সাক্ষাৎকারে লেডি গাগা

সাক্ষাৎকারে লেডি গাগা

[‘বর্ন দিস্ ওয়ে’ অ্যালবামরিলিজের অব্যবহিত পরে লেডি গাগা  (Lady Gaga) টাইমআউট পত্রিকার প্রতিনিধি পিটার রবিন্সনকে এই ইন্টার্ভিয়্যুটি দিয়েছিলেন। দুইটা পার্টে এই ইন্টার্ভিয়্যুটা আমরা গানপারে বাংলায় ছাপছি। দ্বিতীয় অংশটা আপকামিং উইকে আপ্লোড করা হবে। গানপার]

. . .

 “অমুক-তমুক শিল্পীর পাশে বসায়ে আমারে একনাম্বার-দুইনাম্বার বিচার করা আমার একেবারেই পছন্দ না”, টাইমআউট পত্রিকার সঙ্গে একটা রেকর্ডিঙস্টুডিয়োয় বসে লেডি গাগা স্পষ্ট গলায় বিবৃতিটা রাখলেন। “আমি খালি আমার নিজের মিউজিকটাই করে যেতে চাই।”

কিন্তু কথাগুলো শুনতে বেশ লাগলেও মনে মনে কেউ যদি ফিক করে হেসে ওঠেন, বা মুচকি স্মাইল দেন, তো চোখ ঠারবেন কেমনে তারে? কেননা গাগা গানাবাজানার চেয়ে এবড়োখেবড়ো বডিলিঙ্গুয়া, আজিব কিসিমের শরীরী সাজসজ্জা, আক্কেলগুড়ুম আচার-ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে স্টেজে এবং অফস্টেজলাইফে বেবাক দুনিয়া তামাশায় মাতায়া রাখেন। lady gagaহরহামেশা গাগা পাব্লিকলি অ্যাপিয়্যার করেন অদ্ভুতুড়ে ড্রেসআপ নিয়া। গ্যাসমাস্ক পরে, বেতাল কায়দায় কেশবিন্যাস করে, দেখতে-উদ্ভট-সমস্ত উয়িগ পরে, একটা লার্জ ল্যাম্পশেইড মাথায় দিয়ে, একবার একটা আখাম্বা আণ্ডায় নিজেরে সেঁধিয়ে এবং আরেকবার একটা আগাগোড়া মাংশনির্মিত পোশাকে লেডি নিজেরে পেঁচিয়ে স্টেজে অ্যাপিয়্যার করেন। গড়পরতা মানুষে যেই জিনিশটারে বলে কিম্ভূত, উনি তা-ই বস্তুত। অন্তত সচল দুনিয়ায় যে-ফ্যাশনস্ট্যাইটমেন্ট ফলো করে গেলে ব্যাপক জনগণমন স্বস্তি পেত বা মার্জিত বলিয়া আখ্যা দিত উনারে, লেডি গাগা তার ওয়ান-এইটি ডিগ্রি উল্টো। তবু লোকে এইগুলো লইয়া হাসিঠাট্টা যা-ই করুক, অন্তত উপেক্ষা যে করে না তার প্রমাণ গাগার অ্যালবামবিক্রির ঊর্ধ্বগতিওয়ালা গ্র্যাফ। গত কয়েক বছর ধরে লেডি গাগা প্রাধান্য বিস্তার করে চলেছেন প্যপমিউজিকের অ্যারেনায় এবং এই বিস্তৃতিটা আর-দশটা আর্টিস্টের অ্যালবাম বিক্রিবাট্টার পরিসংখ্যানপাশে লেডি গাগাকে রেখে দেখলেই ধরা পড়বে। সেইল্সের গ্র্যাফ দেখে লেডি গাগার সঙ্গে নেক্সট-টু-হার আর্টিস্ট যারা তাদেরে একেবারেই মিলানো সম্ভব হবে না তা নয়, কিন্তু কম্পেয়ার করাটা ভালোই ডিফিকাল্ট হবে।

