থিয়েট্রিক্যাল্ রক্ বিষয়ে এর আগে এমনকিছু পড়ি নাই স্বীকার করব। ঘটা করে এমনকিছু নমুনাগানও শুনি নাই, নিশ্চয় শুনব কখনো। তবে এইখানে স্বীকারোক্তি এইটুকুই যে এই জিনিশ সম্পর্কে আমার কোনো পড়াপড়ি ছিল না। গানের ঘরানা-বাহিরানা সম্পর্কে একদমই বিদ্যাশিক্ষা নাই আমার। আমি লিখি শুনে, শুনিয়া সুন্নি, কিংবা এককালের নানান শোনাশুনির ফিরিস্তি নিজের মনগড়া একটা কায়দায় চালায়া যাই, কিন্তু অত্যন্ত অনুচিত কাজ এইটা আমি জানি, জাতিবিকাশের জন্য হুমকিস্বরূপ। বাংলায় লেখক মানেই সমাজসংস্কারক, জাতিবিকাশক, এই চাপটা যে-জন বঙ্গেতে জন্ম তদুপরি লেখক তারে নিতে হয়।
কিন্তু, যা-হোক, তবু আমি লিখি। কিচ্ছু না-জেনে না-পড়ে এমনই ডেয়ারিং আমি যে এমনকি মিউজিক নিয়াও লিখি! ইভেন থিয়েট্রিক্যাল্ রক্ নিয়াও! ফলে এমন অনেক স্যুয়িপিং রিমার্কস নিশ্চয় আমার কিবোর্ড দিয়া বাইরায় যা কি-না গোটা লেখার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়া যায় সাধারণত; হয়, নিশ্চয় এমন হয় লেখায়-লেখান্তরে। এমন হয় কেন? প্রথমত অজ্ঞতা, যা আমার লেখার পরানভোমরা, দ্বিতীয়ত জোশ, মানে একটা মাইটি-ইঙ্ক জোশ ও জজবা এসে যায় দেখবেন কখনো কখনো লিখতে যেয়ে রিস্যার্চারতুল্য সচেতনতা না-থাকলে; এই দুই চিজ — অজ্ঞতা আর জোশ-জজবাতি — নিশ্চয় একটা লেখার বারোটা বাজাইতে একশ।
থিয়েট্রিক্যাল্ রক্ বিষয়ক অজ্ঞতা প্রসঙ্গেই জিমি হেন্ড্রিক্স ইয়াদ করব। ঘটনাটা হলো, আমি জিমি হেন্ড্রিক্সের সাউন্ডটাকে থিয়েট্রিক্যাল্ ভাবতাম এদ্দিন, শুধুই থিয়েট্রিক্যাল্ নয় তা-বলে, হেন্ড্রিক্সের গায়ন নিয়া আগড়মবাগড়ম বহুকিছু ভাবতাম মনে মনে, কেন-যে কে জানে। এমনকিছু মহান গানশ্রোতা আমি তো নই, ইংরেজি গানের কড়ে-গোনা খানচারেক শুনেছি জিন্দেগিতে। এবং তা-ও বড়জোর ‘বি-জিস্’ ইত্যাদি। মিক জ্যাগারও কখনো কখনো, রোলিং স্টোন্স, ধরেন য়্যু–টুও। বুঝসমুজ ওইভাবেই যতটুকু। কোহেন-লেনন-ডিলান শুনে কেউ তো বলবে না যে ইংরেজি মিউজিক অ্যাপ্রিসিয়েশনে তার কান যথেষ্ট সড়গড়। তবে এইসব গানপ্যাশন কখনোই কিন্তু পড়াশোনাজাত ছিল না, মানে এককালে রাজাউজির মারার বয়সে এইসব গান শুনতাম আর মুখে মুখে ক্রিটিক শুনে নিজেও যোগ করতাম মনগড়া বানোয়াট যা-ই মনে এসে যেত। তো, এদের, বিশেষত হেন্ড্রিক্সের শব্দাবহের সঙ্গে ব্যান্ডগুলার মধ্যে — দেশের ব্যান্ডগুলার — কার কার কী মিল কী বেমিল, খুবই অল্পকয়েক, গানের সাউন্ডসাদৃশ্য লোকেইট করে উঠতে পারতাম হয়তো।
সর্বজ্ঞ হতেই হবে লিখতে গেলে? এর বাংলাদেশি রিপ্লাই, ইয়েস, আলবৎ! অথচ রক্ জিনিশটা এমনই একটা আম্ব্রেলা হয়েছে যে এর ছায়াতলে হাজার হরিব্বল, সবই নিকটসৌত্রিক, প্রশাখার প্রশাখা, উপবিভাগের উপবিভাগ ইত্যাদি মিলেমিশে এখন অনেকটা রাইজোমিক উদ্ভিদের দশা। ব্যাপারগুলো সুন্দর। যেমনটা আমরা দেখি যে হিন্দুস্তানি ধ্রুপদ বিষয়ে লেখাপত্রে খালি ঘরানাগত ভুলভাল নিয়া কাজিয়াফ্যাসাদ, অথবা রাগের প্রয়োগ বিষয়ে একেকজনের অভিমত এমনকি অনেকসময় একেবারেই নিকটজনের উল্টোস্রোতে। এইসব পাঠক হিশেবে আমাদের কাজেও লাগে, আবার লাগেও না, ফাইন্যালি একজন অমিয়নাথ একজন কুমারপ্রসাদ একজন নীলাক্ষ গুপ্তের লেখা থেকে আমরা অন্য লাইট নিয়ে বেরিয়ে আসতে চাই, এবং বহু বড়বড় মতানৈক্য সত্ত্বেও ওদের লেখা বারবার পড়ি গানকে তারা ওইসব নোমেনক্লেচারের ক্যাচাল থেকে বের করে এনে উদযাপনযোগ্য করে তোলেন বলেই। নিজের মতো ভুল বকাবকি, এমনকি ঝোঁকের বশে মৌহূর্তিক ভুলভাল করার স্বাধীনতাটা না-থাকলে বেফায়দা-বেমজা রেফ্রেন্স রচনা বানাইতেন তারা, ক্ল্যারিক্যাল্ আর্টিক্যল্ পয়দানো হতো শুধু।
সংগীতের ঘরানা বা জেনর বা জন্রা বা জঁর্ যা-ই বলুন যে-চেহারায় এইটা নিয়া কাজিয়াফ্যাসাদ করা আসলে আমার মতো শ্রোতা-অনুভূতিব্যঞ্জক বেল্-লেৎর্ টাইপের লেখা প্রিপেয়ারকারী লেখকের লেখার লক্ষ্য বা পটভূমিও না। গানের লেখা নানাবিধ প্রকারাকার হতে পারে, হয়, যেইটা বাংলায়/বাংলাদেশে কেবল জেনারেল্ নলেজের এখতিয়ারে থেকে গেছে এখনও। শুধু নামাবলি, নামতর্ক, ইত্যাদি। কিন্তু ওইসবেরও দরকার আছে। এবং লেখক তথা পাঠকের আছে রকমফের, কমজোর-বেশজোর, বৈচিত্র্যের বাতুলতাও অধীশ্বরের অনড়-অটলতার চেয়ে শ্রেয় মনে হয়। এবং বাতুলেরও বৈচিত্র্য থাকা চাই, ঈশ্বরী/উইকি ইত্যাদির একঘেয়েমির চেয়ে।
তবে এইটা আমি নিশ্চয় মানি যে, জেন্যর নিয়া আলাপ উঠাইলে সেইটা ঠিকঠাক ডিটেক্ট করা বাঞ্ছনীয়। নয়তো-বা ফার্স হয় এবং ধরা-খাওয়াও অবধারিত বোধহয়। ব্যাপারটা হচ্ছে গানজ্ঞানী যারা, তারা যদি বাংলা রক্/পপ্ গান নিয়া আরেকটু তজিমের সাথ্ লিখতেন, তো গানমূর্খ আমার এহেন সংজ্ঞাহারা ভাবদশা জনসমক্ষে এক্সপোজড হবার আশঙ্কা থাকত না। তাচ্ছিল্যতুচ্ছতা সয়েও কথাবার্তা যার যা-কিছু মনে হয়, বেয়াড়া ধাঁচের ভুল হোক বা মাইটি অ্যাপ্রোপ্রিয়েইট, সে যেন তা-কিছু টুকে রেখে যায়, একসময় যেয়ে বাংলা ব্যান্ড/রক্/পপ্-বিচারবিবেচনায় বেশ কাজে দেবে সেসবও। ভুল করার সুযোগটা থাকতে হবে অবারিত। নইলে এইসব লিঙ্কবাহিত নলেজ সার্কুলেশনের দুয়ার রুদ্ধ হয়ে যায়।
এর বাইরে যা থাকে তা হচ্ছে দলিল-দস্তাবেজ ও বইপত্র অধ্যয়নপূর্বক লেখালেখি তথা ‘জ্ঞানসঞ্চারণ’, উইকিপৃষ্ঠার ওভার্ভিয়্যু পড়ে লেখালেখি ও দেখাদেখি ও নিঃশ্বাসধারণ, সবই তো হচ্ছে দেদার। এসবের বাইরের ভুলভালগুলোও হোক। অন্তত আপনার-আমার ফেইব্রিট শিল্পী কিংবা গানদলগুলো উইকিপৃষ্ঠার একরত্তি ক্রিটিক-অরিয়েন্টেশনের বাইরে সেলিব্রেইটেড হোক। থিয়েট্রিক্যাল্ রকও তো জন্ম থেকেই লিঙ্কবর্ণিত অধ্যায়ে একটানে এসে পৌঁছায়েছে এমনটা না মনে হয়। যা-ই-হোক, হোক। ভুল হোক, শুদ্ধ হোক, ভুলশুদ্ধ মিশ্রমাধ্যম হোক। তবু হোক। শুধু তফাৎ যাক পণ্ডিতম্মন্য বইলব্ধ-লিঙ্কলব্ধ জ্ঞানচর্চা। আমি নিজে যেন উপস্থিত থাকি প্রত্যেকটা শুদ্ধাচার ভালো, খুবই জরুরি জিনিশ, শিক্ষকতাও ভালো, খুবই জরুরি জিনিশ তা-ও, তবে কি-না শুদ্ধের অস্তিত্ব থাকলে এর বাইন্যারি-কাউন্টারপার্টটাও জরুর অস্তিত্বশীল। রিডার্স রেস্পোন্স থিয়োরি তো তা-ই বলে শুনেছি।
ভুল ইজ নেসেস্যারি। রেস্পোন্সিভ একটা পাঠবস্তু ভুলের সাঁকো পার করায়া পাঠকেরে তার বাগানে ঢোকায়। যে-লেখায় ডিস্যাগ্রি করবার কিছু নাই সেই লেখায় মারহাবা-মাশাল্লা করা ছাড়া আর কীভাবে অ্যাটেন্টিভ হওয়া যায়? আর মারহাবা-মাশাল্লায় লেখার চাকরি থাকলেও চরিত্র থাকবে না।
লেখা : জাহেদ আহমদ
ভূমিকার পরিবর্তে একটা পাদটীকার ন্যায় ভাষ্য যুক্ত করিয়া রাখতে চাইছি নিবন্ধপ্রবাহ ‘মুখস্থ মুজরো’ প্রত্যেকটা পার্টের সঙ্গে। বেঁটেখাটো কৈফিয়ত গোছের একটা ভাষ্য। পুনরাবৃত্তাকারে এইটা অ্যাটাচ করা থাকবে এর এপিসোড প্রত্যেকটার লগে। কেবল ইয়াদ রাখতে হবে এই নিবন্ধপ্রবাহ সংগীতবিষয়ক কোনো কড়া আলোচনা নয়। আদৌ সংগীতগদ্য নয় এই রচনা। নামের মধ্যে একটা নাচাগানাবাজানার আভাস থাকলেও মোদ্দায় এইটা গালগপ্পো। অনুষঙ্গ-উপানুষঙ্গ-অনুপান হিশেবে এইখানে শ্রবণাভিজ্ঞতাগুলা আসবে এবং চলেও যাবে। সে-অর্থে এইখানে রেফ্রেন্সের খোঁজপাত্তা খামাখা। আদতে এইখানে রেফ্রেন্সেস নাই বিধায় রেফ্রেন্স চেকের পরিশ্রম করতে যাওয়াটাই বৃথা। ধারাবাহিক মুক্তগদ্য ধাঁচের রচনা, ব্যক্তিগতিকতায় ভরা বা আবোলতাবোল, আবার অতটা ধারাফারা মান্য করবার বাঁধিধরা নাই কিছু। অনিয়মিত, সবিরত, কখনও সময়ে-সুযোগে একনাগাড় নিয়মিতও হতে পারে। একেকটা পার্টে একটামাত্র অনুচ্ছেদ, অথবা চাইর-পাঁচটা মাত্র, পরিকল্পনা আপাতত অতটুকুই। মিউজিক-লতানো গল্পগুলা, গান গাইবার বা গানের সমুজদারিতার গল্পও নয়, গানশোনার আবছা আলাপচারি। স্মৃতিরই রোমন্থন, মুখস্থ মুজরো, সুরাশ্রিত অটোবায়োগ্র্যাফিকতা। — জা.আ.
মুখস্থ মুজরো ১
মুখস্থ মুজরো ২
মুখস্থ মুজরো ৩
মুখস্থ মুজরো ৪
মুখস্থ মুজরো ৫
মুখস্থ মুজরো ৬
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS