খোন্দকারের প্রয়াণের দিন সন্ধ্যায়

খোন্দকারের প্রয়াণের দিন সন্ধ্যায়

সন্ধ্যা নামার খানিক আগে, বেশ খানিকটা আগে থেকে, পৃথিবী দারুণ এক মায়ামমতার আলোয় ভরে উঠেছিল। বেলাবেলি বাড়ি ফিরে আসার কারণে এই দৃশ্যভরপুর সন্ধ্যার অবতরণ প্রত্যক্ষ করতে পারলাম। চারপাশ ভালো করে তাকিয়ে দেখার ফুরসত পেয়েছিলাম আজ আবার অনেকদিনের পর। আবার এসেছিল সন্ধ্যা, হ্যাপী আখন্দের সেই গানের মতো, তবে ‘শুধু দুজনার’ নয়, এসেছিল সন্ধ্যা আমার একলার। দেখেছি, ত্রিনয়ন মেলে, হৃদি ও পরান ভরে। চেয়ে চেয়ে দেখেছি সতৃষ্ণ চাতকের ন্যায়, আকাশদিগন্তে, দেখার সাধ আমার মরে নাই তবু।

সন্ধ্যা হয় হয়, — এমন সময়টাকে সেই প্রাচীনকাল থেকে আজোবধি কত লেখক-চিত্রক-কবি-গাতক কতভাবেই-না ধরেছেন, তবু যেন ধরবার অপেক্ষায় এখনও, তবু যেন ধরা হয়নি কিছু। তবু যেন বাকি রয়ে গিয়েছে এন্তার, অনেক, বহু। মনে হয়, আমার প্রায়শ মনে হয় এমন, সন্ধেবেলা সমস্ত চরাচর গোটা চারপাশটাকে একেবারে স্তব্ধনিঝুম চুপটি করে দেয়া দরকার। মানে, আমি বলতে চাইছি, চারপাশের কৃত্রিমতাক্লীষ্ট কলকাকলি আর দিনযাপনের সফেন বুদ্বুদ যদি নির্দিষ্ট একটা সময়ের জন্য বন্ধ করে দেয়া যাইত প্রত্যহ প্রদোষে, ভালো হতো খুব। সন্ধ্যাটাকে তার সামগ্রিকতায় দেখা যেত, উপভোগ করা সম্ভব হতো অপরাহ্নকালীন উদ্বায়ী দৃশ্যগন্ধশব্দাবলি, যথাযোগ্য মর্যাদা আর ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে উদযাপন করা যেত অতুলনীয়া সান্ধ্য নৈসর্গ্য ও নন্দনরাজি।

ঠিক লিকার চায়ের মতোই ফিকা কালারের সন্ধ্যালোকে দেখলাম নেউল একটা। নেউল মানে যাকে বলা হয় বেজি। বাড়ির পুবদিকের খোলা জায়গাটায় ইতিউতি তাকিয়ে কেমন সাবধানী ভঙ্গিতে কোথাও যাচ্ছে সে। নেভন্ত বিকেল, ফুটন্ত রজনী, উলুখাগড়ায় ভাসন্ত স্পষ্টকায় বৃষ্টির আবাহনী। নিশ্চয় নেউল তার নিবাসভূম গর্তের দিকেই ফিরে চলেছে। কেন যেন খুব মায়া লাগে বেচারাকে দেখে, খুব সুন্দর লাগে সহসা তার শরীর ও আঁখিপর্দাকাঁপানো শরীরী বিভঙ্গি, অতি লাগে ভালো তার ত্রস্ত হাঁটাচলা। তার ওই সাবধানী ভঙ্গিটা খুব পরিচিত, খুব চেনা, নেউলের চরিত্রই হলো ওই ত্রস্ত চলন ও সদা-সতর্কতা।

আজ একজন কবির আচমকা প্রস্থান খুব হতবিহ্বল ও হতচকিত করে রেখেছিল প্রকৃতিনিসর্গ। ফলে বাতাস ছিল থমথমে, রোদ্দুর ছিল কিংকর্তব্যবিমূঢ়, নৌকাগুলো অপার ও অমীমাংসিত। অনড়, অপরিবর্তিত ও স্থবির দিনভর। শোকাভিভূত সূর্য, চন্দ্র, চরাচর সমস্ত। খুব অবসন্ন ও বিমর্ষ লাগছিল, অসহায়, বিস্বাদ লাগছিল। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের প্রয়াণসংবাদ শুনে শুরু হওয়া দিন সন্ধের দিকে এসে একটু একটু ধাতস্থ হচ্ছিল যেন। মেনে তো নিতেই হয়, এক-সময়, বিমূঢ়ভাবে। এই দুনিয়ায় মেনে নেয়া আর মানিয়ে নেয়া ছাড়া কার কী করার থাকে।

এইভাবে ফুরিয়ে এল বেলা, আস্তে আস্তে, যাকে বলে ক্রমশ। জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানের একতিল সন্ধে দেখে, একটি নেউলের চকিত পেছনফেরা দেখে, বাড়ির চারপাশের আলো ও হাওয়া আর গাছপালা দেখতে দেখতে। এইভাবে একদিন গ্রন্থের শেষপৃষ্ঠায় পৌঁছাব সবাই, গল্পশেষের মধুবিষাদে ভরে উঠবে চরাচর। কয়েকটি দিন থাকব অবশ্য মুখে মুখে ফেরা আত্মীয়স্বজনের দুষ্কৃতি রোমন্থনে, কান্নাধারার দোলায়, কাজের মাঝেমাঝে।

এত অবসন্ন লাগছে, এত মনখারাপের মতো, এতটাই নির্বাক লাগছে যে বলার নয়। ‘একবিংশ’ আমাদেরকে একটা সময় পর্যন্ত কতভাবেই-না আনন্দ দিয়েছে! শিক্ষিত করেছেন খোন্দকার আমাকে তাঁর অনুপম অনুবাদ ও আলোচনাগুলো দিয়ে! এ এমনই ঋণ, স্বীকার করা মাত্র মওকুফ হয়ে যায় বাকিটা দায়। কাজেই, ঋণ করতে হবে আরও, খোন্দকারের ঋণ স্বীকার করে যেতে হবে আমায় আরও অনেকদিন।

খোন্দকারের কবিতাবইগুলি — কী বিউটিফ্যুল নাম একেকটার! স্মরণ করতে পারব বোধহয় তাঁর কবিতাবইয়ের নাম সবগুলি — ‘তিন রমণীর ক্বাসিদা’, ‘পার্থ তোমার তীব্র তির’, ‘জীবনের সমান চুমুক’, ‘সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর’, ‘যমুনাপর্ব’, ‘জন্মবাউল’, ‘তোমার নামে বৃষ্টি নামে’, ‘আয়(না) দেখে অন্ধ মানুষ’ প্রভৃতি।

কবির মৃত্যুসংবাদে মেঘাতুর সন্ধ্যায় নেউলের গর্ত পেরিয়ে ফিরে আসি ঘরে।

জাহেদ আহমদ ২০১৩


খোন্দকার আশরাফ হোসেন স্মরণ ও মূল্যায়ন রচনারাশি
খোন্দকার আশরাফ হোসেন কবিতাবলি

জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you