লেডি গাগা আজকের এই ইন্টার্নেটযুগে সত্যিকার-অর্থে সেলেব্রেটি সিঙ্গার, পার্ফোর্মার, বলা যায় এই নয়া জামানায় লেডিই হলেন পয়লাপরথম প্যপ ফেনোমেনা। গাগার ট্যুয়িটারফোলোয়ার দেখুন, বুঝতে পারবেন। সম্প্রতি তিনি ট্যুয়িটারে দশ মিলিয়ন ফোলোয়ারের মার্কটা পারায়েছেন। প্যপদুনিয়ায় আর-কোনো মেগাস্টার এভাবে এত সহজে এত অনায়াসে প্রায় হেলাফেলায় এত বড়সড় অডিয়েন্স কানেক্ট করতে পেরেছেন বলিয়া নজির নাই, কিংবা আর-কোনো প্যপনক্ষত্রও দুর্লভ যারে লেডির মতো অত গঞ্জনা সইতে হয়েছিল। বহু শোর মাচায়ে যেই সিঙ্গেলটা গাগার বিগ কামব্যাক হিশেবে বাজারে এসেছে, ‘বর্ন দিস্ ওয়ে’, এইটা গাগার পূর্বসূরি ম্যাডোনার মিউজিক টেম্পলেটের সঙ্গে এতটাই মিলে যেতেছে যে ক্রিটিকদের দুয়ো শুনতে হচ্ছে চারপাশে। এর সাক্সেস্যর হিশেবে, ম্যাডোনাসাযুজ্য মনে রেখে বিচার্য, ‘জুডাস’ আলোচনায় এসেছে।

lady gaga

“এইটা আর-কিছু না, আন্তর্জালিক কালচারের অংশই তো”, সটান ঘোষণায় লেডি তিরটা সামলাইলেন। “লোকে চায় আপনে ফেইল্ করেন, আপনার ফেইলিয়্যর দেখতেই লোকজন অপেক্ষা করে আছে। এরা চায় আমারে ফেলে দিতে, ছিঁড়ে ত্যানা বানায়া পায়ের তলায় দলাইতে চায় তারা আমারে, এরা পারলে আমারে ছুরি দিয়া ফালাফালা করতেই ইন্ট্রেস্টেড বেশি। কিন্তু খবরটা হচ্ছে, একদিন এরাই ফিরিয়া তাকাবে পেছনের দিকে এবং বুঝতে পারবে লেডি গাগা আর্টিস্ট হিশেবে কতটা সাহসী ছিল। ওরা তখন দেখবেন ঠিকই বলবে, মেয়েটা আমাদেরে পোর্ট্রে করতে যেয়ে একের পরে একটা করে রেকর্ড চাপায়েছে একাধারে এবং ওই কারণে বেচারিরে আমরা কিনা শূলে চড়ায়েছি! কিন্তু ভ্রুক্ষেপ ছিল না তার সেসব কোনোদিকেই, ইটিশপিটিশ সমালোচনাছানাছানির পাশে সে একটানা ছয়হপ্তা নাম্বার-ওয়ানের তখতে থেকে গেছে নির্বিকার এবং গলায় ঝাল ঢেলে কেবল বলেছে — ফাক্ অফ!”

শুধু ‘বর্ন দিস্ ওয়ে’ অ্যালবামেই পয়লা তামাম আমজনেরে অ্যাড্রেস করে ফাক্-অফ হাঁকলেন লেডি, নিশ্চয় ব্যাপারটা তা না। যার ফলে লেডি গাগার অ্যালবামগুলো ভদ্রসমাজে বেশ-অনেকটা আড়চোখেই গৃহীত/নিগৃহীত হয়। রিসেন্টলি রিলিজড অ্যালবামটার ক্ষেত্রেও হয়েছে তা-ই। রিলিজের সঙ্গে সঙ্গে চার্টগুলো পড়ে যায় বিপাকে, বিশেষত ‘জুডাস’ গানটার কথা ভাবা যাক, অ্যালবামের আর্টওয়ার্কগুলোও তোপের মুখে পড়ে ভদ্রজনদের। একটা হাল্কাপাৎলা ফ্যাসাদের উপক্রমই তৈরি হয়। রেডিয়োতে লেডি গাগার গানগুলো প্রচারের কথা ভাবতেই পারছিল না কর্তৃপক্ষ। পরে অবশ্য ভক্তকুলের চাপে আইটিউন্স একটা গান অ্যাপিয়্যার করে, ‘দি এজ অফ দি গ্লোরি’ শিরোনামে সেই গানটা আইটিউন্সে অ্যাভেইলেবল।

দুনিয়াজুড়ে লেডি গাগা আইটিউন্সের মাধ্যমে এই একটা গান দিয়েই হিট করেন টপচার্টগুলো। একনাম্বারটা অ্যাচিভ করেন। lady gagaউদ্ভট আউটফিট দিয়েই তো আর দুনিয়া জয় করা যায় না। কাজেই গানগুলোর দিকেও নজর ফেরাতে হবে। এইটা তো সত্যি যে লেডির ফার্স্ট সিঙ্গেল ‘জাস্ট ড্যান্স’ খানিকটা আলাদাভাবেই মিউজিকপ্রেমীদের কান কাড়ার যোগ্য। অথবা তার পরে-পরেই ‘ব্যাড রোম্যান্স’ গানটাও তো মন্দ মনে হয় নাই। জিনিশগুলো মনে হচ্ছিল গাগা আন্দাজ করতে পারেন, সামনে-বসা গাগাকে দেখে মনে হচ্ছিল উনি ক্রিটিকদের থোড়াই কেয়ার করেন, ভক্তশ্রোতারা তার গান দেদার আইটিউন্স থেকে রিসিভ করছে দেখেই তিনি এক্সাইটেড। কনফিডেন্সের অভাব তো হয় না গাগার। ব্রিলিয়্যান্ট একটা অ্যালবাম যে করেছেন সে-ব্যাপারে লেডি নিশ্চিত। আইপড থেকে লেডি নিজের কম্পোজিশনগুলো শুনছিলেন, উপভোগ করছিলেন যেন সফলতা তারিয়ে তারিয়ে।

“ম্যে-বি আয়্যাম আউট অফ মাই মাইন্ড, বাট আই বিলিভ একটা ফাটাফাটি সংখ্যায় অ্যালবাম বেচাবিকি হবে এইবার”, বলছিলেন লেডি গাগা। আলাপের শুরুতেই তিনি আমাদেরে একটা গান শোনালেন পড থেকে, জোরালো কোরাসের টেক্নো সাউন্ডের একটা গান সেইটা, ‘গবার্নমেন্ট হ্যুকার’, যেই-গানটা আবর্তিত হয়েছে ভোটার আর প্লাস্টিক প্যপস্টারদের ঘিরে যারা তাদের পাছা দেয়ালে যেয়ে গোত্তা খাবার আগ পর্যন্ত হুঁশহারা ধেই ধেই নাচতেই থাকে। এরপরে লেডি তার ‘হেয়ার’ গানটা বাজায়ে শোনালেন; এইটা শুনতে শুনতে কেন যেন মনে হচ্ছিল ব্রুস স্প্রিংস্টিন শুনছি, ‘ইউরোভিশন’ বিশেষ করে। লেডি তার ‘হেয়ার’ গানটার মিউজিকভিডিয়ো করবেন মনস্থির করেছেন, যেখানে লেডির ব্যবহৃত সমস্ত পরচুলা দেখানো হবে স্ক্রিনজুড়ে সারাক্ষণ। এইটা তার প্ল্যান, যদিও ইমপ্লিমেন্টেশন তো ঝক্কির অনেক। “দেখেন, আমি তো ওইসব স্যান্ডুয়িচের দোকানদার না যাদের কাছে খালি টার্কি-স্যান্ডুয়িচ ছাড়া আর কোনো ভ্যারাইটি নাই”, বলছিলেন গাগা, “আমি বিভিন্ন পদের বিভিন্ন স্বাদের স্যান্ডুয়িচ বেচি।”

lady gaga

রিসেন্টলি রিলিজড অ্যালবামের গানগুলি লিখতে যেয়ে নিজের কাছে কেমন লেগেছে অভিজ্ঞতাটা?
ব্যাপারটা হচ্ছে, সারাটি জীবনই কিন্তু বঞ্চনাবোধ থাকবে। এইটা কোনো ধর্তব্যই নয় যে এতজন লোকে আপনার নামে স্লোগ্যান দিলো জয়ধ্বনি দিলো অথবা নাম্বারওয়ান হিট গানে আপনার ঝুলি পূর্ণ। নো। এইগুলো গৌণ। ঘুমাতে যাবেন রোজ আর জেগে উঠে নিজেকে মনে হবে পরাজিত, দ্যাটস্ অল্।

আপনার এই-যে সাক্সেস, এইটাই তো সমস্ত বঞ্চনাবোধের মুখের উপর উত্তর, মনে হয় না এমন?
আমি মনে করি সাক্সেসফ্যুল হতে গেলে, কেবল সাক্সেসফ্যুল নয়, একজন ভালো আর্টিস্ট বলেন বা মিউজিশিয়্যান, অ্যাক্টর, পেইন্টার, হোয়াটেভার … হতে গেলে আপনাকে জানতে হবে কেমন করে পাব্লিক লাইফে সবসময় প্রাইভেট থাকা যায়। আপনারে মাস্ট বি অ্যাবল টু বি প্রাইভেট ইন পাব্লিক, বুঝলেন? এইটাই আমি করি। পাব্লিক অ্যাপিয়্যার‍্যান্সে নিজেরে প্রাইভেট রাখতে পারি।

আচ্ছা …
আমি যেইটা বুঝাইতে চেয়েছি, বিস্তারিত বলতে পারি ব্যাখ্যা করে … [একটু প্যজ্ দিলেন লেডি, এমন মুখভঙ্গি করলেন যেন লম্বা ভাষণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন অথচ ভাষণ দিতে চাইছেন না … ] তাছাড়া, আমার আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে কি, গান রচনার সময় আমি ইচ্ছে করেই পুরানা ব্যথাগুলা আবার খুঁড়ে তুলে আনতে পারি … আমি যদি নিজের ভিতরদেশে না তাকাইতে পারি তাইলে আমি তো কোনো আর্টিস্টের জাতই না।

lady gagaআপনার স্কুলদিনগুলোয় কে বা কারা আপনেরে বেশি ঠকিয়েছে বা কার যন্ত্রণায় আপনার ঘুমনিদ্রা হারাম হয়ে যেত?
[সজোরে মাথা নাড়িয়ে] আমি … নিজেরই ভিতরে … এই উত্যক্তকারীটা আমার মগজেরই ভিতরে রয়েছে … এর যন্ত্রণা এর গালিগালাজে ব্যতিব্যস্ত আমি। জিনিশটা হচ্ছে, একদম নিজের ক্ষতটা আপনি ডিটেক্ট করবেন, তারপর সেইটায় নুন-আর্সেনিক-জহর মিশাইবেন এবং একটা সুই দিয়া সুতাসেলাই করবেন সেই ক্ষতটায়। দেখবেন কাজ হচ্ছে। একেকটা বিট যখন পাই, এই প্রক্রিয়ায়, দ্যাট সাউন্ড অ্যামেইজিং। বিটটা হচ্ছে সেই কাঁচি, যেইটা দিয়া আমি আবার সেলাইটা কাটি। জিনিশটা চলতেই থাকে এবং সারাক্ষণ নিজেরে জিগাইতে থাকি, কী আমড়া ফালাইতেসি আমি এইখানে? কেন আমি এইখানে?

উত্তরটা পান?
উত্তরটা পাই না, আবার পাই, বিকজ্ আই মাস্ট বি হিয়ার। আমি জানি আর্টিস্ট হইতেই চেয়েছি আমি। ইট ইজ্ মাই পার্পাস টু বি অ্যান আর্টিস্ট। এই-যে এত ক্ষত, যন্ত্রণা, গালিগালাজ, নিরাপত্তাহীনতার বোধ, নিরর্থ অস্তিত্ব … এইসব ছোটবেলা থেকেই আমার সঙ্গে রয়েছে এবং গোটা ক্যারিয়ার জুড়ে এইটা আমারে তাড়িয়ে নিচ্ছে। আমার দিকে তাকায়া আপনি ওদের লগে আমারে মিলাইতে পারবেন না। আমি ওদের একজন না। আমি ওদের কেউ না। আমি ওদের মতো হব না।

ওদের কেউ বলতে? এই ‘ওরা’ কারা?
ওই-তো ওই ভিড়ের লোকেরা। আমি ঘিঞ্জির একজন না, তাদের কেউ হতেও চাই না। ওদের ভুয়া কায়কারবারে আমি বিব্রত হই না, আক্রোশ হয়, বারবার তাই ফিরি নিজেরই মিউজিকের কাছে। একটা আধাসমাপ্ত লিরিক নিয়া বসি। ইশকুলে ওদের বুলিয়িং আমারে ব্যাহত করতে পারে নাই, শিল্পেরই দিকে ঠেলেছে।

{নেক্সট কিস্তিতে সমাপ্য}

অনুবাদ : সুবিনয় ইসলাম

… …

সুবিনয় ইসলাম
Latest posts by সুবিনয় ইসলাম (see all)

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you