মণীন্দ্র গুপ্ত বিষয়ক মনোলগ

মণীন্দ্র গুপ্ত বিষয়ক মনোলগ

মণীন্দ্র গুপ্ত পড়ছিলাম, আর অবাক হচ্ছিলাম, আর মুগ্ধ হচ্ছিলাম। অবাক হচ্ছিলাম? মুগ্ধ হচ্ছিলাম? কেবল অবাক হচ্ছিলাম আর মুগ্ধ হচ্ছিলাম? সে-তো কত বই আর কত লেখক পড়েই হই, জীবনভর শুধু অবাক আর মুগ্ধ হওয়ার কাজটাই তো যথাগুরুত্ব করে চলেছি সর্বত্র, এ আর কী এমন! মণীন্দ্র গুপ্ত পড়ছিলাম আর, বলা ভালো, বাকবিরহিত রইছিলাম। স্তব্ধবাক দূরের দিকে, যতদূর মনের চোখ যেতে পারে ততদূর, তাকিয়ে থাকছিলাম। উদাস, উদ্ভাসিত। উদাস তবু/এবং উদ্ভাসিত। মণীন্দ্র গুপ্ত এমনই লেখক, যিনি একইসঙ্গে উদাসীন ও উদ্ভাসিত করে তুলতে পারেন।

উদাসীনতার উদ্ভাসন, উদাসীনতার সৌন্দর্য, উদাসীনতার নন্দন আমাদের সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ জায়গা জুড়েই ছিল। উপনিষদের ঐশ্বর্য তো তা-ই, না? আমরা আমাদের বাপ-জ্যাঠাদের আমলেও দেখেছি এমন। এখনকার অবস্থা জানি না, এখন চোখ বুঁজে পিঠে কুঁজ নিয়ে চুপচাপ চলিফিরি। কিন্তু, সে-যা-হোক, মণীন্দ্র গুপ্তে ওই জিনিশটি ফিরে দেখবেন আপনি। এক-ধরনের অভূতপূর্ব উদাস উদ্ভাসনে, একপ্রকার উদ্ভাসিত উদাসীনতায়, আপনাকে ভরিয়ে তুলবেন তিনি। এক-ধরনের উদ্ভাসিত উদাসীনতার বীজ ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর বাক্যরচনায়। এমন লেখক কি আর-কেউ আছেন?

আছেন, জীবিত, আরেকজন। ঔপনিষদিক উদাসীনতার ওঙ্কার উৎসারিত হয় যাঁর রচনারাজি থেকে। নিরিবিলি শান্তি ও অশ্বত্থমন্দ্র ঝিরিঝিরি সমাহিতি। তিনি শঙ্খ ঘোষ। দু-জনেই যুগপৎ দৃঢ় ও নরম। পেটরোগা প্রেমিক নন, দাঁত-ধসানো দার্শনিক নন; অথচ প্রেমিক, অথচ দার্শনিক। ভেবে খুব ভালো লাগে, এমন দু-জন মানুষের জীবনকালে যাপন করছি আমিও আমার জীবন। দু-জনেই আমার, সশরীর না-হলেও, ভাবনার নিত্য-সহচর। পেণ্নাম শঙ্খ বাবু, গুপ্ত মশাই, পেণ্নাম!

মণীন্দ্র গুপ্তের শ্রেষ্ঠ কবিতা,  ভারতের দে  প্রকাশিত, অনেককাল যাবৎ সঙ্গে রাখছেন আপনি। শিথানে দাঁড়ানো বইতাকিয়ায় রেখেছেন মণীন্দ্রশ্লোকসংগ্রহ। কবিতার প্রেমিক পাঠক আপনি, যিনি এই এক অর্ডিনারি দীনহীনের দিনপঞ্জিপ্রতিম ফেবুকলাম/নিবন্ধ পড়ছেন এই মুহূর্তে, আমি জানি। তাঁর গদ্যগ্রন্থের মধ্যে কুড়ানী দারুমা সানজনমানুষ বনমানুষ  আলাদা-পৃথক গ্রন্থাকারে পড়েছি আগে। এরপর গদ্যসংগ্রহ  বেরিয়েছে তাঁর, বেরিয়েছে আত্মজীবনী অক্ষয় মালবেরী,  মধুর ও উজ্জ্বল উদাসবিধুর অভিজ্ঞতা সেসব। ও, ভালো কথা, আৎখা মনে পড়ল, তাঁর শুরুর দিককার একটা কাব্যগ্রন্থের নাম অক্ষয় বটের দেশ পেরিয়ে।  একটা হারিয়ে-যাওয়া কুয়াশাদেশে ফিরে যাবার অনুভূতি হয় কবিতাবইয়ের নামটা শুনেই, হয় না? যা-হোক, সম্প্রতি তিতপুরানা আমলের কিছু ছোটকাগজ খুঁজতে যেয়ে বেশ-কয়েকটি মণীন্দ্রপ্রবন্ধ চোখ বুলিয়ে নিলাম আবার। আবার, আরেকবার, স্তব্ধবাক অবস্থায়। এবার পড়তে যেয়ে মনে হলো, কবে যে দুম করে মরে যাই তার ঠিক নাই, অন্তত সপ্রণাম প্রেমটুকু প্রকাশিয়া যাই রেফারির বাঁশি বেজে ওঠার আগে।

এবং মণীন্দ্ররচনার ঔজ্জ্বল্য-ঔৎকর্ষ সম্পর্কে কথা বলার বিদ্যে তো পেটে নাই, আমি তো ভাই ক্রিটিক কিংবা বুকরিভিয়্যুয়ার না, তাই দুইটা উদ্ধৃতি নিবেদন করি আপনাদের করকমলে। এগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদনাচয়িত ভাববেন না যেন, সম্পূর্ণ দৈবচয়িত উৎকলন। উদ্ধৃতিদুটো টুকছি তাঁর প্রথম গদ্যগ্রন্থের অন্তর্ভূত একটা প্রবন্ধ হিতোপদেশ  থেকে। গদ্যকার মণীন্দ্র গুপ্তের অভিষেক হয়েছিল চাঁদের ওপিঠে  নামের একটা খাটো-বহর ছোটো-গতর আশ্চর্য বই দিয়ে, যা ছাপা হয়েছিল ১৯৯১ খ্রিস্ট-অব্দে, সেখানে তিনি একটু-পরেই-উদ্ধৃত কথাগুলো বলে রেখেছেন। কয়েকজন বন্ধু আছেন আমার, যারা খুব কবিতামাতাল, যারা কবি হিসেবে গত দুই-দশকের বাংলাসাহিত্যে বেশ ভালো অবদান রেখে চলেছেন, তাদের কাছে এ-দুটো উদ্ধৃতি উপভোগ্য মনে হবে। এর বক্তব্যগুণেই তারা উদ্ধৃতিদ্বয় পড়বেন। যারা অবশ্য উচ্চাঙ্গ, মানে কিনা যারা মার্গীয়, অর্থাৎ ধ্রুপদের সমুজদার যারা, তারা ক্ল্যাসিক্যাল-ননক্ল্যাসিক্যালের ঢক্কানিনাদে মেতে রইবেন, তা তো আর বলতে হয় না। তারা মণীন্দ্রের বক্তব্য নয়, গলা খেয়াল করতে পারেন, দেখুন কী উদাত্ত ও নম্র ও খোলা! আশার কথা এ-ই যে, তারা এসব খেয়াল করবেন না। কারণ তারা, ভাগ্যিস, কিছুই খেয়াল করেন না। তারা খেয়াল করবেন কেন, তারা খেয়াল গান। করা  পপুলার জিনিশ, ছোটলোকের অ্যাকশন, গাওয়া  ক্ল্যাসিক্যাল — খান্দানিদের রিফ্লেকশন! মনে রাখবেন।আসুন, এবার, উদ্ধৃতি :

“প্রকাশ্য কবিত্বই কবিতার সবচেয়ে বড় শত্রু। সেই অলস জড়তা থেকে মুক্তি পাবার প্রথম উপায় হচ্ছে, ভাষা পাল্টানো — তথাকথিত কবিতার ভাষা নয়, মানুষেরই জীবন্ত ভাষাকে ধরে নিবিড় এবং ব্যাপক পরীক্ষা চালাতে হবে। শব্দের জন্য মন্থন করতে হবে অভিধান — যাবতীয় বিষয়ের অভিধান, আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, এমনকি স্ল্যাঙের অভিধানও। বাক্যের গঠনের জন্য ঢুঁড়তে হবে লোকভাষার সরল লাবণ্য ও অমোঘতা, নগরভাষার কৌণিকতা, চতুরালি ও দীপ্তি। অনুধাবন করা দরকার সুদূর সন্তদের অবিচল ভাষা এবং সমাজ-বহির্ভূত জীবনের উঞ্ছ ভাষা। এক কথায়, বাক্য তথা ন্যূনতম প্রকাশ-ভঙ্গিমার জন্য যেতে হবে স্বর্গ মর্ত্য পাতালে। চেতন ও অবচেতনে এ সমস্ত জমে ওঠার পর আরম্ভ হবে কবিসত্তার নিজস্ব কাজ।”

তা, আরম্ভ হলো কবিসত্তার কাজ, তারপর? এর-ওর পিছে লাগা? আমার কানে তাহার নামে তাহার কানে আমার নামে কুৎসার শিশা ঢালা? তা-ই। কিন্তু মণীন্দ্রবাবু বলছেন অন্য। মুশকিল! শোনা যাক :

“কবি কোনোকালে গণ্ডায় গণ্ডায় জন্মায় না। সুতরাং কবিতালেখক, আপনি নিজেকে দুর্ভাগা মনে করবেন না, উদ্বিগ্ন হবেন না, রেডিও টেলিভিশন সংবাদপত্রে প্রচারিত হবার জন্যে ছুটোছুটি করবেন না। বরং বাসনাহীন হয়ে বইটি নিজের খরচায় ছাপুন, এবং তারপর শক্ত মলাটে বাঁধিয়ে, ভালো করে কীটনাশক মাখিয়ে কালের গর্ভে নিক্ষেপ করুন। মৃত্যুর পরে, অনেকদিন পরে, আপনি জানতে পারবেন আপনি কবি ছিলেন কি না।”

হায় হায়! কী কয়! এইটা সম্ভব? অস্ত্বিত্ব রইল কই তাইলে! এইটা একটু বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় না! তা যায়, বাদ দেন, ঢোল হাতে নেন আর দোহারদের ডাকেন …

মণীন্দ্র গুপ্ত, ও শঙ্খ ঘোষ অবশ্যই, দ্বিশতায়ু হবেন কমের মধ্যে হলেও! মহাকালের হিসাবটা আমার ক্যাল্কুলাসদক্ষতায় ঠিক কুলিয়ে উঠতে পারি না।

জাহেদ আহমদ ২০১৩

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you