“চেয়েছি একটা ছাপ রেখে যেতে”  : সাক্ষাৎকারে ম্যাক

“চেয়েছি একটা ছাপ রেখে যেতে”  : সাক্ষাৎকারে ম্যাক

মাকসুদ এমন একজন কণ্ঠশিল্পী, যার সাক্ষাৎকার নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। শিল্পীকে বুঝতে পারাই যদি হয় সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্য তাহলে বলা যায়, মাকসুদের গানগুলোই সাক্ষাৎকার হিসেবে যথেষ্ট। কারণ, তিনি কেবল গানের জন্যই গান করেন না। বরং তার নিজস্ব চিন্তা-দর্শন ছুঁড়ে দেন শ্রোতার দিকে। কেবল শ্রোতার দিকেই নয়, দর্শকের দিকেও। কারণ, মাকসুদ মনে করেন গান এখন কেবল শোনার বিষয় নয়, দেখারও। তার পরিচিতিটা ব্যান্ড সংগীত দিয়ে হলেও অন্যান্য সংগীতের অনেক গভীরেও তার সাবলীল বিচরণ। ফুটে উঠতে চান না তিনি, ফাটাতে চান। তার ভাষায় — আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু মেইক হেডলাইন্স, আই ওয়ান্ট টু মেইক হিস্টোরি, মিউজিক্যাল হিস্টোরি।

ব্যান্ড সংগীতকে যারা অপসংস্কৃতি বলেন, তাদের বিরুদ্ধে মাকসুদ বরাবরই সোচ্চার। মুখের সামনে মাউথপিস্ পেলে কাউকে ছেড়ে কথা বলেন না তিনি। যারা ব্যান্ড সংগীতকে অপসংস্কৃতি বলেন তাদের উদ্দেশে তার বক্তব্য — অপসংস্কৃতি খারাপ কিছু নয়। কোনো শব্দের সামনে ‘অপ’ যোগ করলে শব্দটি অপবিত্র হয়ে যায় না। যেমন — অপরূপ, অপূর্ব। সাম্প্রতিক সব বিষয়ে রয়েছে তার গভীর পর্যবেক্ষণ। শুধু পর্যবেক্ষণই নয়, তার সঙ্গে যোগ করেন তিনি তার নিজস্ব স্টাইলের সেন্স অফ হিউম্যর। সুদূর ইংল্যান্ড থেকে ঢাকায় আনা ডগ-স্কোয়াড সম্পর্কে তিনি বলেছেন — বিদেশী কুকুরগুলো আসায় আমি খুব খুশি। তাতে আমাদের দেশের কুকুরগুলো (!) কিছুটা শিক্ষা পাবে।

মাকসুদের সঙ্গে চলতিপত্রের সময় ছিল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট আগে উপস্থিত হওয়ায় কিছু সময় বসে থাকতে হয়েছে। এশার নামাজে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। তার স্টাডিরুমে আমাদের জায়গা হলো। কোনো চেয়ার-টেবিল নেই সেখানে। মেঝেতে তোষক-বালিশ পাতানো। ঘরে পুরোপুরি আসরের মেজাজ।

১০ মিনিটের মাথায় ঢুকলেন রুমে। সম্পূর্ণ কালো পোশাকে আবৃত। এমনকি মাথার টুপিটাও। মুখোমুখি হলেন চলতিপত্রের। পুরোটা সময় জুড়ে ঘরোয়া বৈঠকী ঢঙে তিনি বললেন অনেক কথা। সংগীত, সাম্প্রতিক রাজনীতি, দর্শন, ভবিষ্যদ্বাণী কিছুই বাদ যায়নি। রেকর্ডকৃত তার সাক্ষাৎকারটি চলতিপত্র ঈদসংখ্যার পাঠকের জন্য প্রায় হুবহু প্রকাশিত হলো।

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন চলতিপত্রের দুই কর্মী আমিনুল হাসান শাফিঈ এবং আলী ফিদা একরাম তোজো

কোন রঙের সেমাই আপনার পছন্দ — এসবে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই।
— আমিও ক্লান্ত। এসব কোনো প্রশ্ন হলো, বলুন?

হ্যাঁ, তাই আমরা ওইসব বিষয়ে কোনো কথা বলতে আজ বসিনি। আমরা মূলত আজ আপনার চিন্তা-দর্শন নিয়েই কথা বলবো। এর ফাঁকে নিশ্চয়ই নানা কথা আসবে, কি বলেন?
— হ্যাঁ, তাহলে রেকর্ডার অন করুন। আমি সত্যিই টায়ার্ড। কি কথা বলি, আর কি ছাপা হয় পত্রিকায়, আমার মাথায় ঢোকে না।

শুরুতেই আপনার কাছে প্রশ্ন, ব্যান্ড ভক্ত যারা তাদের সবাই মোটামুটি যুবক শ্রেণীর। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যুবকদের অবক্ষয়ই দিন দিন ঘটছে। এটা নিশ্চয়ই আপনারও অজানা নেই। কিন্তু এটা কি বলা যাবে, ব্যান্ড সংগীত সেদিকেও আদৌ নজর দিচ্ছে, কোনো অবদান রাখছে?
— যুবকদের আমি বলেছি, পৃথিবীতে বেড়াতে আসিনি আমরা, এসেছি অনেক কাজ নিয়ে। সব-সময়েই আমি কি জেনেছি, কি বুঝেছি তার একটা ছাপ রেখে যেতে চেয়েছি। এ-জন্যই আমার মনে হয়, নামডাক কতটা হলো, সেদিকে আমার নজর নেই। আমি চেয়েছি একটা ছাপ রেখে যেতে। যাতে যুবকরা কেউ চাইলে সেই ছাপ অনুসরণ করতে পারে। আমি তো আর কাউকে বাধ্য করতে পারি না আমার ব্যক্তিগত আদর্শে উদ্বুদ্ধ হতে। আমার প্রযোজনাগুলোর দিকে যদি কেউ গভীর চোখে তাকায়, তাহলেই একটা দিকনির্দেশনা বোধহয় পাবে। কি, পাবে না? ‘উল্লাস’, ‘মেলা’, ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’, ‘জোয়ার’, ‘দেহঘড়ি’, ‘বাউলিয়ানা’, ‘…নিষিদ্ধ’ — এর মধ্যে কি যুবকদের উদ্দেশে কিছু নেই? বরং পুরোটা যুবকদের জন্যই। আমি বিভিন্ন সময়ে বলেছি, যুবকরা সব দেশেই একটা বড় শক্তি। ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের যদি যুবকশ্রেণী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, তাহলে সংখ্যাগত দিক থেকেও এদেশের সবচেয়ে বড় শক্তিটা যুবকশ্রেণী। কে আমাদের লাফাঙ্গা বলে! কার এত সাহস! আমাদের ভেঙে পড়ার কিছু নেই। বরং যারা আমাদের তির্যক দৃষ্টিতে দেখে, প্রগতির দিকে পা বাড়ানোকে বেয়াদবি বলে, তারাই ভেঙে পড়বে।

কবে নাগাদ ভেঙে পড়বে, মাকসুদ ভাই?
— না, আমি দিনক্ষণ ঠিক করে কিছু বলছি না। তবে ভেঙে পড়বে, পড়তে বাধ্য। কবে ভেঙে পড়বে, আপনাদের মতো তথাকথিত প্রগতিশীলদের কাছ থেকে এ-রকম কথা শুনতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাদের মুরুব্বিরা ‘যুবক-টুবক’ এমনভাবে বলে, যেন যুবকরা সংখ্যালঘু প্রাণী। সমাজ মনে করে, যুবক মানে সবচেয়ে নিকৃষ্ট, বদমাশ, লাফাঙ্গা। যুবকদের আচরণ সবার কাছে দৃষ্টিকটু মনে হয়। কিন্তু কেন? আমরা যুবকরা আপনাদের কাছে স্ট্রেইট জানতে চাই — আপনারা কি করতে পেরেছেন আমাদের জন্য? আপনারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন। মনে করেন আমরা শিশু। দুদু খাই। কোলে নিয়ে আদর করে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখবেন। আপনারা ভুলে যাচ্ছেন, ১৬ ডিসেম্বর ৭১-এ যে শিশুটির জন্ম, তার বয়স আজ কত! সে আর খোকা-বাচ্চা নেই। সে আপনাদের চেনে। আপনাদের ভেতরের চেহারাটা সে ভালো করেই চেনে। আসলে এখন আমাদের কিছু বেয়াদবি শুরু করার সময় এসেছে। আমার প্রশ্ন, আপনারা আমাদের এই দীর্ঘ ২৮ বছরে কি দিতে পেরেছেন? কিন্তু দেখুন, এ-পর্যন্তু বিকল্প যা কিছু হয়েছে, আমরা তরুণরাই তা করেছি।

কি কি করেছে তরুণরা … একটু সুনির্দিষ্ট করুন।
— সুনির্দিষ্ট করলে তালিকা অনেক বড় হবে। উদাহরণ হিসেবে ধরুন সংগীত শিল্পটা আমাদের দেশে ছিল ক্ষয়িষ্ণু ধরনের। গানের প্রতি মানুষের আকর্ষণ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। একই জিনিসের প্যানপ্যানানি সারাজীবন তো ধরে রাখতে পারবে না শ্রোতাকে। ঠিক এই জায়গাতেই তরুণরা সৃষ্টি করেছে ব্যান্ড সংগীত। সম্পূর্ণ প্রতিকূল অবস্থায় থেকে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল কত মানুষকে গানের দিকে টেনে আনতে পেরেছিলেন, সেই প্রসঙ্গে না-গিয়েও বলতে পারি আমরা ১০ লাখ শ্রোতাকে আমাদের করে নিতে পেরেছি; যারা নিয়মিত ক্যাসেট কিনে গান শুনছে।

শুধু সংগীতেই তরুণদের অবদান?
— না, বললাম তো তালিকা অনেক লম্বা হবে। ধরুন আজকের সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের নাম কম্পিউটার। এখন বাংলাদেশে কম্পিউটার শিল্পের পেছনে যারা আছেন, তারা সবাই তরুণ। তরুণদের বাইরে আর কে আছে এক্ষেত্রে? এই তরুণরা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এভাবে হিসাব করলে দেখা যাবে, স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত ভালো কিছু যা হয়েছে সবকিছুর পেছনেই এই যুবকশ্রেণী।

দেখা যাচ্ছে, যুবকরা যে ব্যান্ড শিল্প গড়ে তুললো, সেই শিল্পের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হট্টগোল, গণ্ডগোল, এমনকি খুনখারাবির খবরও পাওয়া যায়। রবীন্দ্র সংগীতের আসরে তো এমনটা দেখা যায় না। এটা কেন হচ্ছে?
— অভিযোগটা সত্য, আবার সত্যও না। যেখানে মানুষের ভিড়, সেখানে গণ্ডগোল। ফুটবলমাঠেও তো গণ্ডগোল কম হচ্ছে না। তাই বলে কেউ ফুটবলের বিরুদ্ধে তো কথা বলে না। আবার পহেলা বৈশাখের যে মেলা বসে, সেখানে রবীন্দ্র সংগীতও হয়, সেখানে যে মেয়েদের শাড়ি টেনে খুলে চাপাচাপি করা হয়, সে-খবর তো আমরা সংবাদপত্রে পাই। ছবি সহ পাই। তখন তো রবীন্দ্র সংগীতকে দোষারোপ করা হয় না। আমাদের বড়ভাইরা তখন বলেন, না না, এটা রবীন্দ্র সংগীতের দোষ না। তাহলে ব্যান্ড সংগীতের দোষ হবে কেন? অন্যদিকে সংবাদপত্র, সংবাদপত্রের ভূমিকাটা আমার কাছে অনৈতিক মনে হয়। ব্যান্ড কনসার্টের কোনো ছবি ছাপলে তারা কয়েকটি নৃত্যরত মেয়ের ছবি ছাপায় বড় করে এবং শিল্পীর ছবিটি দেয় ছোট করে। এটা কোন ধরনের সাংবাদিকতা? আমি নিশ্চিত, আমি আশাবাদী, আর যা-ই হোক, আমাদের ছেলেরা মেয়েদের শাড়ি ধরে টানাটানি করার মতো অশ্লীলতা করে না।

সংবাদপত্রের ভূমিকার কথা বললেন। একটু ডিটেইল করবেন?
— সমস্যা হচ্ছে, সংবাদপত্র আমাদের কাছে কিছু শিখতে চায় না, আমাদের শেখাতে চায়। অথচ আমি জানি সংবাদপত্র কত বড় মূর্খ! অন্যদিকে আমরা আটকা পড়ে আছি সংবাদপত্রের হাতে। কারণ, কে কি করলো, তা বড় কথা নয়, বরং সংবাদপত্র কাকে জনপ্রিয় করে তুলবে সেটা তাদের এখতিয়ার। প্রেস্ তো আর আমার হাতে নেই।

আপনার গানে রাজনীতি অবহেলিত থাকে না কখনো। সবসময়ই আপনি দেশ, সমাজ, রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
— ওই একই। নেতানেত্রীরা কেউই আধুনিক মানসিকতার নন, যুবক মানসিকতার নন। যদিও প্রত্যেকেরই আছে যুবদল, যুবলীগ ইত্যাদি ইত্যাদি। দেশ নিয়ে কারো কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। কে রোজা রেখে মন্দিরে গেল, তা নিয়েই রাজনীতি হয়। আমাদের এসব কেন শুনতে হবে? কেন আমরা এই খবর পড়ে সময় কাটাবো। এরশাদের মতো ফাজিলটাকে নিয়ে দুই দল টানাটানি করে তাকে পুনর্বাসিত করছে। ওরা কি ৯০-এর ইতিহাস ভুলে গেছে? স্বৈরাচারকে কেন দুই নেত্রী কমপ্লিটলি ত্যাগ করতে পারছে না? হোয়াই দিস্ জেনাখোর, হোয়াই দিস্ হারামি এলিমেন্ট? কেন সে এখনও এদেশের নেতা হিসেবে থাকবে? ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ‘নেতারা’ সেই সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সংস্কৃতিসেবী বুদ্ধিজীবীরা আজ কোথায়? নাকি ইতিমধ্যে নতুন কোনো নোট চলে এসেছে পকেটে? এই যে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ওখানে আমি নেই কেন? আমি ওদের মানি না। আমাদের সংস্কৃতিমন্ত্রী, তিনি সংস্কৃতির কি জানেন? আমি তাকে ওপেনলি চ্যালেঞ্জ করতে পারি সংস্কৃতি বিষয়ের বিতর্কে। তিনি ভালো ইংরেজি বলতে পারেন না, ভালো বাংলাও না। সংস্কৃতি একটা দেশের স্নায়ু। সেই স্নায়ু রক্ষা করছেন তিনি। কিভাবে, তা বোঝার মতো বুদ্ধি আমার নেই।

আপনি তো সবার ওপরই ক্ষ্যাপা। সমাজ, মুরুব্বি, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সংবাদপত্র কেউই বাদ যাচ্ছে না। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নোংরা মনে করেন কাকে?
— আমাদের ক্ষতি আসলে কে করছে? নট ব্যান্ড মিউজিক, নট ড্রাগস, নট সেক্স, নট নাথিং, নট জামায়াত, নট বিএনপি, নট জাতীয় পার্টি, নট আওয়ামী লীগ। সবচেয়ে বড় ক্ষতি করছে এই আপনারা যারা চাকরি করছেন প্রেসের। অর্থাৎ ইন্টেলেকচুয়্যল ডগ স্কোয়াড। দে আর দ্য বিগেস্ট ক্রিমিন্যাল অফ দিস্ কান্ট্রি। অথচ প্রেসের ভূমিকাটা হওয়া উচিত ছিল ভিন্ন। এই যে চারদিকে এত গোলযোগ, অনিয়ম, দুর্নীতির কথা শুনতে হচ্ছে আমাদের প্রতিদিন, এসব বন্ধ করা সরকারের একার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। প্রেসই পারত এগুলোকে ঠাণ্ডা করে দিতে। সরকার বাধ্য হতো। যে-সরকারই হোক।

এবারে একটু অন্য দিকে যাওয়া যাক। ‘…নিষিদ্ধ’-এর পরে ‘রাষ্ট্রক্ষমতা-২০১০’ নামে একটা প্রথাবিরোধী নতুন অ্যালবাম বের করার কথা ঘোষণা দিয়েছেন। এটা কেমন প্রথাবিরোধী? কাজ কতদূর এগিয়েছে?
— শুরুতে ভেবেছিলাম যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি বের করে ফেলব। কিন্তু এখন সিদ্ধান্ত বদলাতে হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমি আরেকটু ভাবতে চাই। আনেক ভাবতে হবে আরো। ২০১০ সালের রাষ্ট্রক্ষমতা কেমন হওয়া উচিত — তারই একটা দিকনির্দেশনা। একটু বলি, ২০১০-এ বলা হবে, বুড়োরা আপনারা পথ ছাড়ুন। আপনারা রিটায়ার করুন। আপনাদের অবসরে পাঠাতে কত টাকা লাগবে, আমরা ভিক্ষা করে এনে হলেও আপনাদের দেবো। আপনারা মরছেন না, পথও ছাড়ছেন না। আল্লাহ আপনাদের হায়াত দিক, এটা আমরা চাই। আমরা আপনাদের আঘাত দিয়ে মারব না। আদর দিয়ে দিয়েই মারব। আপনাদের প্রত্যেককে স্টেজে তুলে দশ লাখ যুবককে লাগিয়ে দেবো একটা করে চুম্বন দিতে। আমাদের বিপ্লবটার মধ্যে হিউম্যর থাকবে। প্রথাবিরোধী বিপ্লব। তবে এগুলো যে আক্ষরিক অর্থে হবে, তা আশা করা ঠিক হবে না। কিন্তু গানের কথাগুলো হবে এ-ধরনেরই। এক-কথায় অ্যালবামটি হবে এই সাক্ষাৎকারটির মতোই। পুরো সাক্ষাৎকারটি বলা যেতে পারে ‘রাষ্ট্রক্ষমতা ২০১০’-এর ওপরেই।

ব্যান্ড সংগীতের দুইটি ধারা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেমন আপনি নিষিদ্ধ এবং রাষ্ট্রক্ষমতা-২০১০ দিয়ে সরাসরি রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে আসছেন; অন্যদিকে কিছু ভালো লাগে না, আমি শুধু তোমাকেই ভাবছি ধরনের হযবরল গান। এই হযবরল-এর হাত থেকে বাঁচার জন্য আপনার কি মনে হয় না শিল্পে কিছু কঠোর নীতিমালা আরোপ করা উচিত? রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ?
— শিল্প নিজেই একটা রাষ্ট্র। কিছু চাপিয়ে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার মতো বিষয় শিল্প নয়। হযবরলরা সবকালেই ছিল, থাকবে। কিন্তু স্থায়িত্ব পাবে না। ঝরে যাবে। এজন্য কোনো বিশেষ নিয়ন্ত্রণের দরকার নেই। আপনাআপনি নিঃশেষ হয়ে যাবে। সেদিক থেকে আমার মনে হয় ‘…নিষিদ্ধ’ একটি ব্যতিক্রমী অ্যালবাম। এবং এই ‘…নিষিদ্ধ’ অনেকের জন্যই সংগীতকে ডিফিকাল্ট করে দিয়েছে।

কলকাতার সুমন-অঞ্জন-নচিকেতা; — এরা একটি বিশেষ ফর্মে, বলা হয় ‘জীবনমুখী’, গান করেন। তার মানে কি আপনারগুলো মরণমুখী?
— পেচ্ছাবে ভাসছে কলকাতা, অথবা কাউকে কুত্তার বাচ্চা বললেই জীবনমুখী হয়ে গেল, এমন ননসেন্স বিষয় আমি বিশ্বাস করি না। বাস্তবমুখী হতে হবে। ওরা ওদের সরকারকে ছাড় দিয়ে কথা বলে। বলুক-না আমার মতো হাসিনা-খালেদাদের বিরুদ্ধে। সে-সাহস ওদের নেই। অর্থাৎ জীবনমুখী, এসব হচ্ছে ওয়ান কাইন্ড অফ পোলিটিক্স। সুমন-অঞ্জন এক ধরনের রবীন্দ্র সংগীতই করছে। একটু অন্যভাবে। তবে সুমন পশ্চিমবাংলার মানুষকে হারমোনিয়াম ছেড়ে গিটার হাতে ধরা শিখিয়েছে। সেই বিচারে আমার গানগুলোকে আমি বলব বাস্তবমুখী। সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার কথা আছে আমার গানে।

আপনার এই বাস্তবমুখী গান শুনে কোনো শ্রোতা যদি উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে, তখন আপনার কেমন লাগে?
— ভালোই লাগে। আমি প্রেরণা পাই। মনে হয়, শ্রম একেবারে বিফলে যাচ্ছে না।

উদ্বুদ্ধ হওয়ার পর শ্রোতাটি যদি সমাজ ও রাষ্ট্রের অসঙ্গতি দূর করার জন্য নিজ-হাতে কিছু করে বসে, তার দায়দায়িত্ব কি আপনি নেবেন?
— আমি তো কাউকে সশস্ত্র বিপ্লবের আহ্বান জানাচ্ছি না। বন্দুক তাক করতে বলছি না কারো দিকে। আমি বলছি একটা মানসিক যুদ্ধের কথা। মানসিক প্রস্তুতির কথা। আমি ঠিকই বলেছি, কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন কিন্তু যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেননি। এখন আমাদের যুদ্ধ করতে হবে আমাদেরই বিরুদ্ধে। সেই যুদ্ধের চেতনা দিতে চেয়েছি আমি আমার গানে। আমি যাদের বিরুদ্ধে বলেছি, তাদের যদি কেউ মেরে ফেলে, সেই দায় তো আমার নয়। তারই বোঝার ভুল। আমি সচেতন করে তুলতে চেয়েছি মাত্র।

ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ শেষই হয়নি, সেখানে মুক্তিযুদ্ধকে জাদুঘরের ভেতর আটকে ফেলার উদ্দেশ্যটা কি? ওরা কি করে? আমাদের কখনো ডাকে না। কলকাতার সুমন চট্টোপাধ্যায়দের নিয়ে এসে আপ্যায়ন করে। বলে, সুমন নাকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু। তার মানে আমরা কৃত্রিম বন্ধু।

এই যদি হয় বিবেচনা, তাহলে আমরা অগ্রজদের ওপর ভরসা রাখি কি করে? অতএব আবারো যুদ্ধে যেতে হবে। কোনো বিকল্প নেই। আমাদের সিনিয়ররা কি করছেন? আমাদের আপন করতে পারছেন না কেন? ওই যে আছে সম্মিলিত সংস্কৃতিক জোট। কি কি সব অনুষ্ঠান করে, ওখানে কেউ যায় না। কিন্তু আমাদের কনসার্টে দেখুন, যুবকদের ভিড়। অর্থাৎ যুবকরা বুঝতে শিখেছে যে বছরে একদিন শহিদ মিনারে গিয়ে ফুল দেয়ার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। শহিদ মিনার যুবকদের বুকে আঁকা। কিন্তু আমাদের বড়ভাইয়েরা সেই শিক্ষায় আমাদের শিক্ষিত করে তুলতে চাইলেন না। ফলে সেখানে সারাটা বছর কুকুর পেচ্ছাব করে, পতিতারা-মাগিবাজরা ফেন্সিডিল নিয়ে জুয়ার আড্ডায় বসে। সারাবছর কোনো খবর নেই, ফেব্রুয়ারি মাস এলে সাফসুতরো হয়। শহিদ দিবসে জাতীয় পতাকা পায়ে মাড়িয়ে যায়, ফুলের বেদি লণ্ডভণ্ড করে দেয় ‘জাগ্রত জনতা’। ব্যস, হয়ে গেল দেশপ্রেম। আমরা আজকের যুবকরা এসব জাতীয় দিবসের জাতীয় অপমান মানি না। তাই সচেতনতার যুদ্ধের আহ্বান।

এবারে আপনার ব্যক্তিগত জীবনযুদ্ধের কথা বলুন। আগে তো আপনি একটি চাকরি করতেন। এখন সেটাও করছেন না। সংসার চলছে কিভাবে?
— গানের টাকা দিয়েই মূলত চলতে হচ্ছে। ইট্’স্ অ্যা ভেরি ডিফিকাল্ট লাইফ। এক ধরনের অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়েই চলতে হচ্ছে। তারপরও এই জীবনটা আমি বেশ উপভোগ করছি। ভালোই আছি।

একটা অনুষ্ঠানের জন্য আপনি কত নেন?
— এটা নির্ভর করে কি-ধরনের অনুষ্ঠান, কারা করছে, কেন করছে তার ওপর। চ্যারিটি শো হলে এক-রকম, নিজেদের মধ্যে হলে আরেক রকম আর-কি। এমনও হয় শুধু লাইটিং আর সাউন্ড সিস্টেমের খরচটুকু নিয়েও অনুষ্ঠান করে দিই। আমার সৃষ্টিকে সেল করি কিভাবে! অতটা অবিবেচক হতে পারিনি।

চলতিপত্র পাঠকদের জন্য আপনার কোনো সারপ্রাইজ আছে কি?
— হ্যাঁ, আছে। আশা করছি ঈদের ১৫-২০ দিন পরেই ‘ওগো ভালোবাসা’ নামে একটি ক্যাসেট বাজারে আসবে। এটাই আমার পক্ষ থেকে ঈদ-সারপ্রাইজ।

আপনি কেবল আধুনিক গানই নয়, বাউল সংগীতেও গলা বাড়িয়েছেন। বাউলরা তো কি পেলো কি পেলো না এ হিসাব করে না। কিন্তু আপনাকে করতে হচ্ছে।
— কারণ বাস্তবতার মধ্যে আমার বসবাস। বাস্তব এড়িয়ে চলা কি সম্ভব?

বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়েই আপনি চলুন আপনার চিন্তার ভাণ্ডার নিয়ে। আপনাকে ধন্যবাদ।
— আপনাদেরও।

ম্যাকের ইন্টার্ভিয়্যু সংগ্রহসূত্র ও অনুষঙ্গ
ম্যাকের এই ইন্টার্ভিয়্যু সংগৃহীত ১৯৯৯ সালের একটা সাপ্তাহিক থেকে। সেই সাপ্তাহিকটার নাম ‘চলতিপত্র’, বর্তমানে এর প্রকাশ পুরোপুরি বন্ধ, যথেষ্ট পাঠক-কাটতির রাজনীতিবিচিত্রা টাইপের পত্রিকা ছিল এইটা। ঢাকা থেকে বেরোত, নিউজপ্রিন্ট মলাটে ও পাতায়, কখনো মনো-কালারে ফের কখনো বাই-কালারে। এর সম্পাদক ছিলেন বিভুরঞ্জন সরকার। মাকসুদুল হক এইখানে রেগ্যুলার কলামনিবন্ধ লিখতেন, পনেরো দিনের বিরতি দিয়ে পাক্ষিক ভিত্তিতে, ‘নিষিদ্ধ এই সময়ে’ ছিল ম্যাকের সেই নিবন্ধকলামের শিরোনাম। সাক্ষাৎকারটা ছাপানো হয়েছিল সে-বছরের ঈদসংখ্যায়। ইশ্যুটার পূর্ণ সনতারিখতথ্য সংরক্ষণ করা যায় এইভাবে : ১১ জানুয়ারি ১৯৯৯, ২৮ পৌষ ১৪০৫, বর্ষ ৩ সংখ্যা ৬; মূল সাক্ষাৎকার প্রকাশের কালে এর শিরোনামায় ছিল কথালাপ থেকে উৎকলিত একটা লাইন, “পেচ্ছাবে ভাসছে কলকাতা  অথবা কাউকে কুত্তার বাচ্চা  বলে গালি দিলেই জীবনমুখী গান হয় না” — আমরা এইখানে রিপ্রিন্টের সময় শিরোনামাবাক্য সংগত কারণে চেইঞ্জ করে একই বক্তার অন্য উদ্ধৃতি নিয়েছি, কিন্তু অনভিপ্রেত হলেও ব্যাপারটা করতে হয়েছে, কেন বা কী জরুরতে এ-কাণ্ড করতে হয়েছে সেইটা পাঠকের পক্ষে আন্দাজ করা কঠিন হবে না আশা করি।

ইন্টার্ভিয়্যুটা নানা বিবেচনায় রিপাব্লিশযোগ্য, ফুরিয়ে যায়নি নিশ্চয় এর রিডিং-যৌক্তিকতা; বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের পথপরিক্রমা যারা দেখতে চান তাদের কাছে ম্যাক ও অন্য ব্যান্ডমিউজিশিয়্যান সকলের কথাবার্তা আন্তর্তাগিদ থেকেই শুনতে হবে। সেই সুবাদে এবম্বিধ যে-কোনো টুটাফাটা আলাপচারিতাও সংরক্ষণযোগ্য। চলতিপত্রের এই ইন্টার্ভিয়্যু পঠনবস্তু হিশেবেও অপেক্ষাকৃত উপভোগ্য, প্রশ্ন সঞ্চালনের ধরন এবং উত্তরকারীকে স্পেইস্ দেয়া ইত্যাদির কারণে হয়তো, অন্য-অন্য সমধর্মী ইন্টার্ভিয়্যুগুলো রম্য রগড়ে পর্যবসিত হতে দেখি আমরা হামেশা। আমিনুল হাসান শাফিঈ এবং আলী ফিদা একরাম তোজো, পত্রিকার পক্ষে ম্যাকের ইন্টার্ভিয়্যু করেছেন যে-দুইজন, প্রশংসা পাবার যোগ্য কাজ করেছেন অবশ্যই। কিন্তু রগড় করার একটা জাতীয় হুজুগঢেউ উঠেছিল ওই সময়টা থেকেই, বিশেষত হুমায়ুন আজাদ আর আহমদ ছফা বা শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদ প্রমুখের ঘন ঘন কথাবার্তাধারকেরা সাক্ষাৎকার নিতে যেয়ে সাক্ষাৎদাতাকে খেলো বানানোর যে-কেমিস্ট্রি ইনভেন্ট করেছিলেন, সেই কিমিয়া আজও সচল এবং উপরন্তু সর্বত্রবিস্তারী হয়েছে দিনে দিনে। সেইটা আরেক প্রসঙ্গ। লক্ষ করব যে এই ইন্টার্ভিয়্যুটাতেও দুইয়েকবার এহেন রগড় উঁকি দিয়েছিল, উদাহরণ কপিপেইস্ট করি : বৃদ্ধ ও ন্যুব্জ সাংস্কৃতিক মুরুব্বিদের স্থিতাবস্থা আর যুবাশ্রেণির লড়িয়ে মানসিকতা নিয়ে বলতে যেয়ে ম্যাকের কথার পিঠে সাক্ষাৎকারগ্রাহীরা যা করেন, অবিলম্বে ম্যাক সেইটা হ্যান্ডল করেন এই বলে, “আপনাদের মতো তথাকথিত প্রগতিশীলদের কাছ থেকে এ-রকম কথা শুনতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।” এই কায়দায় আরও বার-কয়েক রগড়চেষ্টা খানিক উঁকি দিয়েই মিলিয়ে যায়, ভাগ্যিস!

সব দিক বিবেচনায় এইটা ম্যাকের ভালো ও খোলামেলা সাক্ষাৎকারগুলোর মধ্যে একটা বলে মনে হয়েছে আমাদের কাছে। এমন আরও কয়েকটা সাক্ষাৎকার আছে ম্যাকের, — খুব বেশি নাই যদিও, পত্রিকাচাহিদানুসারে ফানি-মিনি ইন্টার্ভিয়্যু গ্রহণে এবং প্রদানে অভ্যস্ত আমাদের পত্রিকাপক্ষ ও সংগীতসিনেমাশিল্পীপক্ষ, — এমনিতে ম্যাক সবসময় কথা বলতে চেয়েছেন বলেই বিভিন্ন পর্যায়ে ম্যাকের গোটা ক্যারিয়ার জুড়েই খেয়াল করে আসছি। কিন্তু কথাধারকেরা এসেই জুড়েছে ভ্যান্তারা ফানি-মিনি রম্যপত্রিকাপ্রচ্ছদের তারকাচিহ্নিত প্রশ্নডিম্ব। বক্ষ্যমাণ সাক্ষাৎকারের গোড়াতেই সাক্ষাৎগ্রহীতা-সাক্ষাৎদাতা উভয় তরফের সমঝোতাবাক্য শুনে আমরা আশ্বস্ত হই। আমাদের দেশের পত্রিকাগুলোতে কালচার‍্যাল বিটে এখনও প্রোফেশন্যালিজম আসে নাই বলেই অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, যে-অর্থে কূটনীতি বিটে বা অর্থনীতি বা শিক্ষা বিটে এসেছে; দেখতে পাই যে একজনও লোক পত্রিকাগুলোতে নাই যার দ্বারা ওয়েস্টার্ন মিউজিক শোনা ম্যাক বা বাচ্চু বা জেমসকে সেভাবে একটুও ক্রিটিক্যালি রিফ্লেক্ট ও রেস্পোন্ডে আগ্রহী করতে পারেন। ফলে একটাবারের জন্যও আমরা আজ অব্দি শুনি নাই পিঙ্ক ফ্লয়েড বা সান্তানা বা মার্ক নোফ্লার বা স্টিভি ওয়ান্ডার শুনে একজন বাংলাদেশী ব্যান্ডমিউজিশিয়্যান সেইটাকে কেমন করে নিজেদের কাজের বেলায় ডিল্ করেন, ফেলে দেন কতটা আর রাখেন কতটা, আজও নোট ধরে কেউ প্রশ্ন করল না কোনো ব্যান্ডসিঙ্গারকে যে এই জায়গাটা বা এই-এই জায়গাগুলা আপনার অপটুতার চিহ্নায়ক। যাকগে। ম্যাক বরং এইসব ব্যাপারে উদগ্রীব ছিলেন দেখেছি, বলতে চেয়েছেন মিউজিক নিয়েই, হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইল না কেহ ধরনের পরিস্থিতি এক এই ম্যাকের ক্ষেত্রেই লক্ষ করে গেছি আগাগোড়া।

এইবার বলি, কেন কথালাপটার আদি শিরোনামে উৎকলিত ম্যাকের উক্তিটি ভিতরে যথাস্থানে রেখে দিয়ে এর বদলে অন্য উক্তি উঠিয়ে আনা হলো সেই কৈফিয়ৎ দিয়ে একটু হলেও মূল সাক্ষাৎকারগ্রাহীদের প্রতি কৃত ধৃষ্টতা মার্জনের আর্জিটা জারি রাখা যাবে। “পেচ্ছাবে ভাসছে কলকাতা  অথবা কাউকে কুত্তার বাচ্চা  বলে গালি দিলেই জীবনমুখী গান হয় না”, এই শিরোনামায় আজকে এসে সাক্ষাৎকারটা পাব্লিশ করার প্রাসঙ্গিকতা আর সেভাবে নাই। কেননা ‘জীবনমুখী গান’ ধারণাটা খোদ কলকাতার গণমিডিয়ার সৃষ্ট বোতলছাপ্পা এবং এই জিনিশ নিয়া কবীর সুমন ও তার সতীর্থরা মাধ্যমিক গণপত্রপতিদের বাধ্য করেছেন সঙ্কীর্ণ অর্থদ্যোতনার এই সিলমোহর তাদের গায়ে না-দাগাতে। ব্যাপারটা আজ অনেককাল হয় একেবারেই মীমাংসিত। এখন আর কোথাও বলা হয় না কবীর সুমন বা অঞ্জন দত্ত বা মৌসুমী ভৌমিক প্রমুখ জীবনমুখী মিউজিকবাদ্য করেন। আরেকটা কথা। ম্যাক তখন অনেক লেখায়, নিবন্ধে এবং সাক্ষাৎকথনে, এতদব্যাপারে যা-কিছু বলেছেন সেসবের পেছনে অন্য ক্রোধ অন্য বেদনা জ্ঞাপন ও প্রকাশের ইচ্ছেটাই ছিল প্রধান, অন্তত আমাদের তা-ই মনে হয়েছে বরাবর, যথাস্থানে কখনো সেই বেদনারাগের প্রমাণ দাখিল করা যাবে, এইখানে এবং এখন তো নয়ই। কিন্তু যদি ম্যাকের এই কথাগুলোকে এইভাবে আক্ষরিক অর্থে না-নিয়ে এর গোড়ার কথাটা আমলে নেয়া যেত, নিতে যদি পারতাম আমরা, বাংলাদেশের গানব্যাবসা আজ ভুবনপ্রসার লাভ করত মনে হয়। আমরা ম্যাকের কথাগুলো উপরটপকা নিয়েছি, মিচকি হাসির মজাক করেছি, ক্যাচি লিড হিশেবে ম্যাকের স্যুইপিং কমেন্টটাকে এনেছি এম্বোল্ডেন হরফে নজরটান দেগে ভুলভাবে জনসমক্ষে। এই করে করে তেরোটা বাজিয়েছি ব্যান্ডমিউজিকের। জিন্দেগিটা তামা করে দিয়েছি ইভেন খোদ ম্যাকেরও।

অধিকন্তু আজ যদি ম্যাকের সাক্ষাতে যান অভিন্ন সাক্ষাৎকারীদ্বয়, এই লিড নিয়া ম্যাকের পুনর্বিবেচনার কথা পাড়েন যদি, মিউজিকে ম্যাকের যে-ব্যাপ্ত পড়াশোনাজানাবোঝার পরিধি সম্পর্কে আমাদের আন্দাজ হয়েছে এদ্দিনে, মনে হয় তিনি লিড চেইঞ্জ করতেই রিকোয়েস্ট করবেন, অবশ্য আগের লিডটা তারই ইচ্ছেয় হয়েছে এমন তো ঘুণাক্ষরেও মনে হয় না, বা এমনকি ইন্টার্ভিয়্যুয়্যারদের ইচ্ছেতেও হয়েছে এই ব্যাপারেও হলফনামা নাই আমাদের কাছে। ম্যাগাজিন-পত্রিকার ডেস্কে সেই লোকটাকেই বসানো হয় বলে শুনেছি, যে নাকি জানে কোনটা পাঠক রয়েসয়ে খায় আর কোনটা টপাটপ গলায় ফেলে ফের ছুটে যায় নেক্সট প্লেইটের দিকে। ডেইলি নিউজপেপার আর উইক্লি সাপ্লিমেন্ট তো রয়েসয়ে চেখে দেখলে ব্যবসায় লালবাত্তি নিশ্চিত। কাজেই ব্যাপারগুলো ডেস্কে বসে অঙ্ক কষা লোকটার দুর্বুদ্ধিপ্রসূত হবার চান্স অধিক। আর আজকের কবীর সুমন বা অঞ্জন দত্ত প্রমুখ তাদের গানবাজনা মানেগুণে এবং সংখ্যায় এমন একটা জায়গায় নিয়ে ঠেকিয়েছেন যে এইসব নিয়ে দেড়-দুইবাক্যে রিবিউক করা যায় না, করলে স্পেইস্ এবং টাইম জুড়ে থিতু বসে করা চাই। কিন্তু এইসব করতে যেয়ে একদশকেরও অধিক সময় গেছে ম্যাকের যাত্রানাস্তিই ঘটায়েছি আমরা, ওদিকে সুমন-অঞ্জন একদিনও সৃষ্টিনিস্পৃহ বসে ক্ষেপণ করে নাই কাল, ম্যাকের গানের জায়গাটা আমরা সুগম রাখতে পারি নাই। ফিচলেমি আর ফস্টিনষ্টি লিড দিয়া আমরা ম্যাকের বেদনা ও ক্রোধের রাজনৈতিকতার, কালচার‍্যাল হেজিমোনি রুখবার চেষ্টার, ইঙ্গিত-ইশারা ঠাহর করতেই ব্যর্থ হয়েছি। ইন্টারপ্রেট করেছি ভুলভাবে, স্প্রেড করে দিয়েছি ভুলভাবে, এবং ম্যাকের ও শক্তসমর্থ বাংলা গানের গতি করে দিয়েছি মন্থর।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নবতরঙ্গে, মানে ওয়েবপোর্টালে, এর আগে একবার এই ইন্টার্ভিয়্যু পুনঃপ্রকাশ করা হয়েছিল একই সংগ্রাহকের ভূমিকা ও পাদটীকায়। সে-সময় এর শিরোনামায় ম্যাকেরই মুখনিঃসৃত যে-উক্তিটা বাছাই করে সেঁটে দেয়া হয়েছিল, “নামডাক কতটা হলো, সেদিকে আমার নজর নেই। আমি চেয়েছি একটা ছাপ রেখে যেতে”, এইবার গানপারে প্রকাশকালে এর শিরোনামা “চেয়েছি একটা ছাপ রেখে যেতে” — এই অটোবায়োগ্র্যাফিকতার মূল্য অপরিসীম আমাদের কাছে। একটা ছাপ রেখে যেতে চাওয়া মাকসুদ, রম্যপত্রিকার প্রচ্ছদ থেকে সদর্পে সরে থাকা মাকসুদ, এই তীব্রগতি শিল্পীটির চেহারা আমরা পাঠ করে এসেছি আপন কররেখার ন্যায় তিরিশ/চল্লিশ বছর ধরে একটানা। মাকসুদের ছাপ, তার চলার পথের ট্রেইল, কি কি ইম্প্রেশন তিনি রেখেছেন এতাবধি এবং রেখে চলেছেন নিত্য অথবা রাখছেন না, আজকের দিনের নতুন গাইয়েকে নতুন বাজিয়েকে নতুন মঞ্চকর্মীটিকে সেই টিপছাপের মাপজোখ নিতেই হবে। না, ব্যক্তি ম্যাকের তোয়াজ নয়, নিজেদেরই ভিতরের ঘাড়ত্যাড়া ষাঁড়ের সম্মানে। একজন নবীন গানকর্মী ঠিক করবেন তিনি টর্চবেয়ারার হবেন, আলোবর্তিকা বহন করবেন, নাকি হবেন তিনি ভীতত্রস্ত অন্ধকারের চোখবন্ধ সংহিতা।

  • সাক্ষাৎকার-পাঠকৃতিটির সংগ্রাহক, সংকলক, সংযোজক ও শেষভাষ্যপ্রণেতা জাহেদ আহমদ

মাকসুদুল হক রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you