প্রসঙ্গ মুচকুন্দ্ দুবে এবং ফকির লালনের হিন্দি তর্জমা || মাকসুদুল হক

প্রসঙ্গ মুচকুন্দ্ দুবে এবং ফকির লালনের হিন্দি তর্জমা || মাকসুদুল হক

গত ২৭ মার্চ ঢাকায় একটা আলোচনা অনুষ্ঠান হয়ে গেল ফকির লালন শাহ এবং অশান্তিবিপর্যস্ত দুনিয়ায় তাঁর বাণী বিতরণের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে। ‘ডেইলি স্টার’ এবং একই ঘরের বাংলা দৈনিক ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা মারফতে সেই অনুষ্ঠানবিবরণ জানতে পারলাম। অনুষ্ঠানের মুখ্য বক্তা মুচকুন্দ্ দুবে বাংলাদেশে বেশ পরিচিত, কয়েক বছর আগে তিনি ইন্ডিয়ান হাইকমিশনার হিসেবে এখানেই ছিলেন নিযুক্ত, অনুষ্ঠানে তিনি হিন্দি ভাষায় লালনের কাজকর্ম অনুবাদের আবশ্যকতার ওপর গুরুত্ব রেখে বক্তব্য দিয়েছেন। অনস্বীকার্য যে লালনের প্রতি শ্রী দুবে যে-অনুরাগ দেখিয়েছেন তা নিখাদ, হয়তো গভীরতর ভক্তিও রয়েছে তাঁর লালনকর্ম ও জীবনচর্যা বিষয়ে, তবে এখানে আমরা তাঁর বক্তব্যে প্রকাশিত কয়েকটি দিকের আপাত-নিরীহ অথচ অপূরণীয় প্রভাববিস্তারী বিপদের আশঙ্কা নিয়ে কথা বলতে চাই। তিনি অত্যন্ত সদর্থেই ঋষি লালন ফকিরের ‘বাণী বিশ্বলোকে ছড়িয়ে দেয়া’ আবশ্যক মনে করছেন যাতে ‘সেই বাণীমঞ্জরি বিশ্বজোড়া পাঠাগার ও বইদোকানগুলোতে সসম্মান স্থান খুঁজে নিতে পারে’ এবং এভাবেই লালনের মর্তবা আদ্বিজচণ্ডাল দুনিয়াবাসী হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে এহেন বোধ সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনের পরিসরে অক্ষরমূর্ত না-থাকলেও নিহিত বক্তব্য ওইদিকেই ইঙ্গিত করছে। এছাড়াও প্রতিবেদনোক্ত অন্যান্য মন্তব্য ও অন্তর্গত অনুবোধন-বিবেচনা আমাদের চোখের সামনে একটি বিশেষ মনোভঙ্গি দৃশ্যায়িত করে, যে-মনোভঙ্গিটি ইন্ডিয়ার অধিপতিবৃত্তি এবং ভাষিক ও সাংস্কৃতিক অভিভাবকতা লাভের অভিপ্রায় ছাড়াও অদূর ভবিষ্যতে এই ঋদ্ধ লোকবৈচিত্র্যের ভূখণ্ডে ব্যাপ্ত সম্পদের সুরক্ষা ব্যাহত করবে বলেই আমাদের আশঙ্কা। আমরা ভারতীয় প্রতিবেশী সংস্কৃতির সঙ্গে লেনাদেনাগত সর্বপ্রকার উদ্যোগে আন্তরিক, আতিথ্যপূর্ণ ও উদার থেকেও অবয়বে বৃহদাকার হবার কারণেই মোড়ল মানসিকতাবাহী ইন্ডিয়া এবং অনুরূপ যে-কোনো বহিঃস্থ/আভ্যন্তরীণ পক্ষের আধিপত্যশীল প্রবণতার ব্যাপারে নিজেদেরকে সজাগ ও সোচ্চার রাখতে চাই পৃথিবীরই নিরঙ্কুশ সম্পদ তথা আবহমান লোকচৈতন্যবাহিত প্রজ্ঞার ভাণ্ডারগুলো সংরক্ষণ ও সুরক্ষার স্বার্থেই।

