা করে রেখে যেতে, এইসব বোকাসোকা জীবন ও ডেনভারের দল! অন্তত চৌষট্টি বছর তো বাঁচতে পারত সে! বেচারা ডেনভার! গান গেয়েছিল চৌষট্টি বছরের বুড়ো হবার পর তার কি কি আকাঙ্ক্ষা তা নিয়া। “হোয়েন আই গেট ওল্ডার, ল্যুজিং মাই হেয়ার, ম্যানি ইয়ার্স ফ্রম নাউ, উইল য়্যু স্টিল বি সেন্ডিং মি অ্যা ভ্যালেন্টাইন, বার্থডে গ্রিটিংস বটল অফ ওয়াইন?” বলেছিল, সুরে সুরে, প্রণয়িনীটিকে। এবং বলেছিল, একই গানে, এই কথাগুলোও : “উইল য়্যু স্টিল নিড মি, উইল য়্যু স্টিল ফিড মি, হোয়েন আ’য়্যাম সিক্সটি-ফোর?” যদিও গানটা ডেনভারের নিজের নয়, বিটলসের, জন লেননের, ডেনভার কাভার ভার্শন করেছিল একটা অ্যালবামে, লেননের চেয়েও জন ডেনভার ভার্শন উপভোগ্য মনে হতে পারে কারো কারো। কুল্লে তেপ্পান্ন হতে-না-হতেই নিয়ে নিলো অগস্ত্যযাত্রার পথ। কোনোদিন ফিরিবে না আর, কোনোদিন লিখবে না গান, কোনোদিন খুঁটবে না গিটারের রিফ! কোনোদিন, কোনোদিন, কোনোদিন আর! দ্যাট ওল্ড গিটার! কোনো-এক সানশাইনি সকালবেলায় বেরিয়ে যে গেল উড়ে, ফিরে আর এল না তো ঘরে, ফেরা আর হলো না তার কান্ট্রিরোড ধরে! কে জানে, হয়তো-বা গেল ফিরে চিরকালের ঘরে। … স্ট্রেইঞ্জার টু ব্লু ওয়াটার সেই জন ডেনভার … গেল ফিরে রকি-পর্বতমালার কলোরাডো অঞ্চলবর্তী ওয়েস্ট-ভার্জিনিয়া গাঁয়ে তার, যেইখানে বয়ে চলে কুলুকুলু সুর তুলে শানাঁডোয়া রিভার …
- এপিগ্র্যাফতথ্য : জন ডেনভার প্রয়াণের বছর ট্রিবিউট হিশেবে অঞ্জন দত্ত ‘রোদ্দুর’ গানটা বাঁধেন।
এই নিবন্ধটা ‘লাল জীপের ডায়েরী’ পত্রিকায় আপ্লোড করেছিলেন প্রথমবার অর্পণ দেব ও বিজয় আহমেদ, জন ডেনভারের প্রয়াণবার্ষিকী ইয়াদে রেখে ২০১৩ অক্টোবর মাসে। ডেইট ক্লিয়ার্লি ইয়াদ থাকার একটা কারণ হচ্ছে এ-ই যে, এই নিবন্ধকারের এইটাই ছিল প্রথম কোনো অনলাইন প্রকাশমাধ্যমে লেখা আপ্লোডের স্মৃতি। ঠিক এরপরেও খুব বেশি স্মৃতি নির্মিত হয়েছে এ-বাবতে বললে বাড়িয়ে বলা হয়। লালজীপের মডারেটর মহোদয়দের কাছে কর্জ স্বীকার করতে দ্বিধা নাই। কিন্তু বর্তমানে সেই বিউটিফ্যুল ওয়েবম্যাগটা লাইনে অ্যাভেইলেবল নাই বিধায় এইখানে এই রিপ্রিন্টের ব্যবস্থা। তাছাড়া থার্টিফার্স্ট ইভে ডেনভারের বার্থডে। একটু জন্মস্মরণও হলো হয়তো। নববছরের শুভেচ্ছা সবাইকে। — লেখক
… …
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS