ঘাস

ঘাস

কবিতাবিষয়ক কাগজ ‘ঘাস’ পঞ্চম সংখ্যা। ‘ঘাসকথা’ শিরোনামে এডিটোরিয়্যাল্ থেকে জানা যাচ্ছে যে পত্রিকাটার বয়স কুড়ি বছর। অনুমেয় সহজেই, দীর্ঘ বিরতি নিয়ে এর পথচলা আজও অব্যাহত।

ছোটকাগজগুলোতে যেমন দেখা যায়, কিছু কবিতা আর কবিতাবিষয়ক খুচরো গদ্যনিবন্ধ/প্রবন্ধ, গোটাদুই রিভিয়্যু এবং অনুবাদ ইত্যাদি, ‘ঘাস’ মোটামুটি তা-ই। বিশেষ বিস্ময়ের কোনো রসদ তাতে নাই। অবশ্য অথৈ বিলোড়িত ভোজবাজির বর্তমান এই দুনিয়ায় বিস্মিত হবার বোধ মানুষের অবশিষ্ট আছে কি না, তা আলবৎ ভাবার মতো। তবে এহেন সংযোগশীর্ষ সময়ে একটা কাগজমুদ্রিত পত্রিকার সঙ্গে সংলগ্নজন সকলেরই বিষয়গাম্ভীর্য ও বিষয়বৈচিত্র্যগত ভারসাম্য বজায় রেখে পত্রিকাটাকে পাঠকপাতের উপযোগী করে প্রকাশের চ্যালেঞ্জ আগের যে-কোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি। ‘ঘাস’ অবশ্য মোটের ওপর ভালো ও উন্নত উৎপাদন হয়েছে। এতটাই ছিমছাম ছাপা-বাঁধাই-প্রচ্ছদের মার্জিত মনকোমল পত্রিকা বহুদিন বাদে দেখা গেল।

কবিতা লিখেছেন ১২ জন কবি। এর মধ্যে একজনের কবিতা ছাপা হয়েছে ‘দীর্ঘ কবিতা’ সাইনবোর্ডের তলায়, যেখানে আছে “কিনেছি সংস্কৃতি / উদার ঐতিহ্য / মুদ্রার অহঙ্কারে ভেঙে গেছে ধর্ম / ভেঙে যাক বর্ণ ও প্রথা” ধাঁচের লাইনঘাটের সোজাসাপ্টা প্রাপ্যতা। হাবাগোবা। কারো-না-কারো এইসব উচ্চারণ ভালো লাগে নিশ্চয়; এডিটরের তো বিলক্ষণ লেগেছে।

এক-ডজন কবির মধ্যে একজনের কবিতা আলাদাভাবেই উল্লেখ্য, মুহম্মদ ইমদাদ সেই কবির নাম, কবিতার তারিফ করার সময় সংখ্যার স্বল্পতা/প্রাচুর্য প্রসঙ্গ হওয়া বাহুল্য জেনেও বলছি যে এই কবির গোটা-বারো কবিতা ‘ঘাস’ বর্তমান খণ্ডের প্রকাশ স্মরণীয় করে রাখবে পাঠকের কাছে। এই কবিতাগুলো পড়ে ফের একবার বহুকাল-ধরে-বিরক্ত মহাভারতীয় (পড়ুন পশ্চিমবঙ্গীয়) ফর্ম্যাটে লেখা বাংলাদেশজ কবিতায় বীতশ্রদ্ধ পাঠক পুরনো অনুরাগ ফিরে পাবেন বলিয়া আশা ব্যক্ত করা যায়। এছাড়া আরও কয়েকজনও স্বস্তিকর সুন্দর পঙক্তি লিখেছেন অবশ্য।

‘কবির কথা, কবিতার কথা’ শীর্ষক একটি বিভাগের আওতায় তিনটা আত্মকথনধর্মী গদ্য পত্রস্থ হয়েছে, যেখানে কবিতাপাঠ ও কবিদের ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা নিয়া আলাপ যথাবিস্তারেই করেছেন কবিত্রয় আলাদা তিন রচনায়। এর মধ্যে, এবং গোটা কাগজের মধ্যেও, সবচেয়ে হতভম্বহাস্যকর রচনাটার নাম ‘আমার বাবার বাঁশি’। নিজের গরিবি নিয়া আহা-উহু মহীয়ান গাথা গাইবার গদ্য যিনি লিখতে পারেন, তার কবিব্যক্তিত্ব লইয়া আমরা সংশয়ী না-হয়ে স্যাল্যুট করিয়াই বিদায় দেই নগদে। ঘেঁচু-কচু খেয়ে উপাস-ধাপাস করে একদিন ইশ্কুলমাশ্টার হয়ে ঢের পয়সাপাত্তি ইনকাম করেও কবিবর অদ্যাবধি গরিবি গিটার বাজাইয়া যাইছেন, গদ্যে এই কথাটাই বিতং করে বলেছেন কবি বেচারা। ব্রাভো! সম্পাদকের দায়িত্ব কবিকে সেন্সর না-করা, তা তিনি দায়িত্বজ্ঞানের পূর্ণ পরিচয় রেখেছেন বলেই প্রমাণিত। অন্য দুটো কবিকথনমূলক গদ্য ঝঞ্ঝাটহীন পড়ার মতো, সুন্দর, সুখপাঠ্য।