ঠিক এই অধিপতি-আচরণগত মনোবৃত্তির কারণেই ফকির লালন সাঁইয়ের বাণীনিঃসৃত ভাব এবং তাঁর জীবনচর্যাজাত বক্তব্যবৈভব সম্ভাব্য ব্যবহারকারী কর্তৃক বিপথগামী হয়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কা থাকিয়া যায়। ‘মানবজাতি এক ও অভিন্ন’ যদি হয় সেক্ষেত্রে অধ্যাপক দুবে যেভাবে এই মানবতার জয়গাথা-গাওয়া লালনবাণীর সম্প্রচার চাইছেন উৎসভাষার বাইরেকার একটি ভিনভাষার মধ্যস্থতায়, এই চাওয়া এবং এর নেপথ্য প্রক্রিয়া আমাদের কাছে গোলমেলে এবং স্ববিরোধী বিবেচনা বলেই মনে হচ্ছে। কেবল তা-ই নয়, এহেন অভিলাষ এবং তা পূরণপ্রক্রিয়া সার্বিক বিচারে দক্ষিণ এশীয় মুক্তির দর্শনের সঙ্গেই বিরোধপূর্ণ ― গোটা অঞ্চলে এমন একাট্টা মুক্তিদর্শন বলিয়া আদৌ কিছু যদি-বা থাকে ― মহাত্মা লালন ‘জগৎমুক্তি’ প্রত্যয়ের কাছে পুনঃপুনঃ প্রণত হয়েছেন আমরা দেখতে পাই নিশ্চয়। প্রাচীন উপমহাদৈশিক ‘ভক্তি আন্দোলন’ যাত্রারম্ভ করেছিল ‘পরম মুক্তি’ ধারণাটির প্রচার করে, এই ইতিহাসবিচ্ছুরিত তথ্য অধ্যাপক দুবের অজানা নয় আশা করি। কিন্তু পরিতাপের ব্যাপার এখানেই যে অধ্যাপক দুবে কর্তৃক প্রদত্ত বক্তব্য উপস্থাপনের অব্যবহিত পরে যে-আলোচনা, ‘লালন ফকিরের সাধনা’ শীর্ষক, বাংলাদেশের পণ্ডিত-গবেষক-পেশাজীবী ‘বিদ্বৎসমাজ ও বুদ্ধিবৃত্তিজীবীবৃন্দ’ অংশগ্রাহী ছিলেন যেখানে, প্রথানুবর্তী  কিছু স্থূল তোষামোদালাপ ছাড়া কাউকেই ঠিক বিষয়প্রাসঙ্গিক সামঞ্জস্য ও পরিপ্রেক্ষিত অবলোকনে রেখে মুচকুন্দবক্তব্যের প্রাপ্য অখণ্ড আলোচনা চালাতে চেয়েছেন বলে অন্তত প্রতিবেদনে তিল পরিমাণেও প্রমাণ পাওয়া যায় নাই।

কিন্তু কবুল করে রাখি শুরুতেই যে লালনকাজের অনুবাদ বা ভাষান্তর প্রভৃতি প্রচেষ্টার বিরোধিতা আমরা করছি না, আর হিন্দিবিরোধিতা বা হিন্দি নিয়া আহ্লাদেরও তো প্রশ্নই ওঠে না, আমার আপত্তি মূলত মুচকুন্দ্ দুবে মহোদয়ের তর্জমাপ্রাকল্পিক বক্তব্যে জোরারোপিত কতিপয় ইশারার জন্য; যদি হিন্দিতে লালনপদাবলি অনূদিত হয়, অধ্যাপক দুবে বলছেন, সাঁই লালন ‘বিশ্বশ্রোতৃমণ্ডলীর’ কাছে পৌঁছাতে পারবেন ― খটকা লাগে এখানেই এবং এর ফলে বেশকিছু প্রসঙ্গ ও তর্কানুষঙ্গ উঠানোর জরুরৎ তৈয়ার হয়।

একদম গোড়ার জিজ্ঞাসা, আদৌ কি হিন্দি বিশ্বভাষা কোনো? অন্তত কোথাও কোনো অনুমোদনপ্রদায়ক উৎস থেকে কি হিন্দি বিশ্বভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এ-পর্যন্ত?

