তখন কারাগারে ছিলাম!
এমসি কলেজ লাগোয়া ছাত্রাবাস। নাম তার কারাগার। কারাগার ছাত্রাবাস। টিলাগড় কলেজগেট। সিলেট।
শিক্ষাজীবন অনেকটা কয়েদিরই জীবন; পরীক্ষা না-থাকলে সময়টা আসলে মধুরই ছিল। তো, মূল গল্পটায় আসা যাক; সিলেটের জগন্নাথপুর থানার গোয়াসপুর গ্রামের ছেলে রত্নেশ্বর এসেছে কারাগারে, একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে, এখানে থেকে ইন্টারপরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করা।
আমাদের জন্য ভালোই হলো। সকলের আদরের রত্ন তরতর করে আমাদের সবার বন্ধু হয়ে উঠতে লাগল।
কঠিন ইংরাজি নিয়ে পড়ে থাকার চেয়ে ছেলেটা পেন্সিল দিয়ে আঁকাআঁকিতে ব্যস্ত।
বলি, — ওরে রত্ন! পেন্সিল নিয়ে পড়ে থাকলে তো পাস করবি না রে!
রত্ন অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর করে, — দাদা, আঁকতেই যে ভালো লাগে!
সুযোগে বুঝে না-বুঝে যখনতখন ওরে ক্রিয়েটিভিটি শেখাই।
কয়দিন বাদে পেন্সিলের মূল কারবারটাই করল রত্ন। কোত্থেকে যেন প্রথম পুরস্কার নিয়ে এসে মেলে ধরে আশার বাণী সম্বলিত সার্টিফিকেট!
এমসি কলেজ বৈশাখী আয়োজনে দু-ভাই মিলে তরুণ-তরুণীদের গালে উল্কি আঁকি; খুশি হয়ে যার যা ইচ্ছে দিলো। তা-ও নেহাত কম নয়, দিনশেষে আঠারো শ! আহা রে কী আনন্দ রে! … আহ! কারাগার!
একরাতে হলো কি, হিসেবের খাতায় দেখা গেল প্রতি মিল্ ১৯টাকা!
অবিশ্বাস্য, কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
স্বঘোষিত সভাপতি আমি সহ সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম — লবণ, তেল, ডাল, মশলা (নগেনদার দোকান থেকে) ছাড়া পরবর্তী সিদ্ধান্ত না নেয়া পর্যন্ত বাড়তি কিছু কেনা যাবে না। গাছের পেঁপে আমাদের ভরসা হয়ে দাঁড়াল। তিনবেলা পেঁপে ভাজি, পেঁপে চচ্চড়ি, পেঁপে ভর্তা … পেঁপে পেঁপে আর পেঁপে!
আর বলে লাভ নেই। সাত থেকে দশ দিনের মাঝে মিল্ নেমে দাঁড়াল দুইটাকারও কম!
তো, গল্পটি থেকে যা আমরা শিখেছিলাম তা-ও অবিস্মরণীয়। রত্ন পেঁপের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে বলে, — দাদা, আমারে একটা পেঁপে ছাড়া মেস দেখে দেন!
আর বেশিদিন থাকতে হয়নি অবশ্য; রাজশাহীতে ভর্তি হলো রত্ন, চারুকলায়। না, মন টেকেনি; পরের বছর ঢাবিতে। ওর খবর পাই, ভালো করছে, খুশি হই। শাহবাগে জাহানারা ইমামের বিশাল প্রতিকৃতিটি তোলা হয়, মোমের আলোয় সে এক অনন্য অনুভূতি! গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে। মহীয়সী মায়ের প্রতিকৃতিটির আঁকিয়ে পেঁপের ভয়ে মেস থেকে পালাতে যাওয়া ভাই রত্নেশ্বর সূত্রধর। আমাদের কয়েদি জীবনের বন্ধু। ভালো থাক রত্ন সিরামিক নিয়া। কী মিষ্টি সিরামিকের কারিকর! খালি হাসে…
বলা নেই কওয়া নেই, রত্ন আমায় পোর্টেইট ইনবক্স করে। কয় কি জানেন, — টম ক্রুজ করতে গিয়া ছবিটা জানি কেমন হয়ে গেছে দাদা! কাজ চলতেছে শেষ ফিনিশিঙের… কিন্তু আমার শ্রেয়াস ঠিকই দেখে কয় — বাবা!
রত্ন, নববর্ষে এমন উপহার — অদ্ভুত! তরে কৃতজ্ঞতা জানা্য়া লাভ নাই। তুই তো আমাদেরই রত্ন। ভাইটা জেনে খুশি হবি, কারাগারে এখনও আমিই সভাপতি! আর একজনই শিল্পী — রত্নেশ্বর সূত্রধর… প্রাউড অফ ইউ!
- ব্যানারে ব্যবহৃত পোর্টেইটকর্মের শিল্পী রত্নেশ্বর সূত্রধর। উল্লেখ্য, প্রতিকৃতিমুখটা আর কারো নয়, স্বয়ং লেখকের। — গানপার
- শাহ আবদুল করিম : জন্মের শতক পেরিয়ে আরও একটা আস্ত দশক || ইলিয়াস কমল - January 20, 2025
- সিনেমার চিরকুট ৮ - January 19, 2025
- টুকটাক সদালাপ ২ - January 17, 2025
COMMENTS