মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনি : অভিযান, রাত, অন্ধকার, অব্যয় … বিচ্ছিন্নতার কাব্যচিত্র || সাব্বির পারভেজ সোহান

মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনি : অভিযান, রাত, অন্ধকার, অব্যয় … বিচ্ছিন্নতার কাব্যচিত্র || সাব্বির পারভেজ সোহান

মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনির (Michelangelo Antonioni) সিনেমায় “কী দেখানো হচ্ছে?” প্রশ্নের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো “কীভাবে দেখছি?”

ইতালিয়ান এই স্রষ্টা [Michelangelo Antonioni] ১৯৪০-এর দশক থেকেই চলচ্চিত্রের সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু, ১৯৬০-এর থেকে আন্তোনিওনির চলচ্চিত্রেরা কথা বলতে শুরু করে সম্পূর্ণ এক নিজস্ব ভাষায়, যে-ভাষা কেবল এবং কেবলমাত্র আন্তোনিওনির সিনেমাতেই পাওয়া সম্ভব।

L’Avventura মুক্তি পায় ১৯৬০ সালে, ১৯৬১-তে La Notte এবং ১৯৬২-তে L’eclisse. এই তিনটি সিনেমাই মূলত সংজ্ঞায়িত করে ফেলে আন্তোনিওনির সিনেমার অসংজ্ঞায়িত বহুমাত্রিক ভাষাকে। অঘোষিত এই চলচ্চিত্রত্রয়ী আন্তোনিওনিকে স্বয়ম্ভূ-স্বীকৃতি এনে দেয় কালের মহৎ চলচ্চিত্রস্রষ্টার। আর, আজ ২০১৪-তে দাঁড়িয়ে নিঃসন্দেহে আমি আন্তোনিওনিকে শ্রদ্ধা জানাই কালোত্তীর্ণ চলচ্চিত্রকার হিসেবে। ফেলিনি, বার্গম্যানের সমসাময়িক আন্তোনিওনি আমাকে মুগ্ধ করেন প্রতিটি ফ্রেমে, তুলে ধরেন ক্যামেরার চোখের ‘আন্তোনিওনিময়-উপযোজনের’ রহস্য।

L’Avventura, La Notte, L’eclisse — তিনটি সিনেমাতেই প্রখর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে আধুনিকতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধের মধ্যকার বহুব্রীহি আন্তঃসম্পর্কের। আধুনিক সমাজব্যবস্থাকে প্রেক্ষাপট হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে তিনটি চলচ্চিত্রেই। আর এই সমাজব্যবস্থার রক্তমাংসের নিচের কঙ্কালটিকে আন্তোনিওনি তুলে ধরেন বাহ্যত মানব-মানবীর প্রেম অথবা প্রেমের পরিহাসের মধ্য দিয়ে। তিনটি সিনেমাই যার যার মতো স্বতন্ত্র কিন্তু ‘থিমেটিক’ দিক থেকে কোথাও না কোথাও এরা একই আয়নার তিনটি ভাঙা খণ্ড। আর সেই আয়না সমাজদর্শন এবং মানববিশ্লেষণের আয়না। এই লেখায় তিনটি সিনেমার গল্পের আলাদা আলোচনা দূরে রেখে তাই আমার মূল বিবেচ্য বিষয় এই তিন চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষা ও ভাষার বহুমাত্রিকতা। যা হয়তো আন্তোনিওনির প্রধান চলচ্চিত্রসমূহের ভাষাকে অনুধাবনেরও প্রয়াস।

