তোমার পথ ঢেক্যাছে মন্দিরে-মসজিদে
ও তোর ডাক শুনে সাঁই চলতে না পাই
আমায় রুখে দাঁড়ায় গুরুতে-মুর্শেদে।
দ্বৈত পথ, দ্বৈত সত্তা, এমনকি দ্বৈত প্রেমও ছিল যুগে যুগে। যতই অঙ্গুলিনির্দেশনে বলা হউক একক সত্তার কথা।তবে তিনি অসীম, — ঈশ্বর; — সৃষ্টিকর্তা তার কঠিন প্রয়োজনেই ডেকে নিয়েছেন নিজের কাছে; লাভ? তাকে ডাকা হইব, নামজপ করা হইব। আমার তাতে কি ? — সাতটি জান্নাত-দরজা! তাইলে ক্যামন হইল? সেই তো দেয়া আর নেয়া!
আর এই দেয়া-নেয়ার খেলাটা কিন্তু শুরু করেছিলেন তিনিই। অসীম তিনি। কথা একটাই, — ডাকো, পাবে। কি পাব? জানি না। ডেকে যাই অন্ধের মতো, পথ খুঁজি পথের মাঝে, ঢুইকা যাই মন্দিরে কিংবা মসজিদে … সেইখানে সত্তা আরো উন্মুখ থাকে অসীমরে কাছে পাওয়ায়। ছুটে যাই — উকিল-ব্যারিস্টারের (পীর-মুর্শিদদের) কাছে। সেখানেও তো শান্তি নাই। কী ভীষণ ভজঘণ্ট!
তো, কই যাই? এত শাপ — এত অভিশাপ — লইয়া আমি এখন কোন-বা দিকে যাই? এতই যদি আমাগো ভালোবাসো, তয় ক্যান এত এত পথ বানাইলা? সাবধানে পথচলার কড়া নির্দেশে কতই-না বই ছাপাইলা … সৃষ্টির প্রশংসা শুনবার লাইগা ছাইড়া দিছে এক চরকাবাত্তি। বিজলিটা খালি নেভে আর জ্বলে। নেভে-জ্বলে বিরামহারা। যার চোখে আলো লাগে সে-ই পথ পায় — যার চোখে আন্ধার লাগে সে হারায়া যায় …
ডুইব্যা যাতে অঙ্গ জুড়াই
ওরে তাতেই যদি জগৎ পুড়াই,
তবে অভেদসাধন মরলো ভেদে।
সাধু … সাধু্ … কী কথা! কী কথা! আরে, আবার তো সেই ভেদ আর অভেদ! তাইলে কইতে পারি এইসবের খেলা সাধন-ভজনে ডুইব্যা সাঙ্গ করলেও ক্যামনে ক্যামনে জানি জগৎও পুড়াইয়া দিছে। পথ খুঁজতে পথের মাটি হইল যে-গুরু, তার কাছে পইড়া থাকে কেউ, আবার কেউ-বা শান্তি পায় মসজিদ-মন্দিরে সেঁধিয়ে থেকে।
ওরে প্রেমদুয়ারে নানা তালা —
পুরাণ, কোরান, তসবি-মালা —
হায়, গুরু, এই বিষম জ্বালা
কাঁইদ্যা মদন মরে খেদে।
এইবার মদনবাউল যা কইলেন, ভেদাভেদ বুঝে সেরে শেষতক যখন প্রেম এসে দুয়ারে দাঁড়ায়, তখন আবার সেই ভিন্নতারই সামনে? … একটা দুয়ার খুলতে এত্ত তালা ক্যান তিনি রাখলেন? পুরাণ, কোরান … এত এত তালা ঝুলাইয়া রাখছেন প্রেমদুয়ারে। পুরাণেও দেখি দুইটা ভাগ — মহাপুরাণ আর উপপুরাণ — যা যথাক্রমে বিষ্ণুপুরাণ ও ভগবতপুরাণ; — উভয়ের আলোকে মানুষের স্বরূপ ও মনের পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি উপলব্ধি করার চেষ্টাই মাত্র। একমাত্র কোরানেই একপথের নির্দেশ আছে।
মদনবাউল যতই তসবি-মালা গলায় লইয়া কান্দুক-না কেনে, প্রেমের জ্বালায় জ্বলতে হইলে তালা তো তারে খুলতেই হইব। পথের ডাক কানে আসতে হইব। যে-পথ আমার গুরু আর মুর্শিদে দেখাইছে বিলীন হইয়া যায় … পথের মাটি সইরা গেলে অথৈ জলে ভাসব … আরে নিজের মাঝে ডুব দিয়া তুইলা আনো যত্ত তসবি-মালা … ও আমার ক্ষ্যাপা মন …
সেদিন আমি আর মদনবাউল ছিলাম সাধুসঙ্গে, সঙ্গোপনে, শেষপথ বইলা কোনো পথ কি আছে? জানি না। আমি আর মদনবাউল সত্য আপাতত। মদন গাইলেন … আমি শুনলাম …
তোমার পথ ঢেক্যাছে মন্দিরে-মসজিদে
ও তোর ডাক শুনে সাঁই চলতে না পাই
আমায় রুখে দাঁড়ায় গুরুতে-মুর্শেদে।
ডুইব্যা যাতে অঙ্গ জুড়াই
ওরে তাতেই যদি জগৎ পুড়াই,
তবে অভেদসাধন মরলো ভেদে।
ওরে প্রেমদুয়ারে নানা তালা —
পুরাণ, কোরান, তসবি-মালা —
হায়, গুরু, এই বিষম জ্বালা
কাঁইদ্যা মদন মরে খেদে।
যখন ফিরছিলাম, মনে মনে কইলাম, মদন মরুক খেদে, আমার তাতে কি? আমি যাই, অসীমরে জিগাই, — এইসব সসীমগো আব্দার নিজগুণে পারবেন কি করতে এতটুকুও ক্ষমা …?
… …
- মদনবাউলের গানপঙক্তি || জিনাত জাহান খান - August 23, 2017
COMMENTS