ভরা চান্নির উপত্যকায় কাব্য ও কথকতা || সরোজ মোস্তফা

ভরা চান্নির উপত্যকায় কাব্য ও কথকতা || সরোজ মোস্তফা

 

কবিতায় মুহম্মদ ইমদাদ একেবারে সদ্যতন — আগাগোড়া ঝকঝকে। ‘পাখির জুতা নাই’ পড়তে পড়তে মনে হয় কবি নিজেই লিখেছেন নিজের সন্ন্যাস। খুব স্মিত, স্বল্পবাকে কবি লিখে যাচ্ছেন আমাদেরই গল্প, এখনকার গল্প এবং গল্পের শেষটাও অবিকল একই জীবনের অন্তরা। যেন এক জীবনের ধুলো, কবিতার খাতায় ছড়িয়ে রেখেছেন কবি। কবিতা লিখতে লিখতে কবি যেন সময়ের, সহচরের, প্রতিবেশীর কিংবা দূরবর্তী ওই গোধূলির বন্ধুত্ব চাইছেন। আনন্দের আড়ালে এ যেন একটা স্পন্দমান জীবনের কান্না।

*
এ যেন স্পষ্ট প্রত্যক্ষ অথচ জীবন স্বল্পরেখ। আমি বুঝাতে চাইছি যে, মুহম্মদ ইমদাদ একজন প্রাগ্রসর কবি, টেকনিকে নিখুঁত-সহজ-স্বতঃস্ফূর্ত, বিষয় ভাবনায় নৈমিত্তিক-প্রাত্যহিক-ঘটনাপ্রবাহেরই উচ্চারক। কখনো মনে হয় তিনি কবি কখনো মনে হয় তিনি কথাকার। কাব্যের নিবিড় থেকে উঁকি মারে শাশ্বত বোধ ও স্মার্টনেস। কবিতা থেকে বিষয় ও বর্ণনাকে আলাদা করা যায় না। এমতো বর্ণনার লিপিতে, অত্যাজ্য স্মৃতিতে, নিজেকে গোপন রাখা যায় না। তাই, মুহম্মদ ইমদাদকে সর্বাংশে সাধক মনে হয়। নির্ভার আর সারলিক জ্ঞান-প্রজ্ঞা-উপলব্ধির জহরতগুলোকেই তিনি কবিতায় রেখেছেন। সাধকের কবিতা প্রত্যেকের অন্তরকে স্পর্শ করে।

*
অন্তর স্পর্শ করে এবং ডোবায়, ভাসায়, এই বইয়ের কবিতা পাঠক মাত্রেরই ভুবনকে নতুন করে যায়। আগে যা-কিছু দেখিনি, ভাবিনি, তা-ও শিউলিতলার মতো চকচক করে। জানার চেয়ে অচিনে স্তব্ধ করে রাখে মুহম্মদ ইমদাদের কবিতা। সেই অচিন বৃক্ষের জীবনবৃত্তান্ত ‘পাখির জুতা নাই’। শৈল্পিক, একেবারে টানটান এই কাব্যের ভুবনে আমি ডুব মেরে থাকি। এখানে আম্মাকে, আব্বাকে, আমার শৈশবকে, ঘরের ছায়াকে, চিনতে পারি নিজেকে — নিজেকে চেনার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো কবিতা হতে পারে বলে আমি মনে করি না।

*
মুহম্মদ ইমদাদের কবিতা পড়লে বোঝা যায় জীবনের শান্তি, আনন্দ, ছলাৎ ছলাৎ দুঃখের পরিখা থেকে এইমাত্র বেরিয়ে এসেছেন কাব্যবৃত্তে। জীবনানুভবই কবিকে শাণিত করেছে। তাঁর দেখা আর দেখানোর চোখ কিংবা কবিত্বের সর্বাংশে আছে জীবনের চারপাশ, স্বগত সন্ধ্যার মরিয়ম। জীবনের সবকিছু ধূসরিত হলেও মাঝখানে থেকে যায় পরিচিত নিসর্গ আর স্মৃতির শৈশব। কবির কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয় প্রকৃতির কাছে নিজের দুঃখ সমর্পণ করছেন । তিনি আর প্রকৃতি অভিন্ন।

*
তাহলে মুহম্মদ ইমদাদের কবিতা সম্পর্কে সারকথা কী দাঁড়াল? মানুষকে এড়িয়ে নয় মানুষের মধ্যেই তিনি কবিতা খুঁজেছেন। কবিতা ধরেছেন। তাই তার কবিতার স্বচ্ছ ও স্পষ্ট জানা-অজানার বেষ্টনে এ যেন আত্মজনের জীবনপরিধি।

*
এতক্ষণে তবে বলি, কবি আমাদের গড়পরতা জীবনটাকেই লিখেছেন। তাঁর প্রত্যেকটা উচ্চারণ একটা স্পষ্ট তাৎপর্যের দিকে এগিয়েছে। কবিভাষা আয়ত্ত করার চেয়ে মানবমনের ভার ও দরদকে ঢেলে এক ব্যঞ্জনময় জীবনকে যুক্ত করেছেন। পাঠক সহজেই এখানে নিজেদের খুঁজে পাবেন। প্রাণিজগতের প্রতীকী উপস্থিতিতে তিনি আমাদের প্রকৃতিময়তায় মিশিয়ে দিয়েছেন।

*
কবিতায় কী-ইবা দিতে পারেন একজন কবি? ইমদাদ তাঁর একেকটি কবিতায় কী নিরাভরণ নান্দনিকতায় সত্যভাষ করেছেন, নজির পেশ করতে গিয়ে এখানে দৈবচয়িত গোটা-তিনেক কবিতা রাখব শুধু, ‘পাখির জুতা নাই’ কাব্যগ্রন্থ থেকে, অধিক নয় আজ আর, তিনটা মাত্র কবিতা : ‘আব্বার কবিতা’, কাব্যগ্রন্থের নামকবিতা ‘পাখির জুতা নাই’ ও ‘আপনার কবিতা’; আর, আমি বিশ্বাস করি, কবির সঙ্গে করমর্দন করতে আগ্রহী হলে পাঠক গোটা কাব্যগ্রন্থ খুঁজে নেবেন। ‘পাখির জুতা নাই’ কাব্যগ্রন্থ থেকে এই নিবন্ধে প্রতিশ্রুত কবিতাগুলি নিচে পড়ে নেব ঝটপট একটার পরে একটা :

 

আব্বার কবিতা
আমার বাসায় এলে আব্বা বড়োজোর ১টা কুমড়া
৪ হালি লম্বি কলা, ১ কেজি আপেল
২ হালি দেশি মুরগির ডিম
২টা ডালিম, ১টা জাম্বুরা বা
মনু নদীর ১ দেড় কেজি বাঁশপাতা মাছ
১টা পাউরুটি ইত্যাদি নিয়ে আসেন!
এগুলো আমাদের তেমন কাজে আসে না।
আমরা তবু কাজে লাগাই।
মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের কাছে
আব্বার দাম আসলে কত!
ঈদের সময় তাঁর জন্য কেনা পাঞ্জাবির দাম
তাঁর নিজের দামের সমান হবে —
আমরা অবচেতনে ভাবি।
কারণ, আব্বা আমাদের জন্য তার পেনশন
তাঁর মন্ত্রিত্বের হিস্ট্রি, শহরে বাড়ি
ইত্যাদির ব্যবস্থা করেননি
নাতিদের জন্মদিনে সোনার চেইন
বা এক লাখ টাকার চেকও গিফট করেন না।
কিন্তু আজ দুপুরে হঠাৎ মনে হলো
আব্বা যে তাঁর গভীর রাতের সিজদায়
আল্লাহর দরবারে আমার জন্য কমপক্ষে
৭ লিটার চোখের পানি ফেললেন,
তার দামে তো কম করে হলেও ২০টা পৃথিবী কেনা সম্ভব!

.
পাখির জুতা নাই
পাখির জুতা নাই।
পাখি তাই খুশি।
খালি পায়ে ওড়ে।
মাঝে মাঝে হাঁটে।
পাখি গরিব। ঘর নাই।
ন্যাশনালিটি, পাসপোর্ট নাই
পাখি খুশি। বন্দুক নাই। বোকা।
বুদ্ধি নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে নাই।
চাকরি নাই।
পাখি যারপরনাই খুশি। জামা নাই।
জামার পকেট নাই। পকেটে পয়সা নাই। ছুরি নাই।
গান গায়। ওড়ে। হাঁটে।
মাঝে মাঝে মানুষের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে বসে হাসে।
দেখে তারা পোশাক/খাদ্য/জুতা প্রকৌশল
দেখে তারা রিকশা/রাষ্ট্র ইত্যাদি বিজ্ঞান
দেখে তারা প্রতিষ্ঠিত হতেছে।
পাখি খুশি। ডানায় জাহাজ। পোশাক। বিমান। গাড়ি।
মানুষের দুঃখে সে কাঁদে একলা একলা রাতে।
সকালে তাই ঘুম ভাঙাইতে আসে।

.
আপনার জীবন
স্ত্রী সকালে খুন করে বিকালে বাঁচিয়ে তুলবে
যাতে ছেলের হাতে খুন হতে পারেন রাতে
রাতে ছেলে খুন করে সকালে বাঁচিয়ে তুলবে
যাতে স্ত্রী খুন করতে পারে
চাচাতো বোন খুন করে বাঁচিয়ে তুলবে
যাতে বন্ধু খুন করতে পারে

… … …
এইভাবে খুন হতে হতে বেঁচে উঠতে উঠতে
একদিন খুন হওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলবেন
কেউ আর খুন করতে আসবে না আপনাকে
বরং তারা আপনাকে নিয়ে গোরস্তানের দিকে যাবে
আর যারা খুন করতে পারেনি তারা আফসোস করবে
কাঁদবে
আপনি কাঁদবেন না, হাসবেন
কারণ আপনি জানেন আপনি একজন পাপী
আপনার জন্য অপেক্ষা করছে একটা অন্ধ দোজখ
কিন্তু আপনি হেসেই যাবেন কারণ
আপনি জানেন জীবনের চেয়ে দোজখ
সর্ব অর্থেই কম ভয়ংকর

*
কবিতাবইয়ের নাম ‘পাখির জুতা নাই’, লিখেছেন মুহম্মদ ইমদাদ, প্রচ্ছদ করেছেন রুবাইয়াত ইসলাম, প্রকাশ করেছে ‘দরগারোড’, প্রকাশকাল অক্টোবর ২০২৩, পরিবেশক ‘চৈতন্য প্রকাশন’, অনলাইনে খরিদ করা যাবে রকমারি থেকে, এর বাইরে দেশের বইদোকানগুলায় খোঁজ নিলে নিশ্চয় তারা তা কালেক্ট করে দিতে পারবেন।


সরোজ মোস্তফা রচনারাশি

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you