Michelangelo Antonioni

আন্তোনিওনির সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যই জ্যামিতিক। চূড়ান্ত বিক্ষিপ্ততার প্রকাশও ঘটে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ জ্যামিতিক দৃশ্যবিন্যাসের মাধ্যমে। ‘Composition’ এবং ‘Mise en scène’-এর সফল, নিজস্ব এবং সার্থক প্রয়োগ ও প্রকাশ আমরা দেখতে পাবো তিনটি সিনেমাতেই। L’Avventura-তে শহুরে মানুষদের মুখোশ উন্মোচন হয় একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে, যা হয়তো বার্গম্যানের ‘পার্সোনা’ দেখার জন্য আপনাকে আবার অনুপ্রেরণা দেবে। আর এই মুখোশ উন্মোচনের প্রবাহে, উপস্থিত জান্তব-বাস্তব মানুষের বাইরেও অধিকতর বাস্তবরূপে প্রকাশ ঘটে পাহাড়, সমুদ্র, আকাশ সহ সামগ্রিক প্রাকৃতিক পরিবেশের। L’eclisse-এ এই বাস্তবতার বহিঃপ্রকাশের ধারক হয়ে ওঠে বস্তু এবং La Notte-তে প্রধান হয়ে ওঠে ভাব। সংলাপের গভীরতা যেখানে La Notte-তে পুনঃপুনঃ প্রকাশিত, সংলাপহীনতাই L’eclisse-এর সবচেয়ে বড় সংলাপ।

L’Avventura-এর ন্যারেটিভের একটি কাঠামো বেশ প্রকট — হারানো একটি চরিত্রের জন্য অনুসন্ধান। সেই প্রকট কাঠামোর পাশাপাশি প্রচ্ছন্ন কাঠামো নিয়ে আবির্ভাব ঘটে আধুনিক সমাজব্যবস্থায় ‘মূল্যবোধ’ নামক প্রহসনপুষ্ট মানব-মানবীর কামনার আখ্যান, যা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে প্রকটের চেয়েও তীব্র এবং স্পষ্ট। অভিযান এবং অনুসন্ধানের আরেক আন্তোনিওনিকাব্য হলো The Passenger [1975]। La Notte-এর ন্যারেটিভ এবং একই সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ফেলিনির La Dolce Vita (1960)-র ন্যারেটিভ নিয়ে তুলনামূলক আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে যে-কোনো চলচ্চিত্রপ্রেমীর জন্য। La Notte-র ন্যারেটিভের প্রকাশভঙ্গিমায় ভাবের ভূমিকা মুখ্য, ফেলিনির ন্যারেটিভে যেখানে মুখ্য প্রতীকী বহিঃপ্রকাশ। La Notte-র ভাষার মূল বক্তা আলো, অন্ধকার, কাচ, দেয়াল, বৃষ্টি; — যা L’Avventura-র পাহাড়, সমুদ্র, আকাশ … এর পরিপূরক। L’eclisse-এর ন্যারেটিভে এসে আন্তোনিওনি বহুমাত্রিক পরিমিতিবোধের সাথে গ্রহণ করেন একান্তরূপে শহুরে কংক্রিট কাঠামোকে। আগের দুটি চলচ্চিত্রের আপাত অব্যক্ত শহুরে কাঠামোরা অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে L’eclisse-ত, যার প্রভাব দেখা যায় তার পরবর্তী সিনেমা Red Desert-এও।

Michelangelo Antonioni

তিনটি সিনেমার ন্যারেটিভের বুনটকে অবিচ্ছেদ্য করে তোলে আন্তোনিওনির বিখ্যাত (নাকি কুখ্যাত!) বিচ্ছিন্নতাবোধ। এই বিচ্ছিন্নতাবোধের প্রকাশ যেমন ঘটে কম্পোজিশন ও ফ্রেমিং-এর দ্বারা, তেমনি ঘটে আন্তোনিওনির অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পাথুরে-তরল অভিব্যক্তিভরা মুখ ও দেহভঙ্গিমার মধ্য দিয়ে। আন্তোনিওনির সিনেমা একবার দেখা উচিত কেবল দৃশ্যবিন্যাস ও শাব্দিক প্রকাশ পর্যবেক্ষণের জন্য, আরেকবার দেখা উচিত সংলাপ ও ঘটনাপ্রবাহে সময়ের ঐক্য অনুধাবনের জন্য, আরেকবার দেখতেই হবে কেবল অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দৈহিক ও মৌখিক অভিব্যক্তি দেখার জন্য [সৌন্দর্যের আরেক নাম হয়ে ওঠে Monica Vitti] এবং আরো অনেকবার দেখতে হবে সময়, অভিব্যাক্তি, দৃশ্যবিন্যাসের সমন্বয়ে আন্তোনিওনি যে পার্থিব পটভূমিকায় অপার্থিব ‘স্পেস’ সৃষ্টি করলেন তাতে নিজেকে দাঁড় করানোর জন্য। বিচ্ছিন্নতার অবিচ্ছিন্ন প্রবাহই আন্তোনিওনির চলচ্চিত্রকে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্বতন্ত্র করে তোলে, যার নাক্ষত্রিক প্রকাশ তার আরেক চলচ্চিত্র Blow Up.

Michelangelo Antonioni‘দৃষ্টিকোণ’ বিষয়টি আন্তোনিওনির চলচ্চিত্রে হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক। এই ক্ষমতা দেখা যায় তারকোভস্কি, জ্যাক তাঁতি, ফেলিনি, চ্যাপলিন সহ খুব অল্প কিছু চলচ্চিত্রকারের মধ্যে। এক্ষেত্রে “যা দেখানো হচ্ছে” তা কোথা থেকে দেখানো হচ্ছে এবং “কোন স্থানের” পরিবেশ দেখানো হচ্ছে এই দুটি বিষয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই দুই প্রশ্নের সমাধা হলে হাজির হয় “কেন দেখানো হচ্ছে?” আর “কতটুকু দুরত্ব ও জায়গা দেখানো হচ্ছে?” প্রশ্ন; আর তখনই দর্শককে হারাতে হয় নিজের মাঝে; পর্দার আলো-আঁধারে জান্তব চরিত্রেরা তখন মিশে যেতে থাকেন দর্শকের প্রথাগত, প্রচলিত, অভ্যস্ত সব জীবনাচরণের মধ্যে। একে একে মুখোশ উন্মোচন ঘটে ব্যক্তি ও সমাজব্যবস্থার। বিচ্ছিন্নতার কবিতা ধীরে ধীরে রূপ নিতে থাকে মনোবিশ্লেষণ, সমাজবিশ্লেষণ ও সভ্যতার সমালোচনায়। L’eclisse-এ কামদেব প্রশ্নবিদ্ধ হন বৈপরীত্যে-ভরা কামনার প্রহসন, L’Avventura-তে প্রথাগত নৈতিকতার দেয়াল ভেঙে পড়ে মানবপ্রবৃত্তির বহুব্রীহিতায়, La Notte-তে সম্পর্কের দায়বদ্ধতা ও প্রতিশ্রুতির মতো গালভরা শব্দরা ক্রমশ অর্থ হারায় রাতের অন্ধকারে।

Michelangelo Antonioniবহুমাত্রিক এই তিন চলচ্চিত্র তাই উপভোগ্য হয়ে ওঠে বিচ্ছিন্নতাবোধ ও অস্তিত্বের শিকড় সন্ধানের প্রয়াসে। একাধিক স্তরে আমরা খুঁজে পাই পুঁজিবাদী উৎপাদনকাঠামো ও সমাজব্যবস্থার তীব্র বিশ্লেষণ, হয়তো-বা কর্কশ সমালোচনাও। বারবার ঘুরেফিরে আসে বিচ্ছিন্নতা, তবুও ভালোবাসা, তবুও অবক্ষয় অথবা উত্তরণের কবিতা। প্রতি মুহূর্তই হয়ে ওঠে স্বপ্ন অথবা মোহ অথবা শূন্য। চলচ্চিত্র দর্শনের আরেক নাম তাই হয়ে ওঠে আন্তোনিওনি দর্শন — স্বয়ম্ভূ, নমস্য, কাব্যিক … নৈসর্গিক এবং বাঙময়।

 

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you