ছোটকাগজ বড়কাগজ হাওয়াকাগজ || আহমদ মিনহাজ

ছোটকাগজ বড়কাগজ হাওয়াকাগজ || আহমদ মিনহাজ

বিগত মেইলে ছোটকাগজ নিয়ে আপনার কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণের কিছু নেই। পশ্চিমবঙ্গ কেন ছোটকাগজ প্রকাশনায় মান, বৈচিত্র্য ও ধারাবাহিকতায় চমকপ্রদ ঘটনা হতে পেরেছিল সেটা আপনি আমার চেয়েও ভালো জানেন। সেখানে ছোটকাগজ ব্যাপারখানা নিজেকে সাংস্কৃতিক ঘটনায় পরিণত করতে পেরেছিল বলে ভাবনা-পরিকল্পনা-পেশাদারিত্ব এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার চরিত্র নিয়ে নিজেকে হাজির করতে পেরেছিল। আমাদের এখানে ছোটকাগজ তো সেই জায়গায় পৌঁছানোর আগেই অন্য দিকে মোড় নিতে থাকে! সেই মোড় ফেরার ক্ষতিপূরণ আজও ঘটেনি। তবে এটা ঠিক, একেকজন লম্বা রেসের ঘোড়াকে কতিপয় বেকুফ মিলে আষ্ঠেপৃষ্ঠে পিষে মারার যে-তুলনাটি দিয়েছেন তার বিপক্ষে সত্যি বলার কিছু নেই! আমাদের এখানে সম্পাদনা দাঁড়াতে পারেনি বলে ছোটকাগজও কালচার হয়ে উঠতে পারল না। গোষ্ঠীপ্রীতি একটি ছোটকাগজের জন্য অন্তরায় মনে করি না। এর চরিত্রে ক্ল্যান টাইপের ট্রাইব্যাল ব্যাপারস্যাপার একদম মজ্জাগত। কথা হলো অসংখ্য ট্রাইব যদি সম্পাদনা ও সাংগঠনিকতায় মজবুত হয় তবে ভাবনা, সৃজনশীলতা ও প্রকাশনার বৈচিত্র্য সেখানে আপনা থেকে ঘটে। পশ্চিমবঙ্গে এটা বাংলাদেশের চেয়ে ভালোভাবে ঘটেছিল সেই সময়। এখন অবস্থা কেমন জানি না। দশকে-দশকে সেরকম সম্ভাবনা জাগিয়েও ছোটকাগজ কেন যেন বাংলাদেশে সেই উত্তরণের দিকে হাঁটতে পারেনি! এখন আর পারবে বলে মনেও হয় না।

ব্যক্তিগতভাবে ছোটকাগজ আমার কাছে লেখা প্রকাশের ‘মাধ্যম’ ছাড়া অন্য কিছু নয়। প্রেসে মুদ্রিত একটা ‘অকির্ড’ যেমন মাধ্যম, অনলাইনে প্রকাশিত গানপারও তা-ই। সময়ের সঙ্গে মাধ্যমে রদবদল আসে এবং নিজেকে সেখানে অভ্যস্ত করে নিতে হয়। যেমন আমরা সকলে কমবেশি এখন অনলাইনে অভ্যস্ত হয়েছি। এতে সমস্যার কারণ দেখি না। ঝামেলা বাঁধে মাধ্যম নির্বাচনে। সেই সময় আমি-আপনি সকলে কিন্তু লেখার এমন এক প্ল্যাটফর্ম খুঁজছিলাম যেখানে তারুণ্যের দীপ্তি থাকবে, ভাবনার বৈচিত্র্য ও খোলা মনে কথা বলার স্বাধীনতাটি থাকবে, পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ আর সব মিলিয়ে পাঠচক্র তৈরি হওয়ার মতো ঘটনা সেখানে প্রবল হয়ে উঠবে ইত্যাদি। আমাদের ছোটকাগজে গমনের বড় কারণ কিন্তু সেটাই ছিল। অন্যথায় বড়কাগজে যেতে তো বাধা ছিল না! লেগে থাকলে সেখানে একটা জায়গা আমাদের কি জুটত না? ঠিকই জুটত, যেমন অনেকের জুটেছে বলে শুনতে পাই। অথচ দেখুন, আমাদের মতো অনেকে কিন্তু সেই সময় এটা ভাবেননি যে তারা সেখানে যাবেন। কারণ একটা আশা আর উদ্দীপনা তো শুরুর দিনগুলোয় ছিল, সেটা অস্বীকার করি কী করে! যারা লিখতেন তারা পরস্পরকে সত্যি পাঠ যেতেন, পরস্পরের খবর নিতেন, পরিসর ছোট ছিল কিন্তু এই পারস্পরিক পঠনের মধ্য দিয়ে ঘাটতি পুষিয়ে যেত। পাঠচক্র সৃষ্টির সম্ভাবনাটি জেগে উঠছে বলে মনে হতো তখন। দুঃখ হয় ভেবে বিনিময়টি পরে আর ধরে রাখা যায়নি।

লেখক নিশ্চয় চায় তার লেখা লক্ষ-কোটি জনতা পড়ুক। কিন্তু সে জানে, বাস্তবে সেরকম ঘটনা ঘটবে না অথবা ঘটনাটি ঘটাতে হলে অনেকভাবে তার নিজেকে বদলাতে হবে, তারপরেও হয়তো হবে না … কারণ আমজনতার পাঠকপ্রিয় লেখক হওয়া একধরনের আকস্মিক ঘটনা, দুর্ঘটনাও বলতে পারেন, সবার কপালে জোটে না! আবার যদি জোটে সে-কারণে উক্ত লেখক সাংঘাতিক কিছু, তেমনটি না-ও হতে পারে। বাংলাদেশে জনপ্রিয় পাঠকপ্রিয় লেখকরা কতটা বা কী মানের সাংঘাতিক সে-ব্যাপারে যত কম বলা যাবে তত শান্তি!

ছোটকাগজে যারা সেই সময় লিখতেন সংখ্যায় হাজার দুই-তিন হলেও তাদের মধ্যে নিজের মতো করে সেতুবন্ধ শুরুর দিকে তৈরি হতে দেখেছি। ওটা বজায় রাখা গেলে একসময় হয়তো স্রোত তৈরি হতেও পারত, পশ্চিমবঙ্গে আমরা একসময় যেমন ঘটতে দেখেছি। এই যে হলো না, তার কারণে দশকের-পর-দশক ধরে ছোটকাগজ প্রকাশের নামে আবর্জনার স্তূপগুলো তৈরি হয়েছে বা এখনও বিচ্ছিন্নভাবে হয়েই চলেছে। মোস্তাককে [মোস্তাক আহমাদ দীন, কবি] আমি নিজে এ-নিয়ে বিরক্ত হতে দেখেছি। যদিও তার ভাবনা দেখাসাক্ষাৎ সেভাবে হয় না বলে বিস্তারিত জানার সুযোগ ঘটেনি।

ছোটকাগজ বাংলাদেশে দশকে-দশকে দেখা দিয়ে এবং আশার বুদবুদ তুলে কেন নিরাশা ও তিক্ততায় বিলীন হয় সে কিন্তু আমি-আপনি সকলে কমবেশি জানি। তবু রিপিট করছি : — শুরু থেকে কমিটমেন্টর অভাব পীড়াদয়াক ছিল এবং এখনও তাই! ব্যতিক্রম বাদ দিলে সম্পাদক ও প্রকাশক হয়ে যারা এখানে এসেছেন তারা স্কুল-কলেজে একসময় স্মরণিকা প্রকাশ করতেন, সেই জায়গায় তাদের সম্পাদকীয় বোধ আটকে ছিল এবং সেখান থেকে উত্তরণের চেষ্টা তারা করেননি। তো এরকম সব সম্পাদক আর প্রকাশকের পাল্লায় পড়ে যে-মাধ্যম নিজেকে সাজায় সেখানে সৃষ্টিশীল লেখক কতদিন আর গাধার খাটনি দেবে! সময়ের সঙ্গে সে হয়তো নিজে ভোঁতা হয়েছে নতুবা বড়কাগজে রাস্তা খুঁজে নিয়েছে। যদিও খুঁজে নেওয়ার পর তার কি ঘটেছিল বা কতটা কী তরক্কি সেখানে গমনের সুবাদে অর্জন করেছে … কী বলব, আমি সেটা সত্যি জানি না!

ছোটকাগজ করতে গিয়ে সময় নষ্ট হয়েছে এমনটি মনে করি না। সেখানে লিখতে গিয়ে, প্রুফ দেখতে গিয়ে, প্রেসে কাগজ ছাপা হতে দেখে রক্তের মধ্যে একধরনের বুনো আনন্দ তো ছলকে উঠেছে সেই সময়! মনেই থাকেনি কার হয়ে কী খাটনি দিচ্ছি। যদিও এটা ঠিক, যত দিন গিয়েছে রক্ত ঠাণ্ডা হয়েছে আর মনে জমেছে ক্লান্তি ও বিষাদ! আমার ক্ষেত্রে (এবং বিশ্বাস করি আপনি বা আরও অনেকের বেলায় সত্য ভিন্ন নয়) তা এ-কারণে, আমরা এমন এক সমাজে বসে কাগজ চালাই যেখানে কোনও কিছু আসলে দাঁড়ায়নি! ভিত্তিই গড়ে ওঠেনি বলা যায়! ছোটকাগজে সত্যিকারভাবে লিখতে গেলে প্রতিটি লেখা পাঠের জন্য যাদের দরকার সেই পাঠকরা তৈরি নয়। লেখকরা সেখানে নিজে আর পাঠক নয়। সম্পাদকগুলো স্মরণিকায় বন্দি। সংগঠক এখানেও রাজনীতির ধান্দা খোঁজে। ওদিকে বিদ্যায়তনগুলো গু-গোবর গেলানো ছাড়া কিছুর চর্চা করে বলে তো মনে হয় না! তো সব মিলিয়ে পাঠক তৈরির জায়গাই তো নেই পোড়ার এই দেশে! এরকম পাঠ ও পাঠকশূন্য সমাজে নিরীক্ষা ও নতুনত্ব আসবে কোথা থেকে! কমিটমেন্ট ধসিয়ে দিতে এগুলো যথেষ্ট ছিল তখন, তাই নয় কি?

তবু, সত্যি বলছি ছোটকাগজকে এখনও ভালোবাসি। আমার সেই ভালোবাসা কতকটা স্বপ্নের মতো; যা নেই যা আজও ঘটেনি তবে একদিন ঘটবে এরকম এক কাগজের স্বপ্ন দেখি। প্রেসে মুদ্রিত হতে হবে এমন কোনও কথা নেই। ‘মেঘচিল’ [ওয়েবম্যাগ, সম্প্রতি এই পত্রিকাটা সেলিম মোরশেদ সংখ্যা পাব্লিশ করেছে। অত্যন্ত পরিশ্রমী ধীমান সংখ্যাটি ক্লিক করে যে-কেউ চোখ বুলাতে পারেন] যেভাবে করেছে সেভাবেও হতে পারে। আমি জানি স্বপ্নটি আপনারাও দেখেন। নতুবা ‘গানপার’ হতো না।

মাধ্যম বদলে এই যে ওয়েবে আমাদের গমন ঘটল, সেখানে কি পরিস্থিতি খুব পাল্টেছে? আপনি আমার চেয়ে ভালো জানেন কতটা কী পাল্টেছে। এই মাধ্যমে আপনাদের খাটনি তো স্বচক্ষে দেখতে পাই প্রতিদিন। প্রতি দশকের শুরুর কয়েক বছর পরে ছোটকাগজ পাঠে পাঠকের উৎসাহে তখন ভাটা পড়তে দেখেছি। দু-চারজন ছাড়া কেউ আর উল্টেপাল্টে দেখত না। গণপাঠক তো কোনোদিন জানতেই পারেনি বস্তুখানা কী! এখন ছবিটা কি বদলেছে? আমজনতা কি ওয়েবে লেখার কন্টেন্ট ও কোয়ালিটির তালাশে ক্লিকবাজি করে? সে কি আসলে কিছু পাঠ যায়? গণপাঠক বাদ দিন, ছোটকাগজে যারা লিখতেন তারা এক সময় পরস্পরকে পাঠ যেতেন, ওয়েবে যারা লেখেন তারা কি সেরকম পঠনে নিবেদিত এখন? যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে কবিতার একটি সত্যিকার অনলাইন প্ল্যাটফর্ম হলো না দেখে আপনার যে-হতাশা সেটা কিন্তু থাকত না। নানারকম পুষ্পে ওয়েব ভরে উঠত, বিদেশে যেমনটি উঠেছে!

বলা হয়তো ঠিক নয়, কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির ওয়েবযাত্রাও প্রকারান্তরে ছোটকাগজযাত্রার পরিণতি থেকে ভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা দেখি না। পাঠক নেই! লম্বা-ছোট কোনো লেখাই আসলে কেউ পড়ে না। পড়লে তার পরিচয় ঠিক বোঝা যায়। আমার-আপনার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সম্ভবত এতটা খারাপ নয় যে ধরতে পারব না। ছোটকাগজের মতো এখানেও গৎবাঁধা লেখার স্রোতে গুচ্ছ-গুচ্ছ ভালো লেখা ঠিকই প্রকাশ পায় এবং দ্রুত হারিয়ে যেতে থাকে। আপনার মতো অনুসন্ধানীর চোখে হয়তো পড়ে কিন্তু সেরকম জহুরি ক’জন আছেন অনলাইনে? জহুরির সংখ্যা বড় হলে এতদিনে ওয়েবে বিপ্লব ঘটে যেত! ঘটেছে কি? ফলে এই তো হাল আমাদের! লেখক লিখে যায় তার নিজের তালে, সে নিজের লেখা নিজে পড়ে ফিরে-ফিরে, আর ওদিকে পাঠক হুমড়ি খায় অন্য কোনও বেতালে!

‘গানপার’-এ কতরকমের লেখা দেখতে পাই! বৈচিত্র্যে বোঝাই! সত্যি বলছি, আমি নিজেও প্রথমদিকে এতটা ধরতে পারিনি। এখন নিজে লিখছি বলে হয়তো যখন সময় করে ঢুকি, নানান লিঙ্কে ক্লিক করি, ছোট-বড় মিলে রকমারি জিনিস চোখে পড়ে! কিছু লেখা আশ্চর্য ভালো! কিছু আবার তারুণ্যের সেই অস্থিরতা ও সৃজনব্যাকুলতা মনে করিয়ে দেয়! অন্য অনেক সাইটেও ভালো লেখা নিশ্চয় প্রকাশ পায়। কিন্তু তবু কেন মনে হয় আসলে সেই বাঁধা গতে ঘুরছে বাংলাদেশ!

আমরা যারা লিখি এবং যারা হয়তো লিখি না কিন্তু পড়ি, তাদের সম্মিলিত পাঠজাগরণ ছাড়া সেই স্বপ্ন অন্তত এই দেশে ভাষা পাবে না যেটি (আমি জানি) আপনি নীরবে নিজের ভিতরে জারি রাখেন বহতা নদীর মতো করে। এরকম আরও কিছু মানুষ তারাও হয়তো এই স্বপ্ন জারি রাখেন ভিতরে। লেখক তার নিজের খেয়াল ও প্রয়োজনে লেখে এটা সত্য, তবে সমাজে সে-লেখার আবেদন তৈরি হয় না যতদিন পাঠক তৈরি হয়ে ওঠেন! লেখক নয়, পাঠকের জাগরণ আগে দরকারি। সেই পাঠক চাই লেখককে যে তার পাঠের ভিতর দিয়ে ছিন্নভিন্ন করতে জানে! আহা! সে-পাঠক আমার-আপনার মতো আরও অনেক ছন্নছাড়াদের জীবনে স্বপ্নেই বুঝি ঘুম যায় আজও! — যাদের মুখ কেবল ঝাপসা কাচের জানালা দিয়ে দেখা যায়, কিন্তু তারা আসলে মরীচিকা আর তাই ক্ষণপরে সুদূরে হারায়।


লেখকের সঙ্গে সাইটসঞ্চালকের ইমেইল কনভার্সেশনের অংশবিশেষ এই তাৎক্ষণিকা — গানপার

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you