কেউ যদি ‘হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচিউড’ পড়ে ফেলে তাহলে বাকি লাতিন সাহিত্য তার একেবারে যে না-পড়লে বিশেষ বড় ক্ষতি হয়ে যাবে, এমন না। কিন্তু কেউ যদি সমস্ত লাতিন সাহিত্য পড়ে ফেলে অথচ ‘হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচিউড’ পড়েনি — তাহলে মনে করো ওই লোকটা শুধু লাতিন নয়, গোটা পৃথিবীর অন্যরকম একটা বই থেকে সে নিজেকে বঞ্চিত করল।
কথাগুলি ঘুরেফিরে এইভাবেই বলতে চাইলেন ভার্গাস য়োসা। তিনিও নোবেলজয়ী লাতিন গ্রেট। কিন্তু মার্কেসের ওই ‘হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচিউড’-এর কথা এলেই তিনি একেবারে আনমনা হয়ে যান। পরবর্তীতে তার মাধ্যমে আমরা জানব, মার্কেস আসলে আন্দুসান্দু যাদুবাস্তবতার কথা তুলে চরিত্রগুলা রচনা করেননি। কর্নেল বুয়েন্দিয়া যিনি এই উপন্যাসের মূল চরিত্রদের একজন, যিনি একজনকে খুন করে পরবর্তীতে শান্তিতে ঘুমাতে পারেননি একটা রাত, বারবার দেখতেন মৃত মানুষটা তার সাথে দেখা করতে আসছে। তখন তিনি ভয়ে ঘরবাড়ি পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান। য়োসা বললেন, মার্কেসের আপনা নানাও এ-রকম একজনকে খুন করে বাসস্থান বদল করেছিলেন। অনেকের আবার ধারণা, মার্কেস তরুণ বয়সে একবার স্ত্রীকে নিয়ে মেক্সিকোর উপকূলে ঘুরতে যাওয়ার সময় হঠাৎ এক ইন্ডিয়ান নারীকে দেখে তার মাথায় আজব একটা ঘোর শুরু হয়ে যায়। এবং সে-মুহূর্তেই গাড়ি ঘুরিয়ে সে বউকে কিছু খর্চাপাতি দিয়ে ১৮ মাসের স্বেচ্ছাগৃহবন্দিতে চলে যায়। দৃশ্যটা কল্পনা করলে ভারি রোমান্টিক লাগত। মনে মনে শিহরিত হতাম। নিজেকে একেকদিন বলতাম, — একদিন আমিও…! সুনীলের সেই কবিতার মতন আর-কি।
কিন্তু য়োসা বললেন, — বিষয়টা অত সহজ নয়, মার্কেস তার আত্মজীবনীতে বলেছে, তার লেখার বেলায় শুধু প্রথম লাইনটাই মেইন। ওই লাইনের জন্য সে শত শত রাত, কত দুপুর, কত অপরাহ্ন-যে হাপিত্যাশ করে ঘুটেঘুটে নিজেকে ক্ষয় করেছে — তার হিসাব নাই কোনো। কিন্তু য়োসা বললেন ভিন্ন কথা। হুট করে একলাইন মাথায় চলে আসল আর তিনি গড়্গড় করে ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ উপন্যাস লিখে ফেললেন, ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’ লিখে ফেললেন! খ্যাতি হয়ে গেলে এ-রকম করে মানুষ বলে। এইটা পৃথিবীর চিরায়ত অভ্যাস।
তারা দু-জনেই একে অপরে বন্ধু মানুষ। ইচ্ছামতো গালাগালি বা ঈর্ষা নিয়ে কিছু কথা দু-জনের কেউ বলতেই পারে। এতক্ষণ পর্যন্ত ঠিক আছে। হয়তো মার্কেসের অবিশ্বাস্য খ্যাতি য়োসার ঈর্ষার কারণ হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী কথাগুলি যখন তিনি বলে ফেলবেন তখন সেইটা শোনার পর আপনি আর য়োসাকে কিছু বলবার সাহস করতে পারবেন না। আপনি মনে করবেন সে আপনার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে অসহায় কণ্ঠ নিয়ে বলছে, “আমি আসলে তার সাথে আর পারি নাই। কখনো কখনো বড় লড়াকুর কাছে হারতে পারাটাও অসীম সুখের। সে যখন ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ উপন্যাসটা লিখল, সেইটা ছিল ১৯৫৩ সন। এর তিন বছর পর তার আরেকটা বই বের হয়, নাম ‘পাতার ঝড়’। মোটামুটি সে তখনই লেখকদের মধ্যে স্টার বনে যায়। কিন্তু আমি দেখতাম, সে যেন তৃপ্তি পাচ্ছে না তার লেখায়। কী একটা মারণবীজ যেন তাকে ভিতরে ভিতরে কুরেকুরে খাচ্ছিল। আমি নিজে লেখক তো, তাই বুঝতে পারি। ঠিক সে-বছর, যে-বছর ‘পাতার ঝড়’ বের হয়, তার তিন মাসের মাথায় বের হলো ‘পেদ্রো পারামো’। গোটা লাতিন সাহিত্যের ইতিহাস যেন বদলে গেল ওই একটা উপন্যাস রচনার পর। সেইসময় কলম্বিয়া থেকে মেক্সিকো থেকে পেরু থেকে কুবা থেকে কয়েক ঝাঁক তরুণ লেখক বের হলো। মার্কেসকে তখন বিভিন্ন সাক্ষাতের সময় বেশ উচ্ছল অবস্থায় দেখতাম। সে বরাবরই এমন ছিল। সদা ফুর্তিবাজ, আড্ডাবাজ হৈহুল্লোড়ে। কিন্তু তার ভিতরে ভিতরে অতৃপ্তির বেদনাটা আমার কাছে সে গোপন করতে পারত না। ১৯৬৩-তে কিছু গল্প নিয়ে বের হলো ‘বড়মার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া’। তার এ-পর্যন্ত লেখায় সে তখনই ইউনিক হয়ে গেছিল। মোটামুটি সে যদি তখনও লেখালেখি বাদ দিয়ে অবসরে চলে যেত, তাতেও সে ইতিহাসে বড় লেখক হয়ে থাকত। কিন্তু সে আসলেই আন্দিজের বাচ্চা ছিল। রক্তে ছিল মারণনেশা। কী একটা দুর্নিবার গতি তাকে ঘোরের মধ্যে ফেলে দিনের পর দিন টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। সে যে কিছু-একটা করে দেখাবে, এই বিশ্বাস থেকে তাকে একবিন্দু টলাতে পারেনি কোনোকিছু। তারপর ১৯৬৭ সালে এল ‘হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচিউড’। গোটা আন্দিজ থেকে আমাজন, মেক্সিকো থেকে কিউবেক — যেন ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে গেল। এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণ পৃথিবীর সাহিত্যজগৎ আর কখনো দেখেনি। এইটা সে জানত, সে করে দেখাবে। এমন বই লেখার প্রস্তুতি এক-জনমে হয় না। এইটা কয়েক প্রজন্মের সাধনার ফল। তার নানা যিনি উপন্যাসে বুয়েন্দিয়া নাম নিয়ে আসবেন তার মা যিনি উপন্যাসে হোসে আর্খাদিওর মা হয়ে আসবেন তার এক ফুপু যে উপন্যাসে আমারান্তা হয়ে আসবে — এইগুলা, এইগুলা আসলে কয়েক প্রজন্মের দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতির ফসল।”
একলাইন, কেবল একলাইন আসলেই আমার বাকি হাজার পৃষ্ঠা লেখা হয়ে যায়, — এই কথা আজ থেকে ৬০ বছর পরে বাংলাদেশ নামক তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশে যে আলোচনা করবে কেউ কেউ, এইটাও য়োসা বলবেন এক চোইতমাসি অকালবৃষ্টির ভররাতেরবেলায়।
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS