শেষ প্রণাম || শিবু কুমার শীল

শেষ প্রণাম || শিবু কুমার শীল

একজন মিতা হকের চলে যাওয়া বেদনাদায়ক। বড় ক্ষতি। ঠাকুরের গানকে যারা একটা জীবনাচার হিসেবে দেখেছেন এবং সেইমতে তাকে নিজের দর্শনে, যাপনে অনুভব করেছেন মিতা হক ছিলেন তাদের একজন। তবে তিনি ঠাকুরের গানের ব্যাপারে অন্যান্য প্রাচীনপন্থীদের মতো গোঁড়া ছিলেন না। বরং তার সহজ সাবলীল ভঙ্গি আর গান পরিবেশনের ক্ষেত্রে তিনি আধুনিক আঙ্গিককেই বেছে নিয়েছিলেন।

তিনি রবীন্দ্রনাথের গানকে বুঝতে চেয়েছেন তার সময়ের প্রেক্ষিতে। একটা অলীক সময়ের ঘেরাটোপে আটকে ছিলেন না। তাঁর উচ্চারণরীতি এই সময়েরই ছিল। তিনি অন্যদের মতো সংগঠক হতে গিয়ে নিজের যে চর্চা, তপস্যা ছিল তার থেকে বিচ্যুত হননি। সুধীর চক্রবর্তী ঠাকুরের গানকে বলতেন ‘নির্জন এককের গান’। এই-যে গানের ভেতরের নির্জন এককের সন্ধান সে-অনুসন্ধানে তিনি সত্যিই এক নিঃসঙ্গ পদাতিক ছিলেন। ঠাকুরের গানের কালাম আর সুরের আধ্যাত্মিকতা তিনি মরমে অনুভব করেছিলেন।

কলেজে থাকতে নিয়ম করে ঠাকুরের গান শুনতাম। তখন যে অল্প ক-জন আমার প্লেলিস্টে ছিল তিনি তাদের একজন। ক্যাসেটের এ পিঠ বি পিঠে তাঁকেই শুনতাম নানা বিরহে, আনন্দে। যখন ইউনিভার্সিটিতে উঠলাম তখন ঠাকুরের গানের নানা ফিউশন অল্প অল্প দেখতে পাচ্ছিলাম। সকলেই যেন এতদিন পর সেই সুযোগটা পেল যে ঠাকুরকে এক হাত দেখে নেবে। এবং এতকাল যে-রবীন্দ্রচর্চা হয়েছে গানে তাকে ভেঙেচুরে এক সা করে ফেলার অঙ্গীকার করেছিলেন অনেকেই। আজ যদি সেই গ্রুপটার দিকে তাকাই তাহলে দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতে হয় সেসব কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে।

লালনের গানের ক্ষেত্রেও সেই ফিউশনচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। তবে দেবব্রত বিশ্বাস থেকে কবীর সুমন এমনকি অর্ণবের যে ইন্টারপ্রেটেশন তার একটা ভিন্নতর তাৎপর্য আমরা সাম্প্রতিক রবীন্দ্রনাথের গানের চর্চায় দেখতে পাই। কিন্তু একেকটা যুগে এমন বহু হিড়িক লক্ষ করেছি আমরা সেই হিড়িক একটা ধ্রুপদিপনায় পৌঁছায় না কখনও। সেটা যুগের বুদবুদ হয়েই মিইয়ে যায়। নয়তো আজকে লোকগানের ক্ষেত্রে মানুষ আখড়ার বা একদম সত্যকারের বাউলের সন্ধান করত না। সে প্ল্যাস্টিক ফোকেই খুশি থাকার কথা। তার বাউলের অপেশাদার গলার মধ্যেই সে পায় আসল প্রাণ। তৈরি করা ম্যাকানিজমকে শ্রোতারা এই ক্ষেত্রে বর্জন করেছে। তেমনি ঠাকুরের গানেও একটা যাপন ও বিশ্বাস যার মধ্যে নেই তার কণ্ঠে সে-গানকে তেমনি দূরের আর অচেনা লাগে। আপন করে নেওয়া যায় না।

কথাপ্রসঙ্গে অর্ণব একদিন বলছিলেন যে একটু নির্দিষ্ট ম্যাকানিজম বা গাইতে পারি বলেই গেয়ে দিলাম এমন শিল্পীদের গলায় ঠাকুরের গান শুনলে মনে হয় ‘কী একটা যেন নেই’। এই-যে কিছু একটা নেই এর অনুভূতি — এটা গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। এটা স্বতঃস্ফূর্ত। মিতা হক সেই ফিউশনের জোয়ারে গা না ভাসানো মানুষ। তার মঞ্জিল তিনি ঠিক জেনেছিলেন। ধ্যানস্থ বুদ্ধের মতো চারপাশের ডামাডোলের ভিড়ে রবীন্দ্রনাথকে তিনি বুঝেছেন নিজের বোধিতে। কোনো বাজারের চাপিয়ে দেয়া প্রভাবে নয়।

তাঁর এই চলে যাওয়া আমাদের পেছালো। একজন গুরুর প্রয়াণের মতোই বিষাদময় গভীর ক্ষতির মতো। আমি জানি না তাঁর সুদীর্ঘ সংগীতজীবনের কোনো লিখিত বা অডিয়োভিজুয়্যাল ডকুমেন্টেশন আছে কি না; যদি না-থাকে, আমাদের এবং পরবর্তী সময়ের মানুষদের জন্য তা সত্যিই অপূরণীয় ক্ষতি হয়েই থাকল। এই সংগীতগুরুকে আমার শেষ প্রণাম।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you