গদ্য প্রসঙ্গে ১/২টা বাক্য অধিক কহতব্য। পত্রিকার পয়লা লেখাটাই একটা গদ্য। সুদীর্ঘ। সুন্দরও। কথা হচ্ছে, লেখাটার উপর সাইনবোর্ড টাঙানো ‘মুক্তগদ্য’। পত্রিকার অন্য গদ্যগুলোর চেয়ে এর ভিন্নতা আছে বৈকি, ভিন্নতা প্রত্যেকের আলাদা থাকেই, কিন্তু মুক্ত-রুদ্ধ যুগ্মবৈপরীত্য পদের পরিচয়ে সেই ভিন্নতা মাপা/টানা ন্যায্য মনে হয় না। তা-ও বুঝে নেয়া যায় লেখকের/সম্পাদকের শখ/অভিরুচি ইত্যাদি তিতপুরানা মানদণ্ডে ফেলে। কিন্তু রচনা প্রকাশকালে রীতিমতো ফর্ম্যাটের মেকাপ্-গেটাপ্ দিয়াও গদ্যের বিশেষত্ব বোঝানোর ব্যাপারটা হা হয়ে দেখবার মতো। কবিতায় এই বিতং অনেকদিন রাজ করেছিল, নব্বই দশকী কবিতায় ‘রানিং ফর্ম্যাট’ পরিচয়ে একটা ছাঁদের গদ্যস্পন্দী জিনিশে বঙ্গবাজার ছেয়ে গিয়েছিল, মার্জিন্ দুইদিক থেকে চেপে ঠেসে এক-ধরনের কের্দানি। কিন্তু কবিতায় ভিশ্যুয়ালাইজেশনগত নন্দনরক্ষার খাতিরে এইটা মান্যিগণ্যি করা গেলেও গদ্যে এই জিনিশ চালু হলে তো মুসিবত। তবে এই ব্যাপারটাও নজরে এত বাজত না যদি পত্রিকার অন্য গদ্যগুলোও অনুরূপ বিন্যাসে ছাপানো হতো। পত্রিকায় একটা লেখা ছাপানোর সময় পাঠকের ওপর নেহায়েত আস্থা রাখতে না-পারলে ‘এস্পেশ্যাল্’ লেখা চেনায়ে দেয়ার ব্যাপারে এডিটোরিয়্যালে ১/২ কথায় সেইটা ‘আলোকিত’ করার রুসম্ দুনিয়ায় চালু রয়েছে এখনও। প্রতিবেদকের বিবেচনায় এখানকার গদ্যগুলো প্রত্যেকটা আলাদা আদলের ভালো, অথবা আলাদা মর্তবায় ভালো-মন্দ মিশ্রিত।

সম্পাদক নাজমুল হক নাজু কর্তৃক পত্রিকাটি সিলেট থেকে বেরিয়েছে। এর দাম বাংলাদেশী মুদ্রায় ৫০.০০ (পঞ্চাশ টাকা) মাত্র। প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ছবির শিল্পী শাহ্ আলম। মুদ্রণসৌকর্য ও সার্বিক উৎপাদনমানের কারণে, এবং অবশ্যই সম্পাদকীয় নিক্তির পরিমিতিবোধের কারণে, এন্তার ভিড়ের ভিতরেও পত্রিকাটা পাঠকের নজর কাড়বে।

এইটা বাইর হয়েছিল ২০১৫ ডিসেম্বরে, বা তার পরের মাস ২০১৬ জানুয়ারিতে। এখন কি আর মাটি খুঁড়ে এর কোনো হদিস করা যাবে? এডিটরের খাটের চিপায় পাওয়া যাইলেও যেতে পারে। এবং যারা কালেক্টর তাদের কাছে তো থাকবেই। কিন্তু বাজারে এই কিসিমের পত্রিকাগুলো কোনোদিনই পাওয়া যায়নি, লিটলম্যাগের কথিত স্বর্ণযুগেও এইগুলা বাজারে পাওয়া যাইত কদাচিৎ। কিন্তু বেরোত, দেদারসে বেরোত, যখন যেমন, করার নাই কিছু, সময় পাল্টায়।

প্রতিবেদন / মাহি রহমান

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you