মেটাফোরের ফোকর দিয়া বাস্তবের তীব্র উপস্থিতি || শিবু কুমার শীল

মেটাফোরের ফোকর দিয়া বাস্তবের তীব্র উপস্থিতি || শিবু কুমার শীল

রিজওয়ান  বাংলাদেশের সমকালীন মঞ্চনাটকের শক্তিশালী স্বাক্ষর। বা বলা যায় প্রতিবাদী, মানবিক দৃষ্টিবোধসম্পন্ন এবং বর্তমান দুনিয়ার প্রেক্ষাপটে ইসলাম ও সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ক চূড়ান্ত রাজনৈতিক আখ্যান। আর্টে মেটাফোর কখনও বিষয়বস্তুকে আড়াল করে কখনও তীব্রভাবে হাজির করে। রিজওয়ানে নাট্যকার দ্বিতীয় পন্থাই বেছে নিয়েছেন। আর্ট ফর আর্টস্ সেইক্-এর খপ্পর থেকে বেরিয়ে নাট্যকার তার নিজের যন্ত্রণাটুকু উগরে দিয়েছেন। এই পৃথিবীর মাটিকেই তিনি জান্নাতের মর্যাদা দিয়েছেন। এমন সরল কথাটুকু বলবার জন্য বেছে নিয়েছেন আর্ট-এর মোস্ট চ্যালেঞ্জিং ফর্মটিকে। খেলেছেন শিশুর আনন্দেই।

বর্তমান বিশ্বে ইসলাম প্রশ্নে দুটো মেরু তৈরি হয়েছে, — যেখানে একদল এর কট্টরবাদিতাকেই রিপ্রেজেন্ট করে, আরেকদল এইসব নিয়ে রাজনীতি করে; বিদ্বেষের চাষবাস করে। এ-রকম একটা পরিস্থিতিতে নাট্যকার সৈয়দ জামিল আহমেদ প্রায় কুড়ি বছর পর, তার অনন্য নির্মাণ বিষাদ সিন্ধুর পরবর্তী দীর্ঘ বিরতির পর, ঢাকার মঞ্চে নিয়ে এলেন এক বিষাদগাথা। যেখানে উঠে এসেছে এক কাল্পনিক উপত্যকার কথা, রিজওয়ান নামে এক স্বপ্নের অপমৃত্যুর কথা, একটা স্বপ্নভুমি কিভাবে মৃত্যু-উপত্যকায় পরিণত হয় তার এক টাইমলাইন এই গল্পের মুখ্য বিষয়।

Rizwan Stage Drama

কোনো নির্দিষ্ট সময় বা জনপদের নাম নেননি নাট্যকার, তবে রাজনীতিসচেতন দর্শক মাত্রই বুঝবেন নাট্যকারের ইরাদা কি।

‘বিষাদ সিন্ধু’ থেকে ‘রিজওয়ান’ — এই দীর্ঘ যাত্রার এক অদ্ভুত পরম্পরার কথা ভেবে রোমাঞ্চিত হয়েছি। কারণ, কারবালার পটভূমি থেকে বর্তমান দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদের করাল থাবা এবং এর সঙ্গে ইঙ্গমার্কিনীদের আইএস বা জঙ্গিবাদের জুজু; যার কারণে সমগ্র ইসলামী জাহান আজ বহুধাবিভক্ত, নানাভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার। এমন এক সময় সৈয়দ জামিল আহমেদ এই সবকিছুর ভেতর আরেক বিষাদসিন্ধুর কান্না শুনতে পেলেন যার নাম দিলেন রিজওয়ান।

নাটকের মোদ্দা কথার বাইরে গিয়েও তার লাইট, কোরিয়োগ্রাফ, সাউন্ড, ব্লকিং … ইত্যাদিতে ভয়াবহ এক্সপেরিমেন্ট লক্ষ করি যা অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন লেগেছে। হাইটের আপ-ডাউন ফর্মটা অসম্ভব তাৎপর্যপূর্ণভাবে হাজির করেছেন নির্মাতা। মৃতদের কথোপকথনের ভিশ্যুয়াল ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। এছাড়াও কস্টিউম, এন্ড প্রপ্স ইত্যাদির ডিটেইলিং চোখে পড়ার মতো।

তবে অভিনেতারা অভিনয় যেমন অন্তর দিয়ে করেছেন তেমনি কসরতেও কম যাননি।

মিউজিক নিয়ে কেবল একটা কথাই বলবার আছে, — আর তা হলো, দাফের ইউসুফ-এর মিউজিক প্রায় আশিভাগ নাটকজুড়ে ব্যবহার করা হয়েছে যা বেশ শ্রুতিমধুর ও প্রাসঙ্গিক হলেও এ-রকম একটি মৌলিক কাজে এমন সুপরিচিত সংগীতের ব্যবহার এই কাজের গাম্ভীর্য কমিয়েছে। তবে নাট্যকার যদি শিল্পীর অনুমতি নিয়ে তা করে থাকেন তো অনেকটাই গ্রহণযোগ্য হবে।

বর্তমান যে-কোনো আর্টমিডিয়ামেই মাল্টিমিডিয়ার যে উপুর্যপরি ব্যবহার থাকে এই নাটক তা থেকে পুরোপুরি মুক্ত। আর্টের নামে কিছু বিমুর্ত সংলাপ আর কিছু বিক্ষিপ্ত দৃশ্যকল্পের নির্মাণ এই নাটকের উদ্দেশ্য ছিল না। নাট্যকারের দীর্ঘ সময়ের লালন-করা গল্প, আখ্যান, বিশ্বপ্রেক্ষাপট, তামাম দুনিয়াদারির চড়াই-উৎরাই তিনি দু-ঘণ্টার নাটকে হাজির করেছেন। আমরা আবার দেখলাম এই মহাজীবনের ভেতর কারবালা ফিরে ফিরে আসে। এই রিরংসা, ক্রোধ, ঘৃণার গোলকে কেউ কেউ তবু গড়তে চায় গোলাপবাগান।

গুণীন সৈয়দ জামিল আহমেদ এবং নাটবাঙলার কলাকুশীলবদের জানাই লাল সালাম।

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you