যদিও কথ্যভাষা তথা মৌখিক বুলির তালিকা সবসময় বিতর্কিত একটি বিষয়, একবাক্যে এটা আমরা স্বীকার করব যে ইন্ডিয়ার বিপুল জনসংখ্যার কারণে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় হিন্দি গরিষ্ঠজনের কথ্য ও বোধ্য ভাষা হিসেবে এতদঞ্চলে প্রণিধানযোগ্য। তবে ‘এথনোলগ রিপোর্ট ২০১৫’ তথ্যানুসারে বাংলা প্রায় ২১ কোটি ভাষাভাষী নিয়ে বিশ্বের প্রভাবশালী ভাষাসমূহের মধ্যে অষ্টম স্থানাধিকারী, যেখানে উর্দুভাষীদের সঙ্গে নিয়েও হিন্দি বিশ্বের ব্যবহার্য প্রভাবশালী ভাষাপরিবারে এগারোতম স্থানে এবং উর্দু মিলিয়ে হিন্দিভাষী জনসংখ্যা মোটমাট ১৬ কোটি। রিপোর্টতথ্য যদি মিথ্যে না-হয় এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বসাধারণ ছাড়াও ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের বিপুল বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর যদি হিন্দি বুঝতে বেগ পেতে না-হয় সেক্ষেত্রে হিন্দিভাষীদের সমস্যাটা কোথায় বাংলাটা আগে একটুখানি শিখে নিয়ে পরে ফকির লালনের দুনিয়াদারি স্বীয় বোধিগম্য করে নিতে?

ব্যাপারটা আমোদপ্রদ হলেও উপেক্ষণীয় নয় যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ঠিক একমাস বাদেই হিন্দি ‘বিশ্বভাষা’ হিসেবে একটা প্রাথমিক স্বীকৃতি অন্তত বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছে; এই সভায় সমবেত পণ্ডিতবর্গ যারা বাংলাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতির পৌরোহিত্য করে বেড়ান উদয়াস্ত, নৈতিকভাবে দেউলিয়া এই বিদ্বৎসমাজের উচিত ছিল সভায় বাংলা ভাষার উপর জোর দেয়া, বাংলায় লালনভাব প্রকাশভঙ্গির বাদবিসম্বাদ নিয়ে একাধটু কথা বলা, ― তাতে এহেন অপবাদ নিশ্চয় কেউ দিত না যে জাতি হিসেবে আমরা ভাষাধিপত্যকামী কিংবা আন্ধা স্বাদেশিকতায় বিশ্বাসী জাতি আমরা, বা তাতে এটাও প্রমাণিত হতো না যে আমরা মানসিকভাবে সঙ্কীর্ণ, ― বরং সেই সহজ সত্যটা আরেকবার স্পষ্টত গোচরে আনা যেত যে এদেশের ভিত ও বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে, এমনটা ভাষাকেন্দ্রী জাতিরাষ্ট্র গড়ন ও বিকাশের দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় বিরল ― সহুজে এই সত্যোপলব্ধিটাও সোচ্চার আকার পেত, অনিবার্য ফল হিসেবে এসেছিল সেই গরিমার মুহূর্ত যখন আমরা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলাম এবং এর পেছনেও ক্রিয়াশীল ছিল অধিপতিসুলভ দুঃশীল পাকিস্তানীদের বহুবিধ পীড়ন যার মধ্যে ভাষার পীড়ন ছিল প্রধান। কথাগুলো বললে কি মিথ্যে শোনাত, অপ্রাসঙ্গিক গণ্য হতো? পরিহাস এখানেই যে এই সেই বিদ্বৎসমাজ বুদ্ধিবৃত্তিজীবিকাগোষ্ঠী যারা বছরচক্করে ফিরে ফিরে একুশের মহান দিবস ভাবগম্ভীরতায় পালন করেন এবং ‘বাংলা ভাষার আমরণ প্রয়োজনীয়তা আর আমাদের ঐতিহ্য সুরক্ষা’ শীর্ষক থোড়বড়িখাড়া মাতম-মরাকান্নার শোকগাথা গাহেন।

