সাক্ষাৎকারে কেইট উইন্সলেট

সাক্ষাৎকারে কেইট উইন্সলেট

ম্যানহ্যাটানের চেল্সি ডিস্ট্রিক্টের ছোট্ট একটা বারোয়ারি মুদিখানায় এসে কেইট হন্তদন্ত ঢুকলেন, মনে হচ্ছিল টিপিক্যাল তরুণী কোনো মা সারাদিনের রুটিনটাইট মহাব্যস্ততার ফাঁকে সংসারের তুচ্ছ অথচ জরুরি জিনিশগুলো খরিদ করার জন্যে একটা ফাঁক বার করে এসেছেন দোকানির দুয়ারে। একদম সাধারণ ভঙ্গি ও বেশভূষায় কেইট, পরনে একজোড়া প্রায়-ব্যবহারজীর্ণ জিন্স, মধুবর্ণ চুলগুলো গুছি করে হেলাফেলায় বাঁধা, সত্যি সত্যি তার একহাতে একটা আলাভোলা বাজারিব্যাগ আর অন্যহাতে একটা ভাঁজ-করে-রাখা বাচ্চাবাহন হাতঠেলা আছে দেখতে পেলাম। কৌতূহলটা আমার চোখে খেলে গেছিল হয়তো, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জানালেন যে এই ইন্টার্ভিয়্যু চুকিয়ে একটু বাজারসদাই সেরে দৌড়াবেন তার তিনবছরের ছেলে জো-কে ডে-কেয়ার সেন্টার থেকে তুলতে। একেবারেই টিপিক্যাল সন্তানবৎসল মাতৃমূর্তি। কিন্তু অভিনয়শিল্পী হিশেবে কেইট সমসাময়িক যে-কারো তুলনায় ঢের বেশি সিরিয়াস, কেইটের এই সিরিয়াসনেস চালচলনে নয় বোঝা যায় তার কাজ দেখে। এরই মধ্যে একাধিকবার অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড আর অস্কার পেয়ে গেছেন, মনোনয়ন পেয়েছেন কতবার ইয়ত্তা নাই, অসংখ্য পুরস্কার আর স্বীকৃতি পেয়েছেন অল্প বয়সেই। জীবনে এই স্বীকৃতি প্রাপ্তির যাত্রা হয়েছে কেইটের বেলায় একুশ বছর বয়স থেকে, সেই টাইটানিক দিয়ে, এখনও সমান গতিতে সেই যাত্রা অব্যাহত এবং টাইটানিক রিলিজের পর থেকেই তিনি ইন্টার্ন্যাশন্যাল স্টার।

মুদিখানার ক্যাফেতে একটা চারপেয়ে টেবিলে কেইটের মুখোমুখি ইন্টার্ভিয়্যু নিতে রেকর্ডার বার করছি, তিনি এই ফাঁকে নিজের কাচ্চাবাচ্চাদের ছবি পার্স খুলে অতি আগ্রহভরে দেখাতে লাগলেন আমাকে। এখন তো আমরা ফ্যামিলি ফোটোটোটো সমস্ত মোবাইলফোনেই রাখি, কিন্তু কেইট জানেন না ভালো করে টেক্সটিং আর কথাবলা ছাড়া সেলফোনের বাকি অপশনগুলো কেমনে ব্যবহার করতে হয়। “আমি ভাই নিত্যনতুন প্রযুক্তি নিয়া খাম্বার মতো মূর্খ”, উইন্সলেট অ্যাডমিট করেন, “মানে, এমনকি ইমেইল চালাচালি বা কম্পিউটার ওপেন বা শাটডাউন করাটাও রপ্ত করতে পারি নাই আমি।” কিন্তু প্রযুক্তিপীড়িত উইন্সলেটকে দেখে মনে হয় না তার জীবনযাত্রা ব্যাহত হতেছে টেক্নোলোজি-লিটারেসিতে পেছিয়ে থাকার কারণে; কেইট দিব্যি আছেন পুরানা কায়দায়, স্মার্ট, আধুনিক। ততক্ষণে বের করে দেখিয়ে ফেলেছেন সন্তানদ্বয়ের ছবিদুটো, ছয় বছরের কন্যা মিয়া আর তিন বছরের পুত্র জো, প্রথমজন তার এক্সের ঔরসে এবং পরের জন বর্তমান হাসব্যান্ড খ্যাতকীর্ত ম্যুভিডিরেক্টর ও থিয়েটারকন্ডাক্টর স্যাম মেন্ডেসের ঔরসে আনীত সন্তান।

অভিনয় পেশাটা কেইটের জীবনে আকস্মিকতা নয়, ছিল অবধারিতই যে অ্যাক্টিং করবেন তিনি। ইংল্যান্ডে বর্ন এই অভিনয়শিল্পীর গোটা ফ্যামিলিই থিয়েটারের সঙ্গে একদম ওতপ্রোতভাবে অ্যাটাচড। উনার গ্র্যান্ডপ্যারেন্টস্ লোক্যাল একটা থিয়েটার চালাইতেন, আর তার বাবা এবং তার দুই বোন প্রত্যেকেই পরিশ্রমী স্টেইজ-অ্যাক্টর। উইন্সলেট-ম্যান্ডেস দম্পতি নিউইয়র্ক সিটিতে এই-মুহূর্তে আবাস গাড়লেও লন্ডনে একটু মফস্বলের দিকটায় একটা বাড়ি মেইন্টেইন করেন। অত্যন্ত মা-অন্তপ্রাণ মেয়ে কেইট, “আই মিস্ মাই ম্যম্, আই রিয়্যালি ডু”, কথায় কথায় জানা হয়। প্রায় বিলাপের আওয়াজেই জানালেন যে এই দিন-কয়েকের মধ্যেই তার বাপ-মা তার বাসায় বেড়াতে আসছেন তার বোনের বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে যে-বাচ্চাটা নাকি মিয়ারই সমবয়সী এবং দুই-তিনটা দিন বাদে এই ইন্টার্ভিয়্যু যদি নিতাম আমি তাইলে ইজিলিই ওদের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত আমার … ইত্যাদি। কিন্তু কথাগুলো আফসোসের আওয়াজে হলেও বলার সময় মাতৃপিতৃভক্ত উইন্সলেটের চেহারায় আলোর ঔচ্ছল্য লক্ষগোচর হচ্ছিল।

গোলাপি চিবুক ও গোলাপকোমলা গালের বিউটি কেইট উইন্সলেটকে দেখলেই বোঝা যায় তিনি নিরিবিলিপ্রিয়, শোভাদীপ্তিস্মিত, স্বনিয়ন্ত্রিত মর্জিমিজাজের মানুষ। যদিও প্রণয়কাঁটায় এরই ভিতরে এই মানুষটাকে বেশ জখমি জিন্দেগি পারায়ে আসতে হয়েছে। সেই সাতানব্বইয়ের টাইটানিক রিলিজের অব্যবহিত বছরগুলোতে তাকে ব্যক্তিগত প্রণয়বিপর্যয়ে বেশ ধরাশায়ী দিন কাটাতে হয়েছিল। উইন্সলেটের জীবনের পয়লা প্রেমিক রাইটার-অ্যাক্টর স্টিফেন ট্রেডর এই সময়টায় মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে বৌন-ক্যান্সারে ইন্তেকাল করেন। “ইট ওয়্যজ্ আনবিলিভেব্লি হার্টব্রেইকিং” — উইন্সলেট বলছিলেন। “মনরে এই বলিয়া সান্ত্বনা যোগাই যে শেষমুহূর্ত অব্দি স্টিফেনের সঙ্গেই ছিলাম আমি, ঘনিষ্ঠ ও হৃদয়নিবিষ্ট” — লোকান্তরিত প্রথম প্রেমের অনারে এই কথাগুলোও উইন্সলেট অ্যাড করতে ভোলেন না। টাইটানিকের ঠিক পরে যে-ফিল্মটায় কাজ করেন, সেই ফিল্মেরই সেটে দেখা হয় জিম থ্রেপল্টনের লগে। সেই ফিল্মটায় জিম অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিশেবে কাজ করছিলেন। খুব তড়িঘড়িই বিয়ে করে ফেলেন, ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে, বছর-তিন সংসার করার পরে কেইট-জিম দম্পতির পাকাপাকি ডিভোর্স হয়ে যায়। ডিভোর্সের ঠিক আগে বেশ কিছুদিন সেপারেইট থাকছিলেন তারা, সেই সেপারেইট থাকবার সময়েই তিনি স্যাম ম্যান্ডেসের লগে পরিচিত হন, হাল্কা ডেট করাও হয়ে যায় এরই মধ্যে, সেপারেশনের দিনগুলোতে এর বেশি কিছুই ছিল না তাদের মধ্যে, তবে একটা প্রণয়বাতাসের হল্কা লাগছিল বটে গায়ে, টের পাচ্ছিলেন হ্যাপেনিংস্, ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডগুলোতে এই সময়টা নিয়া পানি বিস্তর ঘোলা করা হয়েছে। একসময় জিমের সঙ্গে অফিশিয়্যালি বিচ্ছেদ হয়, কেইট বাঁধেন স্যামের সঙ্গে জীবনের গাঁটছড়া।

