এই দিনটা এলেই কেন জানি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। আঠারো বছর আগে কোনো-এক বিকেলবেলায় পাড়ার বড়ভাইদের আদেশে সাজতে হয়েছিল বাসুদেব। জন্মাষ্টমী উদযাপনের অংশ হিশেবে দিনের বেলায় র্যালি হবে। সারাদেশের মতো আমার শহরেও প্রথম জন্মাষ্টমী উদযাপনের অংশ হিশেবে র্যালি/শোভাযাত্রা আয়োজন করেন এলাকার মুরব্বিরা। এইরকম আয়োজন এর আগে হয়েছিল বলে পাড়ার কারো কাছে শুনিনি। এলাকার ছোটভাইদের মধ্যে নয়ন, পলাশ, কিংশুক, দীপ সহ আরো দুইজনকে নানা বয়সের কৃষ্ণরূপে সাজানো হলো। আমাদের সাজানোর দায়িত্বটা নিয়েছিলেন কাঞ্চনদা সহ আরো কয়েকজন। আখড়া সাজানোর দায়িত্ব ন্যাস্ত হয় উৎপলদা সহ আরো কয়েকজনের কাছে। সেই অনুযায়ী আমাকে সাজানোর আয়োজন হলো। বাঁধ সাধল শিশু কৃষ্ণকে নিয়ে। কোন বাচ্চাকে মাথায় করে নিয়ে বাজার প্রদক্ষিণ করা যাবে? আবার আমার মাথার উপরের ঝুড়িতে একটা বাচ্চা থাকাও জরুরি। এমন সময় একটা সমাধান নিয়ে এলেন রিপনদা। ভাতিজি মৌমিতার একটা বিদেশী খেলনার শিশু ছিল যা ব্যাটারিতে চলত। সেই খেলনার শিশুটিকে তুলে দেয়া হলো আমার মাথার ঝুড়িতে আর খেলনাটা সারাক্ষণ নড়াচড়া করতে থাকল।
প্রথমে বাজারের আখড়া থেকে শুরু হলো কীর্তন সহযোগে র্যালি, তারপর বাজার প্রদক্ষিণ করে আবার আখড়ায় গিয়ে শেষ হলো দিনের প্রথমভাগের কর্মসূচি। ভীষণ গরমে আমার গায়ে মাখানো রঙগুলো তুলতে বেশ বেগ পেতে হয়। আমার মুখে গাম-দিয়ে-আটকানো নকল দাড়ি পরিস্কার করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় আমার ঝুলিতে, নিয়মিত-মঞ্চে-কাজ-করা কুশীলবদের ম্যাকআপবিভ্রান্তি ভেবে একটু স্বস্তি পাই। ফিরতিপথে দোকান পেরিয়ে বাসায় যাওয়ার সময় খেয়াল করলাম আমাদের বাজারের কয়েকজন মুরব্বি মিলে আড্ডা দিচ্ছেন বাবার সাথে। আমার খুব প্রিয় একজন দাদুভাই সুরেন্দ্র রায় বাবাকে বলছেন ওনার অনুভূতি। বয়স্ক হওয়ার কারণে অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে বললেন, ‘‘আজ বাসুদেবকে দেখে একটা মানসিক প্রশান্তি হয় এবং দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে প্রণাম জানাই।” আমি মুচকি হেসে চলে যাচ্ছিলাম, বাবার ডাক শুনে দাঁড়াতেই হলো। বাবা যখন ওনার কাকাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন বাসুদেবরূপী নাতিকে, দাদুর হাসির বাঁধ ভেঙে পড়ল। প্রতিদিন দেবতাপ্রণাম করাটা যার নিয়ম ছিল, সেই দাদুর একবেলার ঠাকুরপ্রণাম আজ আমার কপালে জুটল। আমি যখন প্রণাম করার তাৎপর্য খুঁজলাম, উত্তরে তিনি আমার মাথায় বহনকারী শিশুকৃষ্ণের কথা বললেন। আবার আমার জন্য চিন্তাও ছিল, এই বাচ্চাটিকে নিয়ে সারা বাজার ঘোরানোর কারণে গায়ে ব্যথা করছে কি না তা-ও জিজ্ঞেস করলেন। কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘‘বাসুদেবের মতো সহনশীল হওয়ার চেষ্টা করিস, মানুষ হিশেবে সম্মান পাবি।’’
এমন অনেক মুরব্বিদের সংস্পর্শে কেটেছে আমার শৈশব, আমার কৈশোর, আমার বাল্যকাল। অনেক স্মৃতি উনাদের সাথে। দাদু হিশেবেই অনেকের সাথে ছিল হাস্যরসের সম্পর্ক। পাশাপাশি ধর্মীয় আচারবিধি ও নৈতিক শিক্ষার একটা দীর্ঘ সময় এই অগ্রজদের কাছ থেকে পেয়েছি, যা আজকে আমাকে দাঁড় করিয়েছে সমাজের সামনে।
সকলের মঙ্গল হউক, হউক সবার চেতনার উদয়। সবাইকে জন্মাষ্টমীর শুভেচ্ছা।
[metaslider id=”6003″]
… …
- প্রথম জন্মাষ্টমী || পীযূষ কুরী - September 1, 2018
- তিন মুসাফির বিলেতের মঞ্চে : জয়, শ্রীকান্ত, শ্রীজাত || পীযূষ কুরী - March 28, 2018
- মনের জানালায় || পীযূষ কুরী - October 24, 2017
COMMENTS