কিছুদিন আগে, এই বছরেই, মার্চ আঠারোর মাঝামাঝি দিকটায় সিলেটে একটা নাট্য-উৎসব হয়ে গেল। ‘দুই বাংলার নাট্যোৎসব’ শীর্ষফলকের সেই সপ্তাহজোড়া আয়োজনে দেশের এবং ইন্ডিয়ার গোটা-সাতেক নাট্যদল তাদের মঞ্চসফল কয়েকটা কাজ নিয়া হাজির হয়েছিল। জমকালো উৎসব। সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেট চ্যাপ্টার ছিল উৎসবের অর্গ্যানাইজার ও ফ্যাসিলিটেইটর। দুইখানা নাটক অনেকদিন বাদে এই সুবাদে দেখে ফেলা গিয়েছে। এরচেয়ে বেশি ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হয় নাই বিকজ্ ওই মোমেন্টে জেবের রেস্ত ছিল তলানিতে এবং টাইমেরও একটা হার্ডশিপ যাচ্ছিল। তা যাক। দুইখানা দেখার মধ্যে একখানা এই নিবন্ধে প্রাসঙ্গিক। খুব নামডাক শুনছিলাম গত প্রায় একদশক ধরে এর, মঞ্চে দেখা না-হলেও কোনো দৈনিকের ঈদসংখ্যায় স্ক্রিপ্ট পড়ে ম্যুভড হয়েছি স্বীকার্য, ফলে স্টেজে দেখার একটা হাল্কাপাৎলা বাসনা ছিল। অনেক বিলম্বে হলেও হয়েছে দেখা। বাসনা গিয়েছে পূরণ করা। ‘ধাবমান’ সেই নাটকের নাম। ঢাকা থিয়েটার প্রযোজনা।
যা ভেবেছিলাম তা নয়। এত অগোছালো আর কমজোরি হয়েছে সেদিনের মঞ্চায়নটা, আন্দাজ করি যে এর অন্যান্য দিনের শো অবশ্যই ভিন্নতর দ্যোতনা হাজির করে, তা না-হলে এত সুনাম হয় কি করে এই জিনিশের? সবাই ঝিমানো মুর্গির আচরণ করছিল গোটা পার্ফোর্ম্যান্সটায়, যদিও প্রোডাকশন দাবি করছিল ঘোড়ার চেয়েও গতিদৃপ্ত গনগনা ষাঁড় আর মন্দ্রগম্ভীর মহিষের মর্দানা আসবে অ্যাক্টরদের কাছ থেকে, ম্যে-বি স্টারগাদাগাদি ঢাকা থিয়েটারের স্ট্যামিনা হামেশা স্টারদিগের মিজাজমর্জির ব্যারোমিটার ধরে আপডাউন করে এইভাবে। নসিব আমার মন্দ বলব, না ভালো বলব, বুঝতেসি না। শিমূল ইউসুফ তো দুই-তিনবার স্টেজে এসে ল্যাংচাইলেন/খোঁড়াইলেন শুধু, তবিয়ত বুরা থাকলে দরকার ছিল না এইভাবে স্টেজে অ্যাপিয়্যার করার, উনার ভূমিকাটা আদৌ কোন কামে লাগল দুইয়েকজন শো শেষে জিগাইলেন আমারে, আমিও বাংলার বুদ্ধিজীবীদের মতো হুদা প্রাসঙ্গিকতার পাঁচক্রোশ দূর দিয়া আবোলতাবোল বকে গেলাম কিন্তু সদুত্তরে ব্যর্থ হলাম। শহীদুজ্জামান সেলিম আর রোজি সিদ্দিকী ইত্যাদি টিভিনীহারিকা হাঁপাচ্ছিলেন টিমটিমে গলায় ডায়লগ বলতে বলতে। একবর্ণও বোঝা যাচ্ছিল না। আলবৎ মঞ্চ অথবা শাব্দিক ব্যবস্থাপনা আপ-টু-দ্য-মার্ক ছিল। ইভেন মূল যে-ষাঁড় চরিত্রে এশা ইউসুফ তারেও ওইদিন ভর করেছিল বুঝি নিধুয়া ক্লান্তি।
কিন্তু যা ম্লান হয়নি কুশীলবদের এত হচপচের পরেও, অনবদ্য চরাচরভাসানি ছিল যা, তা হচ্ছে এই নাট্যকাজের সংগীতপার্টটা। আবহ বলি কিংবা বাতাবরণ ইত্যাদি নির্মাণ করছিল নেপথ্যে যে-সংগীত, সেইটা। গারো আর বাঙালি জাতিসত্তার জটিল বুনটে মেটাফোরিক্যাল একটা নাট্যকল্পনা। সাংঘাতিক ইন্টিগ্রেইটেড মোটিফগুলো। মনুষ্য ও পশু দোঁহে একাকার। পশুও, পশুই, মানুষ। কুর্বানি বলি কিংবা নানাভাবে লেজিটিমেইট-করে-নেয়া মানবসমাজে প্রাণহত্যা বা বলী ইত্যাদি সিগ্নিফিক্যান্টলি ভিশ্যুয়্যালাইজ্ করা হয়েছে এই মঞ্চহাজিরায়। মিউজিক এই ইন্টিগ্রেশনে রেখেছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
সাংগীতিক উপকরণ ও অনুষঙ্গ তো কুল্লে একটা না, গারো ও বাঙালি উভয় পার্টের সংগীতাভিজ্ঞতা থেকে নেয়া হয়েছে বেশকিছু স্বর ও ব্যঞ্জন। সোমেশ্বরীতীরের কিছু সুরের ইশারা অ্যাট-লিস্ট সংলগ্ন অঞ্চল সিলেটিয়ারা কানে আসা মাত্রই আন্দাজ করতে পারে চেনা বলে। এবং আরেকটা সুর, প্রায় হামিং হলেও পরিব্যাপ্ত গোটা নাট্যতল্লাট জুড়ে, ওইটা অ্যারাবিক। হলেও আরবমুল্লুকের, এইটা বাংলায় চেনা। এই বাংলায় যে-জনগোষ্ঠীটা ধর্মাচারের দিক থেকে মুসলমান, এদের কাছে এই টিউন অতি পরিচিত এবং সেক্রেড। হজময়দানে, আরাফাতের ময়দানে, এই সুর ওঠে এবং বিশেষভাবে কুর্বানির ঈদে পশুজবাইয়ের সময়। এই টিউনের বিষাদব্যাপ্তি নিছক মুসলমান কেন, সুর খেয়াল করে জীবন কাটায় এমন যে-কেউ ধরতে পারবে। টেনে টেনে, করুণ কোনো অচিনা রাগিণী লতিয়ে, এই সুর অধিকার করে নেয় এবং রেশ রেখে যায় নাটক শেষেও বহুক্ষণ অব্দি। কি সেই টিউনটা? “লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লা, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নি’মাতা, লাকা ওয়াল মুল্ক, লা শারিকা লা” … আরবি বুলির এই কথাগুলো লতিয়ে সুরগোছা ডালপালা ছাড়ছে যেন ঘটনার বৃক্ষতলে আরও ঘন ও গোল বসিয়ে রাখতে।
এবং মনে পড়ছিল, সংলাপগুলো শ্রোতাদর্শকদের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন যেহেতু অভিনয়স্টাররা ক্লান্তিবশত, মনে পড়ছিল কোথায় যেন সুরটা বাংলা গানে ব্যবহৃত হয়েছে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত উপায়ে। বেশিক্ষণ ভাবতে হয় নাই, ইয়াদ হয় চকিতে। ‘মেঘদল’ নামে একটা ব্যান্ডের গান, মনে পড়ে যায়। আমার মেয়ের ফেব্রিট ব্যান্ডগুলোর মধ্যে মেঘদল একটা। কাজেই কিছু গান শোনা হয়েছে আমারও। থোড়বড়িখাড়া বাংলাখুরি ক্রিটিকআলোচনার দরকার নাই। গানটা শোনাই।
ওম্ অখণ্ডমণ্ডলাকারং, ব্যাপ্তং যেন চরাচরম্
তত্পদং দর্শিতং যেন, তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ
লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক
লাব্বাইক লা শারিকা লা
ইন্নাল হামদা ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়াল মুল্ক
লা শারিকা লা
বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি
ধর্মং শরণং গচ্ছামি
সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি
বল হরি, হরিবোল, তীর্থে যাব
বিভেদের মন্ত্রে স্বর্গ পাবো
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্
মানুষ কোরবানি মাশাল্লাহ্
হালেলুইয়া জেসাস ক্রাইস্ট
ধর্মযুদ্ধে ক্রুসেড বেস্ট
শ্লোকগুলোর কোলাজ। অন্তিম স্তবকে যেয়ে বেহেশ্ত, অথবা ক্যাথার্সিস, মোক্ষ। বলি বিমোক্ষণ। ধর্মপ্রীতির জয়গাথা না, আবার প্রথানতজানু ধর্ম নিয়া খামাখা স্ট্যামিনাও খর্চা করেন নাই ইন্টেলিজেন্ট স্যংরাইটার। ছুরির নিচে গ্রীবা টান করে, চাপাতিকোপের বিঘৎখানেক তফাতে চোয়াল উঁচিয়ে, একদম নাটকীয়তা না করে শেল ছোঁড়া হয়েছে : বিভেদের মন্ত্রে স্বর্গ পাবো। অব্যর্থ। অসূয়াহীন, বিপ্লবিয়ানাহীন, সত্যের উৎসার। বদমাশ যে-সত্য।
উল্টোবুজলি ইন্টেলিজেনশিয়ার এই দেশে দেখছি ইদানীং কৌতুকাচ্ছন্ন সমাজসংসার। স্যাটায়ার আর সার্কাজমের তফাৎ করবে কি, খিস্তি আর বক্রোক্তি যে দুই জিনিশ বুঝবে কি, ব্যজস্তুতি ইত্যাদি যে একেক অব্যর্থ অর্নামেন্ট বাংলা ভাষাবাগবিধির জানবে কি, দিবারাত্রি লিটারেচার করে বেড়ায় দ্যাখো সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি সিন্ডিকেটের পোয়েটেস্টাররা। গানটা শুনে সেই পয়লা দিনেই মনে হয়েছে মেঘদল সজাগ থেকে ল্যাঙ্গুয়েজের আয়ুধগুলো প্রয়োগ করতে জানে। এবং কথায় কথায় বিপ্লবিয়ানা না করে যে, এই বিকট হুজুগাবেগের নগরে তার ফ্যানবেইসের নসিব সীমিত ও শম্বুকের গতিপ্রাপ্ত। দুইটা অ্যালবাম এ-পর্যন্ত শুনে মনে হয়েছে মেঘদল বোধহয় স্নেইলের গতিটা মানিয়া নিয়াই মিউজিক করতে পারছে। তথাস্তু।
অন্য যে-গানটা আপাতত হোমোলোগাস মনে হওয়ায় বাগবিস্তার না করে স্রেফ টুকে রেখে যেতে চাইছি অন্য কোথাও অন্য কোনো কালে কথা বাড়াব বলে, সেইটা নিম্নঝুলন্ত :
মানুষের ক’জন ভগবান?
ক’জনে ভাগ্য লেখেন
ক’জন জীবন সামলান?
আকাশে উড়ছে বোমারু ভগবান
মানুষ ঝলসে যিনি গণতন্ত্র এনে দেন।
মাটিতে পোঁতা আছে ক্লাস্টার ফুল
ছুঁয়ে দিলে জ্বলে ওঠে, — সে তো শিশুদের ভুল!
দু’হাত হারিয়ে ডানাকাটা পরী আজ যে-শিশু
শুনতে কী পাও তার চিৎকার পশ্চিমা যিশু?
পৃথিবী জুড়ে চলছে যখন প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ মিছিল
পিশাচের হাতে হাত মেলালেন ব্লেয়ার, জ্যাক শিরাক, ভ্লাদিমির পুতিন।
ওরা রক্তের হিস্যা বুঝে নিতে চায় বুঝি গ্যালন গ্যালন!
ঘটনা হচ্ছে, ‘মেঘদল’ ব্যান্ডের পয়লা অ্যালবাম ‘দ্রোহের মন্ত্রে ভালোবাসা’ থেকে এই বিপন্ন বদ্বীপের কতিপয় জীবনতরী কিছুকাল আগে একটা রাফখাতায় রেখেছিলাম রক্ষিত। দশক গিয়েছে চলে এই ফাঁকে এবং খাতাটাও নিখোঁজ। উইকি দেখব? দরকার আছে কোনো? প্রথম মন্ত্র ‘ওম’ এবং দ্বিতীয় মন্ত্র ‘ক্রুসেড’ উপরে অ্যাটাচ করা হয়েছে, বলা বাহুল্য। অনেক চেষ্টা করেও ‘দ্রোহের মন্ত্রে …’ অ্যালবামটার রিলিজ্-বছর ঠিকঠাক মনে করতে পারলাম না। ২০০০? বা ১, ২? অথবা আরেকটু বছর-এক/দেড় আগে? ২০০০ হবে বলেই হিসাব বলছে। কেননা শিরোনামহীন, মেঘদল, কৃষ্ণকলি, সজীব, আর্টসেল, ব্ল্যাক প্রভৃতি একঝাঁক নতুন একসঙ্গে মোটামুটি নিকটঘেঁষাঘেঁষি টাইমেই নিশান উড়ায়েছিল মনে পড়ে। প্রৌঢ় বয়সের স্মৃতিবিস্মৃতির তালগোলানো অস্বাভাবিক নয় নিশ্চয়। অ্যানিওয়ে। ব্যাপার দুইটা পরপর উপরে রেখেছি, ইউটিউবে অ্যাভেইলেবল্, বলা বাহুল্য। অধিক তথ্য লইয়া যারা কারবার করতে চান, তাদের জন্য উইকির খিড়কি তো চব্বিশঘণ্টাই খোলা।
নাটক দেখতে যেয়ে মেঘদলের গান মনে পড়ল, উল্টাটাও যে হয় না তা নয়, উল্টাটাও হয়। ‘নেফারতিতি’ গান শুনে এমন হয়েছিল অনেক আগে, এই কিছুদিন আগে ‘অবসরের গান’ শুনতে যেয়েও অনুরূপ অভিজ্ঞতা হয়েছে। মেঘদলের (দ্বিতীয়োক্তটা হয়তো ব্যান্ডের হিশেবে মেঘদলের নয়, মেম্বার হিশেবে মেঘদলের, অ্যানিওয়ে) এই দুইটা ভালো কম্পোজিশন নাটকে ব্যবহৃত হয়ে রসভঙ্গ ঘটায়েছিল মনে পড়ে। এই দুইটাই মেঘদলের গান হিশেবে শুনতে বসেছি, নির্দয় পার্শ্ববর্তিনী ঠিক অকুস্থলে ট্যাবে এর নাট্যপ্রযুক্ত রূপটা হাজির করেন, বিশেষ করে ‘অবসরের গান’ কম্পোজিশনটাকে যে-প্রয়োগকর্তা নাটকে পেশ করে ম্যাসাকার করেছিলেন, চ্যাম্পিয়ান সৃজনশীলের গালিটা তার জন্যই ধার্য হউক।
এমন তো হয় হামেশা, নাটক দেখতে যেয়ে গান, বা গান শুনতে যেয়ে নাটক, ইয়াদ হয়। মাঝেমধ্যে এমন আগামাথাছাড়া গানের গল্পও। হতেই পারে, এমন তো হয়, মেঘদলের মন্দ্রস্বরে ব্যাপ্তং যেন চরাচরম্ …
লেখা : সুবিনয় ইসলাম
… …
- গোপালটিলায় গানসন্ধ্যা - February 2, 2021
- গান ও গঞ্জনা - December 1, 2019
- নগরনাট সঞ্জীবস্মরণ - November 21, 2019
COMMENTS