সাংবাদিকদের আচরণ নিয়ে কেইট বিরক্ত হলেও অন্যান্য অভিনয়শিল্পীদের মতো মহাখাপ্পা মেজাজ দেখান না তিনি। ব্রিটিশ প্রেসের এই জিনিশটা আপত্তিকরভাবে অশিষ্ট মনে হয়েছিল একসময় যে এরা কেইটের মোটার ধাত নিয়া খামাখা কালি খর্চায় মেতে উঠেছিল। বর্তমানে ব্যাপারটা খানিক থিতিয়েছে যদিও। যদি টিনেইজার হিশেবে কেউ উইন্সলেটকে আটকা দেখতে চান, তাইলে বলতেই হবে যে কেইট চিরটিনেইজার থাকতে চান না। আর টিনেইজারদের মতো চলনবলনের পক্ষে কেইটের বয়স যথেষ্ট ভারিক্কিই হয়ে গেছে এরই মধ্যে। কেইটের ওজন গেইন্ করা নিয়ে প্রেসের ঘুমহারাম দুশ্চিন্তায় তিনি যারপরনাই বিরক্ত। “অবাক লাগে আমার কাছে সবসময়, আজব মনে হয়, পার্ফেকশন বলতেই মানুষ কেন যে খালি ছিপছিপে শরীরস্বাস্থ্যের ডৌলগড়ন বোঝে কে জানে” — রিসেন্টলি বিবিসি-ইন্টার্ভিয়্যুতে কেইট কথাগুলো বলছিলেন খেদের সঙ্গে। “এই বিচ্ছিরি শরীরস্বাস্থ্য নিয়াই কিন্তু আমার নসিবে একজোড়া বাচ্চা আর চমৎকার একটা হাসব্যান্ড জুটেছে, এইটা পাইতে তো ওজন কোনো অন্তরায় হয় নাই।” কিন্তু জনগণের মনোরঞ্জনের জন্যে প্রেসের প্রেস্ক্রাইবড সৌন্দর্যবটিকায় দিন গুজরান করেন এমন সেলিব্রেটিতেই শোবিজ সয়লাব, কেইট উইন্সলেট সেই স্রোতের মৎস্যটি ছিলেন না কোনোদিনই।

নিজের এই ন্যাচারাল শরীরস্বাস্থ্যের শান্তিশ্রী ও রাজকীয়তা নিয়ে কেইট ফিল্মদুনিয়ায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন অভিনয় দিয়ে। হ্যাঁ, এবং তার পরিণত শরীরী বিচ্ছুরণও উপেক্ষণীয় নয়। শাঁসালো সব রোলে প্লে করতে পারছেন তিনি ব্রিটিশ প্রেসের জন্য দুশ্চিন্তাকাতর বিচ্ছিরি এই শরীর দিয়াই। বিচিত্র সব চরিত্রের দাপুটে অভিনয়ে কেইটের তুলনা কেইটই। সম্ভ্রান্ত। শরীর নয়, কেইট মনে করেন, অভিনয় করতে হয় অন্যকিছু দিয়ে। যেটুকু শরীর প্রাকৃতিক সেটুকুর সঙ্গে মনন এবং সৃজনের যোটক হলেই শিল্পের দুয়ার অবমুক্ত হতে পারে।

একটা আলো উছলায় কেইটের মুখাবয়বে যখনই তিনি নিজের ফ্যামিলির কথা ম্যানশন করেন কথাবার্তাক্রমে। এবং খুবই প্যাশনেইট তিনি স্বভাবের দিক থেকে, প্যাশনেইট তিনি পাপারাৎসি থেকে শুরু করে আগড়মবাগড়ম দৈনন্দিনের প্রায় বেবাককিছু নিয়েই। জীবনের প্রতি এই প্যাশনই কি তার সাফল্যের চাবিকাঠি? সেইটা যা-ই হোক, প্যাশনের মাত্রাটা কোন লেভেলের হলে পরে একটা মানুষ পাপারাৎসিদেরেও অসীম ক্ষমায় সইতে পারে? যে-পাপারাৎসিরা শারীরিক ওজন নিয়াও অভব্য মন্তব্য-মজাক করে বেড়ায় নিউজপেপারে কেইটকে নিয়ে, এরপরও উনি বিরক্তি গিলে ফেলে ব্যাপারটা স্বাভাবিক সহজতায় নিতে পারেন।

বোতলের মিনারেল ওয়াটার গ্লাসে ঢেলে একটু একটু চুমুকে ভেজাচ্ছিলাম গলা, খানিক প্যাস্ট্রির কোণা ভেঙে জিভে চেখে দেখছিলাম, আর কেইট উইন্সলেটের কথার স্ফূর্ততা লক্ষ করছিলাম। অন্তরঙ্গভাবেই দিয়েছিলেন কেইট অত্যন্ত সাধারণ জিজ্ঞাসারও উত্তর। পরবর্তী অংশে কেইটের সঙ্গে আলাপচারিতার বিস্তারিত শুনব আমরা।

 

[ইংরেজিতে এই ইন্টার্ভিয়্যু গ্রহণ করেছেন লিজ স্মিথ। মূল ইন্টার্ভিয়্যু ২০০৭ সনে ফেব্রুয়ারি নাগাদ ছাপা হয়। বিদিতা গোমেজ এইটা বাংলায় গানপারের জন্য অনুবাদ করেছেন। ইন্টার্ভিয়্যুয়ের পরবর্তী ইনস্টলমেন্ট আসছে নেক্সট উয়িক নাগাদ। — গানপার]

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you