লন্ডন ১৯৭১ : প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের স্বল্প-আলোচিত অধ্যায় || ইমরান ফিরদাউস

লন্ডন ১৯৭১ : প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের স্বল্প-আলোচিত অধ্যায় || ইমরান ফিরদাউস

“ইতিহাস তাৎপর্যময় বস্তু। ইতিহাস অজানা থাকলে ধরে নেয়া যায় আপনার জন্ম হয়েছে মাত্র গতকাল। আর আপনি যদি গতকালই জন্মে থাকেন … তবে, যে-কোনো ব্যক্তি আপনাকে যা-ইচ্ছে তা-ই বোঝানোর ক্ষমতা রাখে। কেননা, আপনার যেহেতু আগের ‘ইতিহাস’ নেই, সেহেতু বক্তব্য যাচাইয়ের রাস্তাও আর খোলা নেই।” — হাওয়ার্ড জিন, মার্কিন ইতিহাসবিদ, সমাজসমালোচক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বয়ানে রাজনৈতিক ও সামরিক ‘যুদ্ধ’ যতখানি জায়গা পেয়েছে, ততখানি জায়গা পেতে দেখা যায় না স্থানীয় বা প্রবাসী নাগরিকদের প্রতিবাদসমাবেশ, প্রতিরোধ আয়োজনের উদ্যোগগুলো। ফলে, অনেক ঘটনার হদিশ যখন কর্তৃত্বশীল ইতিহাসের বয়ানে গরহাজির থাকে, তখনও অনেক ইতিহাস আলগোছে বেঁচে থাকে ফটোগ্রাফের ফ্রেমে, ড্রয়িঙরুমের দেয়ালে অথবা আলমারির দেরাজে।

তেমনই একটি ঘটনা হিসেবে আমরা স্মরণ করতে পারি — ১৯৭১ সনে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের (তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তান) স্বাধীনতা, স্বাধিকারের পক্ষে এবং বাঙালিদের উপর (পশ্চিম)পাকিস্তানিদের চালানো নির্মম গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের মুহুর্মুহু প্রতিবাদ-বিক্ষোভের সময়টি। সেসময় লন্ডন, ম্যানচেস্টার, ল্যুটন, বার্মিংহাম, ওল্ডহাম, ব্রিস্টল সহ প্রায় প্রতিটি শহরের বাঙালিরা পাকিস্তানের আগ্রাসনের তীব্র প্রতিবাদ করেছে, পথে নেমেছে, রাজপথ কাঁপিয়েছে।

london 1971

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণার পর লন্ডন হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের কূটনৈতিক সদর। বিশ্ববাসীকে বাঙালিদের লড়াই-সংগ্রাম-গণহত্যা-শরণার্থী জীবনের খবর জানানোর মিশনে প্রবাসী বাঙালিরা পালন করেছে বিশেষ ভূমিকা।

লন্ডনকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন, তহবিল তৈরি, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন — পুরো সময়কাল নিয়ে ‘লন্ডন ১৯৭১’ শিরোনামের এই আলোকচিত্র ও ঐতিহাসিক স্মারক বস্তু প্রদর্শনীর আয়োজন।

আরো স্মরণ রাখি, আন্দোলনের আলোকচিত্র ও স্মারক বস্তুগুলো সংগৃহীত হয়েছে ব্যক্তি-উদ্যোগে।

যদিও প্রবাসী বাঙালিদের এই ভূমিকার খবর আমাদের কাছে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে রক্ষিত নেই। কিন্তু সৃজনশীল লেখকরা কেউ কেউ ইতিহাসের এই উপাদানকে ব্যবহার করেছেন তাদের রচনায় পরম মমতার সাথে।

যেমন, ইন্ডিয়ার সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসে একাত্তরের ১ আগস্টে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে চার-পাঁচ হাজার বাঙালি-অবাঙালির প্রতিবাদসমাবেশের কথা চিত্রিত করেছেন প্রামাণ্য আকারে।

১ আগস্ট ১৯৭১ আরেকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের ইতিহাসে। কারণ, একই দিনে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে আয়োজিত হয় ঐতিহাসিক কনসার্ট ফর বাংলাদেশ; যা থেকে প্রমাণ হয় — পাকিস্তানের ন্যাক্কারজনক আচরণ কোনো সচেতন মানুষ মেনে নেয়নি, তিনি যে দেশের বা আদর্শের নাগরিক হয়ে থাকুন না কেন!

এই লড়াইয়ে বাঙালির অন্যতম শক্তি ছিল তার সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়।

london 1971

‘লন্ডন ১৯৭১’ শিরোনামের এই প্রদর্শনীতে ঠাঁই-পাওয়া আলোকচিত্রমালা থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, — প্রবাসী বাঙালি নারীরাও জনমত গঠনে, তহবিল গঠনে কাজ করেছেন সমানভাবে। তারাই যেন হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি সংস্কৃতির মূর্ত প্রতীক। পোশাক হিসেবে তারা বেছে নিয়েছিলেন শাড়ি। সঙ্গে করে এনেছিলেন শিশুসন্তানদেরও। তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন প্রতিবাদী প্ল্যাকার্ড।

london 1971প্রদর্শনীর আলোকচিত্রগুলো আমাদের নজর নিবদ্ধ করে সমাবেশে আসা প্ল্যাকার্ড, ব্যানার আর ফেস্টুনের ভাষার প্রতি। যেনবা, নীরব ফটোগ্রাফগুলোর খাঁচা ছিঁড়ে প্ল্যাকার্ড, ব্যানার আর ফেস্টুনের অক্ষরগুলো চিৎকার করে জানাচ্ছে “নট এ পেনি নট এ গান / ইয়াহিয়া-ভুট্টো-টিক্কা খান”; ওয়ার্ল্ড পাওয়ার, অ্যাক্ট ফর হিউম্যানিটি; স্টপ জেনোসাইড, রিকগনাইজ বাংলাদেশ…!! তথা, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ধিক্কার।

এই প্রদর্শনীর অধিকাংশ আলোকচিত্র রজার গোয়েন এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ইউসুফ চৌধুরীর তোলা। তরুণ রজার গোয়েন ষাটের দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশে স্বেচ্ছাসেবী হয়ে এসেছিলেন, প্রচুর ঘুরেছেন সেসময়, ছবি তুলেছেন প্রচুর, জড়িয়ে পড়েছেন এদেশের সাথে মায়ার আবেগে। ১৯৭১-এ তিনি লন্ডনে ছিলেন, নিজ দায়িত্বে ডকুমেন্ট করেছেন আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলো। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইউসুফ চৌধুরীরও ছবি তুলে ও সংরক্ষণ করে বাঁচিয়ে রেখেছেন অগ্নিঝরা সময়ের আবেশ।

প্রদর্শনীর ছবিমালা আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় এক অদেখা সময়ে, জানিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধ মানে ছাত্র-জনতার সংগ্রাম। ব্যক্তিগত অর্জনের এই সময়ে যখন নাই কোনো দলগত উপার্জন, তখন প্রবাসী বাঙালিদের সামষ্টিক ভূমিকার এই ইতিহাস আমাদের ফিরে তাকাতে আহ্বান করে স্ব-চেতনার প্রতি। মনে করিয়ে দেয় অতীত মানে ফেলনা নয় বরং তা আগামী দিনের বেঁচে থাকার অঙ্গীকার।

[metaslider id=”5727″]

* এই রচনাটি লন্ডন ১৯৭১ : আলোকচিত্র প্রদর্শনী-এর বক্তব্যরূপে লিখা করা হয়ে থেকেছে। — লেখক

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you