মুচকুন্দ্ দুবে একটা মারাত্মক মৌলিক জায়গায় ভুল করে ফেলেন যখন তিনি লালনের কাজগুলোকে ‘কবিতা’ এবং লালনকে ‘কবি’ হিসেবে সাব্যস্ত করেন। সভাসুন্দর বুদ্ধিবিদ্বৎসমাজের কাছে দৃশ্যত তা-ই মনে হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে এটা ডাহা ভ্রান্ত বিবেচনা। না, লালনের কাজগুলো নয় প্রথানুগত সংজ্ঞার্থের ‘কবিতা’, লালনও নন চলিতার্থের ‘কবি’ কিংবা কাব্যবিনোদকারী। তিনি তাঁর কাজগুলোকে বেঁধেছেন বটে শব্দে এবং ভাষাধারে প্রায়শ ছন্দোবদ্ধ চরণাশ্রয়ে, যে-চরণগোছার রয়েছে নিজস্ব দৈবতা; আত্যন্তিক অপার্থিব অর্থের এই নির্মোক খুলতে তারাই পারেন যারা লালনঘরের ঐতিহ্যপরম্পরায় উত্তরসাধক; সোজাসাপ্টা ‘বাউল’ বলি যাদেরকে আমরা, তারাই লালনপদের বিবেচনাপ্রসূত ভাবোদ্ঘাটনে সক্ষম; মূলধারা সাহিত্য ও সংস্কৃতির আমরা যারা ধারক-বাহক, সাঙাৎ ও সিপাহসালার, তারা লালনবোদ্ধা নামকার্ড গলায় ঝুলিয়ে সেমিনারে-সভায় ফাঁপা তড়পাতে পারি নিশ্চয়।

লালন কোনো ‘সন্ত কবি’ নন, কখনোই তিনি নিজেকে একজন ‘ফকির’ দীনহীনের বেশি কিছু মনে করেন নাই, কোনোদিন তিনি কোত্থাও ফকিরের চেয়ে উচ্চ অভিধা দাবি করেন নাই; নামের সঙ্গে গুণবাচক অভিধা হিসেবে ‘ফকির’ শব্দ দুইটা মানে দেখায় আমাদের সামনে ― এক, অতল জানতে ব্যাকুল দীনহীন জনৈক অনুসন্ধানকারী; এবং দুই, দীনভিখারীরও অধম নির্ধনিয়া। কাজেই লালন ফকিরকে ‘সন্ত’ অভিধা দান খোদ লালনাভিপ্রায়ের সঙ্গেই সংঘাতপূর্ণ তো বটে, এরচেয়েও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে, এভাবে অধুনাভাষিক মর্তবার মাল্যভূষিত করতে গিয়ে আমরা লালনকে স্রেফ একজন ঋষি মহাপুরুষ ও দ্রষ্টা বানিয়ে ফেলি যা লালনদর্শনের সঙ্গে কোনোভাবেই মিশ খায় না। জাতপাত-ধরমকরম নির্বিশেষে মানুষের ভজনা লালনঘরের নিত্যপূজা, আমরা যেন কথাটা পাশরিয়া না-যাই, আর এই কথাটাও বলি যেন পুনঃপুনঃ সর্বত্র ও সর্বাবস্থায় যে লালনচৈতন্যে দেবত্বারোপ তথা লালনের সাধনামার্গে দেবদ্বিজের বা ঐশী চিহ্নের কোনো ঠাঁই ছিল না।

লালনকে চেনানোর জন্য অধ্যাপক দুবে একটি বিশেষণ ব্যবহার করেছেন ‘নিরক্ষর’, যা আদ্যন্ত হতভম্বকর; দুর্ভাগ্যজনক হলেও বলতে হচ্ছে যে এ কিছু নয় আর, ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এবং বাংলাদেশে দায়িত্ব-পালন-করে-যাওয়া সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার সাহেবের অজ্ঞানতার উচ্চারণ। সম্ভবত ‘অনক্ষর’ হতে পারত অনেকটা কাছাকাছি ঠিকঠাক অবস্থাজ্ঞাপক শব্দ, অক্ষরের অপেক্ষা ছাড়াই যিনি স্বীয় সন্ধান সমাধা ও সূত্রাবদ্ধ করে যেতে পেরেছেন, অথবা আপন ধরনে একটি পৃথক অক্ষরধারারই কি প্রণেতা নন লালন ও অন্যান্য অনেকানেক লোকায়ত দর্শনমার্গের মহাজনেরা? আমাদের চালু বুদ্ধিবিবেচন দিয়ে এটুকু বুঝতে ঠিকই আমরা পারি যে এই মহাজনদেরকে ‘শিক্ষাগত সনদ’ বা ‘সাক্ষরতা’ খোপের ভেতর আঁটানো যায় না। লালনের প্রজ্ঞা, সাধনভজনা, তাঁর অগাধ মর্মবত্তাবহ কল্পনা বা তাঁর সচৈতন্য সংবেদন যদি হিসাবের মধ্যে না-নিয়ে কেউ অনুবাদে নামেন ‘লালনকবিতা’, আরেকটা হাবাগোবা কাব্যচয়নিকা ফাঁদা হবে কেবল, লালনের দেখা পাওয়া যাবে না সেখানে। এই সাধকের গূঢ় জ্ঞানের ঘাটে ব্যাকুল তল্লাশিরত অর্থী না-হয়ে, এঁর পদবন্ধের পরতে পরতে প্রযুক্ত জটিল ‘সান্ধ্য ভাষা’ না-শিখে, এই জীবনচর্যাগীতিকায় ব্যবহৃত রূপকাশ্রয়ী ইশারাভাষার হদিস না-জেনে কেমন করে কেউ সম্ভবের দোরগোড়ায় এঁটে ওঠানোর কথা ভাবতে পারে ‘লালনকাব্যধৃত বাণী চিরন্তনী’! ভিতরনিহিত মোদ্দা বাত তো বলতেই হবে যে, বাংলার গুহ্য জ্ঞান ও নিগূঢ় তত্ত্বের হদিস করতে চাই ঠিক যে-প্রক্রিয়ায় এটি নির্মিত হয়েছিল অবিকল ওই অনন্য অনুশীলনচর্যার ভিতর দিয়ে যাওয়া। আধুনিক কবিতাভাষান্তরকারীর পক্ষে সেটা আদৌ সম্ভব?

বাউলের জীবন সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতাজাত উপলব্ধির প্রক্রিয়ায় যাপিতব্য, এর আগাগোড়া ধারাটা যাপন করতে হয় এবং চর্চা করে যেতে হয় একে নিরবচ্ছিন্নভাবে; এবং যাপনকারীর অভিপ্রায় কি মনোবাঞ্ছা যা-ই হোক, অভিজ্ঞতাটাকে ‘বুদ্ধিবৃত্তায়িত’ করার কাজটা হবে সবচেয়ে বড় মূঢ়তা। লালনের ভাষায় যে-ধারণাটা ‘ভাবের উদয়’ হিসেবে দেখতে পাবো, সোজা বাক্যে তা হচ্ছে ‘নিগূঢ়/গুহ্যের সনে সংযোগ’, গোটা-শতেক লালনগান গাওয়া বা লালনকবিতা আবৃত্তি করার মধ্য দিয়ে এহেন উদয়ের আন্দাজ পাওয়া সাধ্যাতীত। সোজাসাপ্টা সাধকের জীবন চাই নিরবচ্ছিন্ন যাপন করে যাওয়া, নাগাল পেতে নিগূঢ়ের; সাধক হচ্ছেন সক্রিয় অনুসন্ধিৎসু ও স্বয়ং অনুসন্ধানকারী, যিনি নির্দিষ্ট একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক পাঠক্রম/সাধনক্রমের অনুসরণ করে তার সিদ্ধিতে পৌঁছান। এর রয়েছে চারটি বিভাগ, পৃথকভাবেই বিন্যাস্ত ও কঠোর শৃঙ্খলায় স্তরীভূত ― এক, ‘স্থূল দেশ’ তথা সাধারণ স্তর; দুই, ‘প্রবর্ত দেশ’ তথা রূপান্তর পর্যায়ের সাধকস্তর; তিন, ‘সাধক দেশ’ তথা স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ও শনাক্তকৃত সাধকস্তর; এবং চার, ‘সিদ্ধি দেশ’ তথা প্রকৃত ও পরম সাধকস্তর, এ হচ্ছে সেই স্তর যেখানে উন্নীত হয়ে একজন সাধক হয়ে ওঠেন সিদ্ধকাম গুরু, পরমেশ্বরত্ব অর্জন করেন চূড়ান্ত এই স্তরে উত্তীর্ণ মহাত্মা সাঁই। ঠিক এইখানে এসে যে-কথাটা চাই বলতে তা সংক্ষেপে এ-ই যে, সেমিনারে-সভায় বিদ্যানুগত গ্রন্থগর্বিত পণ্ডিতদের জীবাশ্মজড়ভরত ভড়ং সন্তর্পণে ঠেলে সরিয়ে অধ্যাপক দুবে যদি বিশাল বাংলার জাঁকজমকশূন্য সহজিয়া গাঁয়ে তারই নিজের জবানিতে এই ‘নিরক্ষর ফকিরদের’ দাওয়ায় গিয়ে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আসতেন, অনেক সদুপদেশ ও সুপরামর্শ লভিতেন, অনুবাদের লালনেও থোড়া প্রাণ হয়তো-বা পাঠক পেত ভবিষ্যতে।

একটু আগের বলা পাঠ/সাধনক্রম সম্পর্কে সম্যক বুঝসমুজ ব্যতিরেকে এবং সেগুলো অভিজ্ঞতায় না-নিয়ে একজন গায়ক বা গবেষক বা ভাষান্তরকারক আশা করবেন কেমন করে যে ফকির লালন সাঁইয়ের দেখা পাবেন তিনি? নিজেই যদি না-দেখলেন তিনি, দুনিয়াকে দেখাবেনটা কী? ‘বিশ্বশ্রোতৃমণ্ডলী’ কী শিল্প পরিবেশনের আশা তার কাছ থেকে করতে পারে? কেবল দৈবচয়িত ফর্দ মোতাবেক শতকবিতার লালনসঞ্চিতা মামুলি হিন্দি লিরিকের স্বল্পমূল্য মর্যাদাও লভিবে বলে মনে হয় না। তারপর রয়েছে একেবারে সাধারণ ভুলবোঝাবুঝির বিপদাপদ। উপরটপকা ভাষান্তরে লালনপদবন্ধের চরণগুলো অত্যন্ত অনাকর্ষণীয় অনুজ্জ্বল এমনকি নিরানন্দ ও গেঁয়ো প্রতিভাত হবে পাঠকের কাছে, যেখানে পদগুলোর ব্যুৎপত্তি বিবেচনায় রেখে আগে চয়িত ও পরে সেসবের সংবেদনসৃজনী নিষ্ঠাবাহিত অনুবাদন হলে সেই ঈপ্সিত প্রভার ঝিলিক খেলে যেত মগ্নপাঠকের চৈতন্যে।

দেখা যাচ্ছে বক্তব্যের একজায়গায় লালনবাণীর উচ্চপ্রশংসা করতে গিয়ে অধ্যাপক দুবে এর ‘সমকালীন মূল্য’ রয়েছে বলিয়া জানাচ্ছেন; সত্য হচ্ছে এ-ই যে, লালনবাণীর মূল্য চিরকালীন; সমসাময়িক সঙ্কট নিরসনের ওসিলায় মাথায় নিলাম তুলে, মুসিবত কেটে গেলে দিলাম ছুঁড়ে ফেলে ― এটা আমাদের আক্কেলপ্রসূত সুবৃহৎ বিচারাচার হতে পারে, এতে করে লালনের/লালনবাণীর ‘সমসাময়িকতা’ ঝাপসা হয়ে যায় না একটিবারের তরেও। সত্যটা খারাপ শোনালেও সত্য এ-ই যে এসব উচ্চাসীন অধ্যাপকবৃন্দ ক্ষমতাকাঠামোর চাতাল ঘেঁষে থাকেন, চলমান স্থিতাবস্থাকে এরা সারাজীবনের শান্তি জ্ঞান করেন, স্থিতাবস্থায় চিড় ধরাবার মতো কোনো ‘জরুরি ও জনগুরুত্বসম্পন্ন’ সক্রিয়তার সমস্ত ‘নাগপাশ’ এরা এড়িয়ে চলেন। ক্ষমতাসীন স্থিতাবস্থার অনুমোদন ব্যতিরেকে এরা বাউল সংগীত, বাউল কবিতা, বাউল গবেষণাকাণ্ড কোনোকিছুই সম্পাদন করতে নামেন না। স্থিতাবস্থার সবুজ সংকেত পেলে নিশ্চয় বিড়বিড় করেন তন্ত্রমন্ত্র, সমুজদারি করেন লোকসংগীতের বা বাউল পরম্পরার, পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন বাউল সাংগীতিক আসরের, করেন ‘লালনকবিতার অনুবাদ’, মূলধারা নাগরিক সমাজে বাউলদের জন্য সাংস্কৃতিক প্লট বরাদ্দকরণেও উদ্যোগী হন। সমস্তই করেন তারা তাদের কাঠামোর মাপে খাপে-খাপ বসিয়ে স্থিতাবস্থার পরিপুষ্টি ও তুষ্টিসাধনে। এককথায় লালনের বাণী হিন্দিতে বিশ্বপ্রচারের ঘটনাটি বিপদের পূর্বাভাষ দিচ্ছে এভাবে যে, এখন থেকে লালনকেও স্থূল বস্তুবাদের ভ্রমণসঙ্গী হয়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হবে অথবা লালনেরও লোপ ঘটিয়ে ছাড়বেন আমাদের ক্রমবর্ধমান বাংলা-হিন্দি স্ফীতকায় বিদ্বৎসমাজ।

