ভাষার স্বাতন্ত্র্য যত, দুনিয়ায়, এরচেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য। কোনো ভাবনা বা ভাব এক-দেশের ভাষা থেকে আর-দেশের ভাষায় নিতে গেলে, রূপান্তর ঘটাতে গেলে, বিশেষভাবে লক্ষ রাখা চাই দু-ভাষার মধ্যস্থিত সংস্কৃতির দিকটায়। একটা সংস্কৃতির সঙ্গে আরেকটা সংস্কৃতির মিলগুলো, অমিলগুলো, গরমিলগুলো লক্ষ করা আবশ্যক। দূরত্ব রয়েছে একের সনে অন্যের, তবে সেই দূরত্ব দুর্লঙ্ঘ বা অনপনেয় নয়। এইটা আদৌ চলতে-ফিরতে গেলে, এই দুই কালচারের ধারক ও বাহকের আচরণিক অভিব্যক্তিতে, তেমন সমস্যা হয় না। ভাষায় ক্যাপ্চার করতে গেলে চ্যালেঞ্জটা টের পাওয়া যায়। এবং তখনই অনুভূত হয় যে, ভাষার ওয়ার্ডিং-সিন্ট্যাক্সিং প্রভৃতি বিষয়ে স্কিল থাকলেই ভাষান্তর হয় না। বেশিরভাগ অনুবাদক, তর্জমাকারী, গায়ের জোরে নিজেরে একপ্রকার প্রতিষ্ঠা করতে চান রচনায়, বিশেষত তর্জমাকাজে। তেমন ফায়দা আখেরে হয় না, খাইতেই হয় ধরা কারো-না-কারো কাছে, একসঙ্গে না-হোক একে একে অনেক পাঠকের কাছে। এইটা তো অবহিত করা লাগে না যে, একেকটা ভাষার গতিবিধি-চালচলন-হাবভাব-ফস্টিনস্টি একেক রকম, লব্জ আলাদা আলাদা, রোয়াব ও রঙতামাশা আলাদা। এবং ঘটনাগুলো প্রায়শ উঠে আসে সে-ভাষার মানুষের যাপিত জীবন থেকে। এর বাইরে, যাপনের বাইরে, কিছুই তো নেই। যাপিত জীবনের আবার মুখ্যত দুটো স্তর দেখতে পাই। বহিরঙ্গের একটি, যেইটি কি-না বাইরের ব্যাপার বা বহিরস্থিত, আরেকটি স্তর ভেতরের। ভেতরের স্তর, তথা মানসগড়ন বা মনোজগৎ, সরল-স্বচ্ছ হইলেও তর্জমা দুঃসাধ্য সবসময়। একজন-কোনো ব্যক্তির যেমন মন ছুঁতে-ছুঁতেও পুরো ছোঁয়ার দাবি করতে পারে না এমনকি তার মনের মানুষটিও, একটা জাতির বা একটা ভাষাগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তো ব্যাপারটা আরও সত্য। ভাষান্তরকারী যত দক্ষ ও যোগ্য ও যত সৃজনানুভবীই হোন-না কেন, অনুবাদিত বাক্যটিতে (ধরা যাক যে-কোনো বাক্য) মূল ভাষায় ব্যক্ত বক্তব্য/ভাবটিকে পুরোপুরি ব্যঞ্জনায় ধরতে পেরেছেন এমন কোনো দিব্যি তিনি দিতে পারেন না। এর মূলে একটা বড় কারণ, তিনি যতই-না ভাষাদিগগজ সুপণ্ডিত হোন, ভিনভাষার সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে যত দখলই থাকুক তার, সমস্তকিছুর পরেও, সেই ভিনসংস্কৃতির ভাষামাধ্যমে ব্যক্ত বিষয়াশয়সমূহ সম্যক উপলব্ধিতে জারিত করে ফের তার মাতৃভাষায় নিয়া আসা শেষবিচারে আসান-অসাধ্য মুশকিলের কাজ বৈকি। এবং সম্ভব হয়ও না সবকিছু। যেমন সুপারি-পান তথা তাম্বুল চাবায়ে যে-রস গ্রহণ করেন আমাদের ভূখণ্ডের নারী-পুরুষেরা তাদের অবসরে বা কাজের ফাঁকে-ফাঁকে, সেই রসের ব্যঞ্জনা বাংলা থেকে ইংরিজিতে ট্র্যান্সফর্ম করা সাধ্যাতীত না-হলেও অসম্ভবপ্রায় নয় কি? তাম্বুলসেবন ব্যাপারটা যেহেতু আংরেজ কালচারে নেই, তো বোঝাবেন কেমনে! একটা ট্রাইব্যাল ল্যাঙ্গুয়েজে সেইটা ট্র্যান্সমিট করা সহজতর হতে পারে। এবং ইংরিজিতে খুব খেটেখুটে বুঝাইলেও বোধগম্য হবে ওদের স্বাদেন্দ্রিয়ে, সেই নিশ্চয়তা নাই। কারণ তো ওই একটাই। ওরা এই জিনিশের স্বাদ জানে নাই। ওদের জিভ এই ব্যাপারে উম্মি একদম। বহুকিছুই আছে এমন। যেমন পির-ফকিরজনিত ভক্তিবিশ্বাসের নিরীহ অংশটুকু। অথবা যেমন বড়-বোনের স্বামীর সঙ্গে বা বড়-ভাইয়ের বৌয়ের সঙ্গে রঙ্গরসিকতার দিকটুকু। কাজেই অনুবাদককে একটা ভাষার শাব্দিক সাক্ষর হইলে হয় না, ভোক্যাব্যুলারি দিয়া তর্জমা হয় না, তাফসির হইতে পারে। অনুবাদককে হইতে হয় সেই বিদেশি ভাষাটায় সাংস্কৃতিক সাক্ষর।
লেখা / জাহেদ আহমদ ২০১৪
… …
- জনতার কাব্যরুচির প্রতীক || ইলিয়াস কমল - December 14, 2024
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
COMMENTS