বিকেলের দিকটায় থেকে-থেকে মনে হচ্ছিল, বোকা বনতে হবে না তো শেষমেশ? সূচনা-এপ্রিল, ২০১৭, দুনিয়া জুড়ে এই দিন নিয়া কাহিনি চালু রয়েছে পাল্টাপাল্টি। জিনিশটা খানিক ধর্মসৌত্রিক, অনেকটা গালগপ্পো বলেও মনে হয়েছে ইশকুলবেলা থেকেই; রিলিজিয়্যন তো বটে, এমনকি হিস্ট্রি নিয়াও হুদা টানাটানি করাটা কাজের কিছু নয়; নেহায়েত জরুর না-হলে খামোশ রওয়াই ভালো। ভুল হোক শুদ্ধ হোক ভুলতে না-পারলে, বেবাক মনে রেখে দিলে, একমাইলও মুশকিল এগোনো। তবু মনে হচ্ছিল, রহি রহি মনে হতেছিল, বোকা বনতে হবে না তো অন্তিমে? এপ্রিলফ্যুল ফেনোমেনাটা হাসিয়া উড়াইবার নয়, আবার অন্তিমে হেসেই কিন্তু উড়াইতে হয় ফ্রিকি পৃথিবীহিস্ট্রির তা-বড় তা-বড় ঘটনারাশি। বিকট বানোয়াট বাস্তবের বিকলনগুলো হররোজ ফুঁৎকারে উড়াইয়া দিয়াই-না আমরা বাঁচিয়া থাকি।
সিলেটে এর আগেও অভিজ্ঞতাটা হয়েছিল। বদ অভিজ্ঞতাই বলব। ছোটবেলায় ভিসিয়ারে অমিতাভের বই দেখতে বসে দেখা যেত, ধুর, নকল অমিতাভের বই দিসে ব্যাটায় গছাইয়া! ব্যাপারটায় যাতনা থাকত অকথ্য। বড়বেলায় পাড়ায় বা নিকটস্থ মহল্লায় ব্যান্ডশোয়ের খবর শুনে ভেন্যুতে যেয়ে এহেন নকল মালের মোচ্ছব সইতে হয়েছে বেশ অসংখ্য। লোকমুখবাহিত কন্সার্টপ্রোমো শুনে হৃষ্ট মনে অকুস্থলে যেয়ে দেখা গেল মূল ব্যাপারটা তামাদি ডিক্লেয়ার করা হয়েছে, সেইফটি রিজনে, এবং ঘোষণা আসত অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ অমুক ব্যান্ড রাজধানীর মায়া ত্যাজি বিপন্ন মফস্বলে অ্যারাইভ করতে পারতেছেন না অনিবার্য কারণবশত। লোকসান কাভার দিতে ততক্ষণে দেখা যেত লোক্যাল অমুক-তমুক গ্রুপ ও ননগ্রুপ সোলো আর্টিস্টরা আকাশবাতাস কাঁপাইয়া মাটিমুটি দাপাইয়া গাহিতেছেন সংস্কৃতি-উজালা মাতোয়ালা গানা। আয়োজকদিগেরে গাইলমুইল দিয়াও অবশ্য মজমা ভাঙার আগ পর্যন্ত মঞ্চকিনারা ছাড়তাম না আমরা।
তা, বাত ইয়্যে হ্যায়, স্থানীয় নবিশ কোলাহলকণ্ঠী শিল্পীদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা আলাদা ভাবমাহাত্ম্যে বিবেচ্য হলেও নয়কিলো মোটরঘোড়া হাঁকাইয়া শামিয়ানাখাটানো অনুষ্ঠানস্থলে যেয়ে লেলিহান দাউদাউ লোক্যাল সংস্কৃতিশিল্পসম্ভোগ উঁচু-হারে এক্সপেন্সিভ হয়ে যায়। ভাবছিলাম, অপ্রসন্ন ওয়েদারের পানে বিরস বদনে তাকায়ে থেকে ভাবতেছিলাম, বয়স ও তনাইয়ের যা ভাবগতিক তাতে এই নিবন্ধকার শর্মার রকরিঙ থেকে এইবার অবসর লইবার বেইল বুঝি নিকটে। এদিকে মেঘবাদলির তো সময়জ্ঞান হারাম-একফোঁটাও নাই এতদঞ্চলে, ক্যাটস্ অ্যান্ড ডগস্ ছাড়াও ঐরাবতভারী বৃষ্টিপাত্তি তো অপরিমেয় রয়েছে হেথায়, এই ছাতামাথার শ্রীহট্টে রেইনপাতের এ কী ছিরি গা? মাদান নাই উদান নাই পিক-আপ নিয়া নিলা! ফাজিলের ঝি! মিউজিকের মওকা আধবছরে এক-দুইবার আসে কি আসে না হেন মোল্লামুল্লুকে, এর মধ্যেও তোমার সতিনগিরি!
কিন্তু বকা স্টার্ট করতেই বৃষ্টি স্পিক্টি-নট স্টপড্। অমল-ধবল ঝলমলানো কোয়ায়েট সানি ডে। এই ফুরসতে মেঘদলের মৌসিকি নিশ্চয় দেখেশুনে ফেরা যায় বিকেলের দিকটায়। হ্যাঁ, স্টেজে কেবল শোনা নয় দেখাটাও বড় ব্যাপার একটা। আজকাল স্টুডিয়োয় রেকর্ডেড গানবাজনার উপরে নিরঙ্কুশ আস্থা রাখা যাচ্ছে না। হাবিব ওয়াহিদের অনুসারী সিস্-ব্রো অতটা বাড়বাড়ন্ত যে, দেশে অধুনা ধানচাষ ভুলে বেবাকে দ্যাখো সংগীতরসে ডুবন্ত তথা গানচাষে ব্যস্ত। কী-সব তিলিসমাতি সিস্টেমপত্তর এয়েচে দেশে যে সারগাম না-সাধিয়াই লোকে চ্যানেলে-এফেমে দস্তুরমতো ডোভারলেইন মিউজিক কনফারেন্স দৌড়ায়!
কে কীভাবে এবং কত দক্ষতায় ইম্প্রোভাইজ্ করতে পারছে, কাজেই, যে-কোনো পুরাকালের চেয়ে এখন এক্ষণে এইটা না-দেখিয়া আর্টিস্ট ডিটেক্ট করা আদৌ অসম্ভব। মেশিন ক্যান মেইক য়্যু ফ্যুল্। সরাসরি গিগ্ থেকে ভাইব্ নিতে পারলে ব্যেটার। মনে হলো, সো, ঘুরাণ্টি দিয়া আসি। ‘শিরোনামহীন’ আর ‘মেঘদল’ নামে ব্যান্ডদ্বয় নিয়া খানিক বোঝাপড়া সারার তমন্না আমার দিলের ভিত্রে ঢের দিনরাইত ধরিয়া ঘূর্ণনরত, বয়সও ঘড়িদৌড়ে চলন্ত, হচ্ছিল না। তাছাড়া মেঘদলের স্টেজপার্ফোর্ম্যান্সটাও কোনোকালে দেখা হয়ে ওঠে নাই আগে, এই সুযোগে একটাবার যদি বরাতে জুটিয়া যায় তো মন্দ হয় না। আর মেঘদলের গানাবাদ্য স্টুডিয়োঅ্যালবামেও শোনা হয়েছে ভ্যেরি লিমিটেড, কড়ে-গোনা খানকয়েক, সংগত হোক বা অসংগত কতিপয় কারণে। একটা বা দুইটা নাটকে, টেলিপ্লেতে, মেঘদলপরিবেশনা টাইটেলস্যং হিশেবে শুনেছি ইয়াদ হয়, এক্সপেরিয়েন্সটা ভালো হয় নাই ঠিক সে-সময়। সেসব অবশ্য অন্য গল্প। তবে মেঘদলের ব্যাপারে একটা আগ্রহ, চোরা আগ্রহ, সবসময়ই ছিল; হয়তো-বা তাদের দলনামের কারণে, এবং — হয়তো নয়, নিশ্চিতভাবেই — কিছু তরুণ মেধাবী মিউজিকশ্রোতার মুখে এই ব্যান্ডের ব্যাপারে বেতালা তারিফ শুনে; এবং, কোনো কারণ ব্যতিরেকে বা আনকা কারণেও তো কৌতূহল বহু ব্যাপারেই বিরাজ করে আমাদের মধ্যে, নাকি?
ঠিক সন্ধে নামার মুখে, কেউ তোমার নাম ধরিয়া ডাকলেও থমকাবে না চন্দ্রবিন্দুর গানের ন্যায় এমনই নিয়তে, মেঘদলের গান শুনতে তিনশ’ ষাইট আউলিয়ার শিরোমণি শাহজালালের সায়েন্স অ্যান্ড টেক্নো য়্যুনিভার্সিটি ক্যাম্পাস অভিমুখে রেসের অশ্ব ছোটায় ছাপোষা গানভুখা চারজনের দুইটি পৃথক দল। অর্গ্যানাইজ্ করেছিল য়্যুনিভার্সিটির স্ট্যাটিস্টিক্স ডিপার্টমেন্ট। কী-একটা যেন, কততম মনে নাই, পূর্তি উপলক্ষ্যে সেই ইনিশিয়েটিভটি ছিল। সন্ধ্যা সাত হইতে সাড়ে-দশ পর্যন্ত য়্যুনিকিডদের মনোজ্ঞ সংস্কৃতিচিৎকার শুনে গেছি, খিঁচড়ে গেলেও মর্জিমিজাজ প্যপকর্ন খাইয়ে বেঁধে রেখেছি সিটের সঙ্গে, নেমেসিসের একটা প্যপুলার নাম্বার কাভার করেছিলেন যে-শিক্ষার্থীশিল্পীটি তিনি ব্যতিরেকে এই স্লটে কেউই ইমপ্রিন্ট রাখিয়া যাইতে পারেন নাই এই ধ্যাবড়া গানশ্রোতার কানে, কেবল কণ্ঠরগ ফুলাইয়া বাংলা অ্যাক্সেন্টে আংরেজি গীত গাইবার কোশেশে বেজায় আশার বর্তনে গামলা-গামলা বালি ছিটাইয়া যাওয়া হয়েছে এমন মন্তব্যও উড়ে আসছিল য়্যুনিশিক্ষার সনে সংশ্রবহীন বহিরাগত গুটিকয় ভিয়্যুয়ার শ্রোতাভাইবোনবন্ধুর মুখ হইতে। এদেরও হবে, একদিন, দেখে নিও দাদাঠাকুর! তবে একটু দুধডিমের সাপ্লাইটা বাড়াতে হবে রেওয়াজকালে, এক অনূর্ধ্ব-ছত্রিশ বর্ষীয়ান অভিভাবকের মুখে এহেন প্রশ্রয়বাক্য শুনে ফের ফোড়ন কাটেন আরেকজন এই বলে যে চানঘরে রেওয়াজকালে সেব্য নাকি চানান্তে তা তো বললেন না মশাই! কিন্তু ততক্ষণে, এইসব তামাশা দেখতে দেখতে, মেঘদলের মঞ্চ-আরোহণ অদ্য রজনীতে হচ্ছে না বলেই ধরে নিয়েছি। সিগ্রেট-উইডের খিদেতেষ্টার টুঁটি টিপে রেখে মেঘদলের নামে কেবল দোয়াদুরুদ বখশেছি তিনঘণ্টা টানা। আর কত!
অবশেষে মেঘদল। মঞ্চে এসেই শিবু কুমার শীল স্পষ্টোচ্চার ভরাট গলায় সিলেটে এবং গোটা দেশে জঙ্গি-উৎপাত নিয়া আধা-সাংকেতিক একগোছা বাক্য ব্যয় করে এই ট্যুরে শেষমেশ আসতে-না-পারা তাদের এক দলসদস্য সুমনের ব্যাপারে একটু-কথায় রিগ্রেট করে নিলেন। বক্তব্যাংশটুকু স্বল্পদৈর্ঘ্য হয়েছে বলেই বাঁচোয়া। আজকাল তো সংগীতশিল্পীরা মাঠেময়দানে রাজনৈতিক সভাসমাবেশের অভাব বুঝতে দিতেছেন না আমাদেরে গানের অনুষ্ঠানে রেলগাড়িলাম্পা বক্তিমা শুনাইয়া। শীলের মেঘদল এইটা অতটা করে নাই দেখেই কৃতজ্ঞতা। গানের মানুষ গান দিয়াই জাগাবে, যেমন মনের মানুষ মন দিয়া, বেহুদা বক্তিমা দিয়া না। আটটা গান পরপর গেয়ে গেছেন তিন-তিনজন ভোক্যালবিশিষ্ট দলের একজন গরহাজির থাকায় বাকি দুইজনে। এই দুইয়ের এক শিবু ও অন্য সোয়েব। শেষোক্ত ভোক্যাল-কাম-গিটারিস্টের কথায় একটু পরে আসছি। কিংবা আগে একটু বলে নিতে চাইছি শিবুর গাওয়া বাস্তবিক মঞ্চে পয়লাবারের মতো শুনে সেদিন কি মনে হয়েছিল।
গলায় এত কৌলীন্য, ধ্রুপদ গাইবার মতো কৌলীন্য, কমই কানে পশে আজকাল। শিবু কুমার শীলের গলা, আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, ভারতীয় ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের বলিউডি শিল্পী উস্তাদ রশিদ খানের চেয়েও উন্নত। রশিদ খানের গলা বা গায়ন কোনোটাই নিবন্ধকারের কাপ অফ কফি ছিল না কোনোদিনই, নিরেট ধাতব গলা, নিছক কণ্ঠশক্তি প্রকাশেই যেন রশিদ খানের জোয়ারি ফিনিশ হয়। শিবু কুমার শীলের গলার তারিফ এই কন্সার্টদিন থেকে শুরু হয়ে এই নিবন্ধকারের মুখে বাকি জিন্দেগি বিরাজিবে। একজন বলছিলেন, সঙ্গী মিউজিকশ্রোতাত্রয়ের একজন বলছিলেন, শিবু কুমার শীলের এই কণ্ঠ এই রেন্ডিশনস্টাইল এতই বিশিষ্ট যে এইটা ব্যান্ড/রকসংগীত ঘরানার সঙ্গে স্যুট করে না। তাছাড়া পাঞ্জাবি-জিন্স-চপ্পলপরা শিবু কুমার শীলের স্টেজহাজিরা দেখে সেই শ্রোতাবন্ধু বলছিলেন, এই ড্রেসে প্রেজেন্স এবং শিবুর জেশ্চার সবকিছু মিলিয়ে অ্যাম্বিয়্যান্সের সঙ্গে ব্যাপারটা যায় না। শাদামাটা পাঞ্জাবি-চপ্পলে শিবুর মধ্যে যে অ্যারিস্টোক্র্যাসি ঠিকরে বেরোচ্ছিল, রকমঞ্চের উন্মাদনা-পাগলপনার ধুন তাতে মার খায়। কিন্তু রকমিউজিকের তো সেভাবে ড্রেসকোড নাই, যেমনটা ঠাকুর-কাজীমিউজিকে যেন তৈয়ার করে নিয়েছি আমরা; এইসব চাপান-উতোর অবশ্য অতক্ষণ টানা যায় না। তা, আমার মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশের ব্যান্ডমিউজিকে ভ্যেরি লিমিটেড কয়েকটা কার্ড খেলা হয়েছে এখনও; খুব-বেশি বৈচিত্র্য গোচরীভূত হয় নাই; শিবুর মতো কণ্ঠসম্পদ নিয়া বাংলা ব্যান্ডমিউজিক অ্যারেনায় আঙুলগুন্তি শিল্পীও গরহাজির; বহু ট্রাপিজের ম্যাজিক আজও দেখাবার অপেক্ষায়, ব্যান্ডঘরানায় এখনও বহুদূর যাবার আছে। শিবু কুমার শীলের মতো প্রতিভাদীপ্ত সংগীতশিল্পীর ট্র্যাডিশন্যাল একক ক্যারিয়ার না-নিয়ে ব্যান্ড ফর্ম করা ব্যান্ড/রক ঘরানার দূরগামী ইঙ্গিতের সাক্ষ্যবহ।
মনে পড়ছিল, শিবু কুমার শীলের গলা-গায়ন শুনে, বড়ে-গুলাম খাঁ সাহাব নিত্য আহারে খাঁটি গব্য ঘৃত গ্রহণ করতেন; গলার দানা এবং মর্দানা রাখতেই তিনি ঘি টিন-কে-টিন সাবড়াইতেন রোজকার আহারমাদুরে, এই জিনিশ জেনেছি কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গি’ শীর্ষক গপ্পোগুজবের বইটি থেকে; যে-ব্যাপারটা বলবার, তা এ-ই যে, খাদে নামুক বা চড়ায় উঠুক বড়ে-গুলামজির গলা কোথাও কখনোই চিরে যেতে দেখি না, ফাটা বেসুরো হতে দেখি না, শিবু কুমার শীলের গলা তেমনই। চিরে যেতে হেরি নাই একবারও। মন্দ্রসপ্তকে-তারসপ্তকে ইক্যুয়্যালি ফিট গলা মানবসংসারে বেশি-একটা দেখা যায় না। পাভারোতি নিশ্চয় লাখে এক। আবার, এইটাও অসত্য নয় যে, আপনা মাঁসে হারিণা বৈরী। শিবুর মতো গলা থাকলে সেই গলা সামলাইয়া বা-আদব দরদ-স্যে গেয়ে যাওয়া, গা-জোয়ারি রশিদ খান না-হয়ে সুরজোয়ারি বড়ে-গুলাম হওয়া, চাট্টেখানি কথা না।
তাদের জনপ্রিয় নাম্বারগুলোর মধ্যে একটা সম্ভবত ‘রোদের ফোঁটা’, অডিয়েন্স যেভাবে রেস্পোন্সিভ ছিল গানটা গাইবার সময়, খালি এইটাই নয় বাকি সাতটা গানেও অডিয়েন্স সাড়া দিয়ে গেছে ইক্যুয়্যালি। লিনিয়্যার লাইনঘাটের লিরিক নয় কিন্তু! ফলে, একটা কথা আন্দাজ করাই যায় যে, এই সময়ের তরুণেরা আগেকার যে-কোনো সময়ের চেয়ে বেশি লিরিক্স বোঝে, ভালো সংগীতের ভালো গানের কদর করে এবং করতে চায়। শিবু শুরু করেন ‘রোদের ফোঁটা’ দিয়ে, এরপর সেই বিপন্ন বিস্ময়ের মেঘদলসৃজন ‘নির্বাণ’, লা-জওয়াব! গোটা ব্যান্ডের পরিবেশনাকালীন দোহারকি থেকে শুরু করে মিউজিক্যাল মদদ সমস্তকিছু এতটাই সামবায়িক যে মন ভরে যায়।
এরপর সোয়েব যে লীলা দেখাইলেন, কোটি মন্বন্তরেও ভোলার নয় এমন লীলা, সাংগীতিক তাণ্ডব, যে ভুলে ভুলুক অমিয় চক্রবর্তীর মতো ভুলিব না আমি, কোটি মন্বন্তরেও আমি কভু ভুলিব না। বাপ-রে-বাপ! লিড বাজাচ্ছিলেন, শুরুতে শিবুর দুই গানে সেভাবে খেয়াল করি নাই, উঁকি দিয়ে পেছনের ড্রামস্ গুনতে চেষ্টা করছিলাম, তৃতীয় পরিবেশনায় ‘হ্যালোজেন রোদ’ যেভাবে ছড়িয়ে দিলেন সোয়েব, যেমন গাইলেন যেমন বাজাইলেন যেমন বডি লিঙ্গুয়া দিয়া প্যারালাইজড করিয়া রাখলেন গোটা ব্যাঙ্কুয়েট-হ্যল্, “বাপ-রে-বাপ! রকের কী তুজুর্বা!” — বলা ছাড়া আপাতত কোনো এক্সপ্রেশন মুখে যোগাচ্ছে না।
মাঝরাতে হ্যালোজেন রোদ উঠাইয়াই নিঃশেষ নয়, এরপর সোয়েব আরও-একটা গান আদ্যোপান্ত গাইলেন। ‘ঠিকঠাক’। মেস্মেরাইজিং! সোয়েব গাইবার সময় কিছু-একটা ঘটছিল, “জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রানীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার শালের মতো জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ”, যদিও রুফটপ ছিল আরসিসি ঢালাই, সেদিন এমন আশ্চর্য রাত নামায়ে এনেছিলেন শিবু-সোয়েব মেঘদলে চেপে! সেই মিউজিক্যাল স্পেলে প্রেক্ষাকামরার ভিতরে “আড়ষ্ট-অভিভূত হয়ে গেছি আমি”, জীবনানন্দ হয়েছিলেন যেমন কোনো-এক হাওয়ার রাতে, সেই সাইকেডেলিয়া রাতের “প্রবল নীল অত্যাচার আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছে যেন” … এরই ভিতরে সোয়েবের দীর্ঘ উন্মাদিনী গিটারবাদন যেন “সিংহের হুঙ্কারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মতো” উদ্ভাসনে ভাসিয়েছে আমাদেরে। এবং “হৃদয় ভরে গিয়েছে আমার বিস্তীর্ণ ফেল্টের সবুজ ঘাসের গন্ধে, দিগন্তপ্লাবিত বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে, মিলনোন্মত্ত বাঘিনীর গর্জনের মতো অন্ধকারের চঞ্চল বিরাট সজীব রোমশ উচ্ছ্বাসে, জীবনের দুর্দান্ত নীল মত্ততায়” সেদিন মেঘদলের সাংগীতিক শৌর্যের মধুর প্রহারে।
এমনকিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটছিল শো-চলাকালীন যে প্রেক্ষাকামরার ভিতরে যেন শূন্যে ভেসে যাচ্ছিলাম আমরা, সঙ্গীত্রয় একই ফিলিংস্ শেয়ার করেন, ঘাসপাতালাতা ছাড়াই কিন্তু! ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটিত হয় শো খতম দিয়া রাস্তায় বাইর হয়ে। আমরা যখন বুঁদ হয়ে চেয়ারে সেঁটে মেঘদল শুনছিলাম, শহর তখন সশব্দ ভেঙে যাচ্ছিল প্রচণ্ড শিলাঝড়ের তাণ্ডবে। একেক প্রকাণ্ড শিলা রাস্তায় বেরিয়ে দেখতে পাই আমরা, আইসক্রিমের মতো গলছে তখনও, আধা-হ্যালোজেনালোকিত পথপার্শ্বের ঘাসে। এই শিলা-কি-জওয়ানির তাণ্ডব আর মেঘদলের মিউজিক্যাল তাণ্ডব — বিশেষত সোয়েবের বাদ্যঝঞ্ঝা — দুইয়ে এক হয়ে এমন পরিস্থিতি ক্রিয়েট করেছিল যে চেয়ার থেকে আপলিফটমেন্টের ইল্যুশন আমাদের শরীরে জেনারেইট হয়ে গেছিল। সুতরাং, সেদিন মেঘদল একলা গায়নি, একলা বাজায়নি, মেঘদলেরে সঙ্গত্ করেছিল ভুবনপ্রসিদ্ধ শ্রীহট্টবৃষ্টি এবং শিলা। সে-রাতে পূর্ণিমা ছিল না, আলবৎ, সে-রাতে শিলাবৃষ্টি ছিল।
মোটমাট আটটা গানের মধ্যে চারটার নামোল্লেখ রয়েছে পূর্বপ্যারাগুলোতে, বাকি চারের নাম নিচ্ছি এইবার। শিবুই গেয়েছেন মুখ্যত সব-কয়টা, অ্যাকোম্প্যানিড বাই হিজ্ মিউজিক্যাল কমরেডস্। গান চারটে হচ্ছে — ‘নেফারতিতি’, ‘না-বলা ফুল ফুটবেই’, ‘হারাই/চেনা-অচেনা’ এবং ‘পাথুরে দেবী’। ডিউরিং দ্য শো, অডিয়েন্স থেকে রেলস্টেশনজংশনে ডিমবিক্রেতার “এই ডিম, লাগেনি ডিম, এই ডিম ডিম ডিম ডি …” আওয়াজের মতো সুশ্রাব্য উড়ে আসছিল মেঘদলেরই বিভিন্ন জনপছন্দনীয় গানের রিকোয়েস্ট, যেমন “এই কুমারী কুমারী কুমারী …” ইত্যাদি, কিন্তু অল্পই রিকোয়েস্ট রাখা হয়েছে বাছাদের। যদিও পরিবেশিত সব-কয়টা গানের সঙ্গেই অডিয়েন্স গলা মিলিয়েছে একদম নির্ভুল।
ভেন্যুর পানে যাত্রাপথে পিনিপিনি বৃষ্টি থাকলেও গা করি নাই। ফিরতিপথে, বারো-উত্তীর্ণ মধ্যরজনীতে, ভেসে যাচ্ছিল চরাচর। শিলাঝড়ের তাণ্ডবে মোটরঘোড়া দাবড়াতে ব্যর্থ হয়ে রাস্তাপার্শ্বে চা-ছাপড়ায় কাকভেজা দাঁড়াতেই হলো। কুঁচকানো গোল্ডলিফ আর কুসুমগরম চায়ের সঙ্গে মেঘদলমিউজিকের রেশ রোমন্থন করতে করতে রেইন থামার অপেক্ষা করি আমরা।
[metaslider id=2365]
প্রতিবেদন প্রণয়নকারী : মিল্টন মৃধা
- অন্তরঙ্গ কবিচিত্র - January 28, 2021
- সঞ্জীব চৌধুরী : জীবনতথ্য - November 19, 2019
- বাঁশি ও বিচ্ছেদী - November 16, 2019
COMMENTS