অধ্যাপক দুবে তাঁর বক্তৃতায় একগাদা সাম্প্রতিক উদ্ভূত সমস্যা-ফ্যাসাদের উপর্যুপরি উল্লেখ ঘটিয়ে সেগুলো মোকাবেলায় লালনের পদাবলি নিযুক্ত করতে চেয়েছেন; অধ্যাপক মহোদয়ের উদ্বেগের তালিকায় আছে দলাদলিকোন্দল, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিলিপ্ততা আর মৌলবাদ প্রভৃতি। নিঃসন্দেহে এগুলো মূর্তিমান সমস্যা আকারে হাজির আমাদের সমকালে, এ-সমস্ত দৈত্যদানোর সহস্রানন আমরা টের পাই হাড়েহাড়ে, এসব মুশকিল-আসান করতে গিয়ে কি রোগনির্ণয় কি ব্যবস্থাপত্র প্রদানে সরলীকরণের ভুল করা যাবে না কোনোভাবেই। সাঁই লালন ফকিরের ‘জগৎমুক্তি’ ঠিক এইখানেই নিদান দিচ্ছে সকল প্রকার নিপীড়ন থেকে মুক্তির, এর মধ্যে বিমানবিকীকরণের ফ্যাঁকড়া ছাড়াও রয়েছে সামাজিক-রাজনৈতিক-আর্থিক শ্রেণিবিকারের বৈষম্য ও সর্বপ্রকার শোষণ থেকে মুক্তির বারতা। আমাদের তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’ বহুদেবতার ভাঁগাড়, সাঁই নিরঞ্জনের বারামখানা নয়, কখন কোন দেবতার ভোগে সে তথা সাধের গণতন্ত্র লালনপদাবলি নিয়োগ দেবে এবং পরক্ষণে ফের আরেক দেবীর রোষ হ্রাসকরণে বাউলফকিরি রোধের রব তুলবে এটা আগাম অনুমানের কুদরত নাই। নিয়মতান্ত্রিকভাবেই আমরা নিজেদের জন্য পীড়নব্যবস্থা জারি করে রেখেছি এবং পীড়িত হয়ে চলেছি বহুধর্ম ও বহুধাবিশ্বাসে বিভক্ত রয়ে। এই ব্যামো সংক্রামক, এটা বাড়তেই থাকে, এবং একসময় এটা বংশগতিসূত্রের অংশ হয়ে যায়; তা-ই হচ্ছে, এখন, এই পৃথিবীতে।

এক সভানন্দিত বক্তাকে বলতে শোনা গেল ‘লালন ছিলেন উভয়ত আধ্যাত্মিক ও বিদ্রোহী ব্যক্তি’, বটে, কিন্তু সত্য তো বলতেই হবে যে, এই ২০১৬ সনের বাংলাদেশে, এবং বড় অর্থে এই বিশ্বভূমণ্ডলে, একদম আনকোরা ও অতিকায় দানোটির নাম কর্পোরেটোক্রেসি, চৌর্যোন্মাদনা বা ক্লেপ্টোক্রেসি সহ সমস্ত গণধ্বংসী বিকৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করে এই বিদ্বৎসমাজচালিত দানো। সমীকরণের শেষে এই দৈত্যদানো সম্মিলিতভাবে সুকৌশলে গণমানুষকে লালনের বাণীনিঃসৃত গূঢ়ার্থ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। হ্যাঁ, লালন বিদ্রোহী ছিলেন; তবে একালে যদি জন্ম হতো ফকির লালনের, তিনি তাঁর সাধনসঙ্গী-শিষ্য-ভক্তদের নিয়ে ছেঁউড়িয়ায় নয়, জেলখানায় যেতেন সাধনারই অংশ হিসেবে। এবং তখন এই সভাসীন স্বতঃপ্রণোদিত সাঁইনিষ্ঠ ‘বিদ্যায়তনপণ্ডিত ও বুদ্ধিবৃত্তিজীবী’ সবাইকে, এমনকি অধ্যাপক দুবেকেও, একালের লালনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দেখা যেত; দাবি উঠত নবোদিত লালনকে আমৃত্যু কয়েদ করে গরাদের চাবি চিরতরে ফেলে দিতে।

এদিকে প্রথানত ধর্মগুলোর ভিতরে লালনের শুভানুধ্যায়ী নিতান্ত অল্প, নেই বললেই চলে; কেননা তিনি না ছিলেন সুফি না বৈষ্ণব। মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ প্রভৃতি ধর্মাবলম্বীরা তাঁকে হজম করতে পারে না তাঁর উত্থাপিত কথান্তর্গত মর্মবস্তুর কারণেই। কিন্তু মোল্লা-পুরোতগোষ্ঠী মিলে লালনের ভক্তিমার্গটিকে সমস্যাকীর্ণ ও অনর্থ বাহাসের ব্যাপার বানিয়ে তোলার অন্তহীন ষড়যন্ত্রে সিদ্ধি লাভ করেই চলেছে। এই পরিস্থিতি বিগত দুইশ’ বছরে একটুও বদলায়নি এবং বিশ্বাস করার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই যে এত ‘লালনপ্রীতি’ সত্ত্বেও বর্তমানের স্থিতাবস্থাসমর্থক পণ্ডিত-সভাপসন্দ সম্প্রদায় লালনবাণী মুক্ত ভুবনতলে ওড়ানোর ঝুঁকি নিতে রাজি হবেন।

তাঁর ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও ফকির লালন শাহ গোটা বিশ্বের সম্পদ। মোটেও অতিকথন নয় যে তাঁর পদাবলিনিঃসৃত সত্যের বিভা ‘ভাষান্তর-অসাধ্য’। এমনকি তাঁর কাজের নিষ্ঠানুরক্ত সম্পাদনাও প্রকাণ্ড সব সমস্যা তৈরি করে পাঠকৃতি উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে। এই সমস্যার হাজিরানা আমরা দেখি গোড়া থেকেই ঘটে চলেছে, যখন বিশ্ববিশ্রুত পুরস্কৃত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বীয় ‘সম্পাদনায়’ লালনের পদবিভা ‘বিশ্বশ্রোতৃমণ্ডলী’ সমীপে পেশ করেন তখন থেকেই বিকট সব ক্ষতি সাধিত হয়ে গিয়েছে যা আজও অপূরণীয়। তখনকার কলকাতাবাসী নব্য অভিজাত ধনিকদের পাঠবিলাসের সুবিধাকল্পে শ্রী ঠাকুর প্রচুর জায়গায় লালনপদের অঙ্গহানি ঘটিয়েছেন, ‘অপ্রাসঙ্গিক’ বিবেচনায় মূল পাঠকৃতি কেটেছেঁটে একাকার করেছেন, ‘বানানভ্রান্তি ও ব্যাকরণপ্রমাদ’ প্রভৃতি দোহাই পেড়ে ‘সংস্কার’ করেছেন মূলের, এইভাবে লালনের মূল বাণী হারিয়েছে ব্যাপক হারে। এবং, আফসোস, গেঁয়ো নদীয়ার কথ্য কতশত বুলি-বাগবিধি এইসব সগর্ব সম্পাদকদের কাঁচির কোপে বিলীন হয়ে গিয়েছে লালনপদাবলি এবং মানবেতিহাস থেকে! কাজেই হিন্দিতে লালনপদাবলির ভাষান্তর নিয়ে আমাদের উদ্বেগ মনে হয় না অবান্তর কিংবা অতিশয়োক্তিজাত উদ্বেগ কোনো।

মুচকুন্দ্ দুবে মহোদয়ের লালনপদাবলির হিন্দিকরণ প্রকল্পের সর্বাঙ্গীন কুশল ও শুভমুক্তি আমরা কামনা করি।

[ইংরেজি থেকে এই রচনাটা বাংলায় আনা হয়েছে লেখকের ফেসবুকনোট থেকে। অনুবাদ করেছেন জাহেদ আহমদ। ২০১৬ সনের মার্চে অনুষ্ঠিত প্রোক্ত  সেমিনারের পত্রিকাবাহিত প্রতিবেদন পড়ে রেস্পোন্স হিশেবে ম্যাক তথা মাকসুদুল হক নিজের ফেসবুকপাতায় এই নিবন্ধটা আপ্লোড করেন ঘটনার অব্যবহিত পরের দিনই। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াই শুধু নয়, এই নিবন্ধে লেখকের গভীরাভিসারী  দীপ্ত সংগীতভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়, এইখানে লালন ও লোকায়তিক দর্শনের ওপর লেখকের সন্দীপিত অনুসন্ধানের পরিচয় পাওয়া যায়। ― গানপার]

… …

 

COMMENTS

error: