নেত্রকোণার নামকাহন (তৃতীয় পর্ব) || মঈনউল ইসলাম

নেত্রকোণার নামকাহন (তৃতীয় পর্ব) || মঈনউল ইসলাম

পূর্ব-ময়মনসিংহকে ‘পাণ্ডববর্জিত’ স্থান বলা হয়। এই ‘পাণ্ডববর্জিত’ নামকরণ নেত্রকোণা বা পূর্ব-ময়মনসিংহের জন্য অপমানের নাকি গৌরবের? অধ্যাপক যতীন সরকারের ভাষ্য মতে, কবিগানের লড়াইয়ে একবার বিক্রমপুরের এক কবিয়াল পূর্ব-ময়মনসিংহকে ‘পাণ্ডববর্জিত’ স্থান বলে অবজ্ঞা করেন। উত্তরে পূর্ব-ময়মনসিংহের কবিয়াল রামু মালী চমৎকার এক গল্পের মাধ্যমে এর মোক্ষম জবাব দেন। তিনি বলেন, বারো বছরের বনবাস দণ্ডে থাকা অবস্থায় ঘুরতে ঘুরতে এক পর্যায়ে পাণ্ডবেরা ময়মনসিংহ শহরে আসেন। এখানে তারা ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে শম্ভুগঞ্জের ঘাটে অর্থাৎ পূর্ব-ময়মনসিংহে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পাঁচজন পুরুষের সঙ্গে একজন নারীকে দেখে খেয়ানৌকার মাঝির সন্দেহ হয়। তাই মাঝি জানতে চাইলেন, ‘তোমরা দেখছি পাঁচজন পুরুষ, অথচ স্ত্রীলোক মাত্র একজন। ইনি তোমাদের কে হন?’ পাণ্ডবেরা উত্তর দিলেন, ‘উনি দ্রৌপদী, আমাদের স্ত্রী।’ ‘আমাদের স্ত্রী’ শুনে মাঝি কিছু বুঝতে না পেরে বিস্ময়ে হা হয়ে গেলেন। তারপর পাণ্ডবদের ব্যাখ্যা শুনে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। তিনি পাণ্ডবদের পূর্বপাড়ে নিয়ে যেতে অস্বীকার করলেন। তিনি আরও বললেন, ‘আমাদের একজন পুরুষ পাঁচটি বউ রাখতে পারে, কিন্তু পাঁচজন পুরুষের একজন বউ — এমন সৃষ্টিছাড়া কথা আমরা কখনও শুনিনি। পাঁচ ভাইয়ের এক বউ থাকে যাদের, এমন অসভ্য অনাচারী লোকদের কিছুতেই আমার এলাকায় যেতে দেবো না। তোমরা বরং বিক্রমপুরে চলে যাও, পূর্ব-ময়মনসিংহে যাওয়ার চেষ্টা করো না।’ এভাবে পূর্ব-ময়মনসিংহ পাণ্ডববর্জিত থাকতে পারল বলেই এ অঞ্চলের লোক আজও গর্ববোধ করে।

পাণ্ডববর্জিত নেত্রকোণার হাওড়বেষ্টিত একটি উপজেলার নাম খালিয়াজুরী। জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, গারো, হাজং ও কোচ নামীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শাসকদের হাত থেকে খাসিয়া সম্প্রদায় ‘জোর’ করে এই অঞ্চলের দখল নিয়েছিল বলে এর নাম হয় ‘খাসিয়াজুরী’। কালক্রমে এই খাসিয়াজুরী থেকেই ‘খালিয়াজুরী’ নামের উদ্ভব হলেও বর্তমানে সেখানে কোনো ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের বসবাস নেই।কোনো কোনো লেখক এই তত্ত্বের সপক্ষে এবং এই এলাকায় খাসিয়াদের উপিস্থিতির বিষয়টি প্রমাণের জন্য ১৭৮৭ সালে সিলেটের কালেক্টর বাহাদুরের লিখিত একটি পত্রের উল্লেখ করেন। কিন্তু উক্ত পত্রে সিলেটের উত্তর সীমান্তে খাসিয়াদের নৈরাজ্যের বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। উল্লেখ্য ‘খাসি পাহাড়’ এলাকায় খাসিয়াদের আবাসস্থলে তাঁদের উপস্থিতি স্বাভাবিক হলেও ভাটি অঞ্চলে তাদের উপস্থিতির জোরালো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় না। কেদারনাথ মজুমদারের ‘ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহের বিবরণ’ বইয়ে ‘ইকলিম মোয়াজ্জমাবাদ’ বা পূর্ব-ময়মনসিংহের বিবরণে ইতঃপূর্বে বর্ণিত সময়ের বহু পূর্বেই ‘খালিয়াজুরী পরগণা’র উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে গারো, কোচ বা হাজং সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ থাকলেও খাসিয়াদের শাসন সম্পর্কে কোথাও উল্লেখ নেই। তাই ‘খালিয়াজুরী’ নামকরণের এই মত খুব গ্রহণযোগ্য নয়। অপরদিকে, হাওড় বেষ্টিত খালিয়াজুরী উপজেলায় রয়েছে ছোটবড় অনেক খাল। এই খাল থেকে পানি চলাচলের জন্য সৃষ্ট নালাকে স্থানীয়ভাবে ‘জুরি’ বলা হয়। তাই ‘খাল’ ও ‘জুরি’ শব্দ দুটি একত্রিত হয়ে ‘খালিয়াজুরী’ নামের উৎপত্তি হওয়ার এই ব্যাখ্যা অধিকতর গ্রহণযোগ্য।

পরিব্রাজক হিউ এন সাঙ-এর বর্ণনা অনুযায়ী ময়মনসিংহের পূর্বভাগসহ পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে কামরূপ রাজ্য গঠিত ছিলো। কোনো এক সময়খালিয়াজুরীতে কামরূপ রাজ্যের রাজধানী ছিলো বলেও উল্লেখ পাওয়া যায়। কামরূপ রাজ্যের ক্ষমতার পালাবদলের এক পর্যায়ে পূর্ব-ময়মনসিংহ এলাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি, নেত্রকোণার খালিয়াজুরী, মদনপুর ও সুসঙ্গ। এই ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো কোচ, হাজং ও গারোদের দ্বারা শাসিত হতো। চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে জিতারি নামক কোনো ক্ষত্রিয় সন্যাসী এই অঞ্চলে কামরূপ শাসনের অবসান ঘটান। অপরদিকে, পাল শাসিত আসাম প্রদেশের অধীনে একটি জেলার সদর দপ্তর ছিলো নেত্রকোণা সদর উপজেলার মদনপুর; যার দায়িত্বে ছিলেন সামন্তরাজের কর্মচারী মদন মোহন কোচ। গত ১০৩৮ খ্রিষ্টাব্দে পালবংশীয় রাজা প্রথম মহীপালের মৃত্যুর পর সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার সুযোগে বাংলার বিভিন্ন সামন্ত রাজাগণের ন্যায় মদন মোহন কোচও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং নিজস্ব রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। গত ১০৫৪ খ্রিষ্টাব্দে হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দীন রুমী (রাহ.) ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আসেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থান ঘুরে মদনপুরে আসেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে অবস্থানপূর্বক ধর্ম প্রচার ও সমাজসেবা করতে মনস্থির করেন। এই ধারাবাহিকতায় ধর্মীয় দাওয়াত এবং লৌকিক-অলৌকিক নানাবিধ ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে মদন মোহন কোচের সঙ্গে তাঁর একটি চুক্তি হয়। সেই চুক্তির শর্তানুযায়ী মদন মোহন কোচ তাঁর রাজধানী মদনপুর থেকে অন্যত্র সড়িয়ে নেন (মতান্তরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন)।মদন মোহন কোচের সম্মানার্থে হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দীন রুমী (রাহ.) ঐ এলাকার নামকরণ করেন ‘মদনপুর’। এভাবেই এই অঞ্চলে কোচদের তথা ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর শাসনকালের অবসান ঘটে।

কামরূপ রাজ্যের সঙ্গে আবার রোয়াইলবাড়ির ইতিহাসও জড়িত। রোয়াইলবাড়ি নামটি শুনলেই একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং শৌর্য-বীর্যের কাহিনি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। বাংলার প্রাচীন শাসনকর্তা সুলতান হুসেন শাহ, নছরত শাহ এবং ঈশা খাঁ’র স্মৃতিধন্য এই রোয়াইলবাড়ির মাটি। ‘রোয়াইল’ একটি আরবি শব্দ। এর বাংলা অর্থ ‘ক্ষুদ্র অশ্বারোহী বাহিনী’। সুতরাং ‘রোয়াইলবাড়ি’ এর অর্থ দাঁড়ায় ‘অশ্বারোহী বাহিনীর বাড়ি’। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্ ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে কামরূপ রাজ্য দখল করেন এবং তাঁর পুত্র নছরত শাহকে কামরূপের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই প্রবল বন্যা এবং প্রতিপক্ষের আক্রমণের মুখে নছরত শাহ্‌ কামরূপ থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। কথিত আছে, নছরত শাহ্ কামরূপ থেকে পালিয়ে রোয়াইলবাড়িতে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। নছরত শাহ্‌-এর নামানুসারে এই পরগণার নাম হয় ‘নছরৎ-ও-জিয়াল’ এবং সমগ্র পরাগণা ধীরে ধীরে ‘নছরৎসাহী’ নামে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে বার ভূঁইয়াদের অন্যতম ঈশা খাঁ কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি ও নেত্রকোণার রোয়াইলবাড়ি দুর্গের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত করেন।

রোয়াইল বাড়ির পূর্ব-উত্তর দিকে সবুজ-শ্যামলে ঘেরা এক বিস্তীর্ণ সমতল ভূমির একটি গ্রাম ছিলো। এই গ্রামে বিদেশি এবং সৈন্যদের মনোরঞ্জনের জন্য বাঈজীদের ব্যবসা শুরু হয়। বাঈজীদের সংগীত ও নৃত্যে আকৃষ্ট হয়ে পড়া ফার্সি-ভাষীরা ঐ এলাকাকে ‘কান্দ-ওয়া’ নামে সম্বোধন করতো। ফার্সি ‘কান্দ-ওয়া’ শব্দের অর্থ ‘সবুজ ভূমি’। এই শব্দটি সবুজেঢাকা প্রাকৃতিক পরিবেশকে যেমন নির্দেশ করে তেমনি রূপকার্থে ‘নারী ও নেশা’র চারণভূমিকেও বোঝায়। ফার্সী ‘কান্দ-ওয়া’ শব্দের পরিবর্তিত রূপই আজকের ‘কেন্দুয়া’ বলে ধারণা করা হয়। একইভাবে কেন্দুয়ার আরও কিছু স্থানের নামের সঙ্গে বাঈজীদের নাম জড়িয়ে আছে (যেমন — পনকেন্দুয়া, কান্দিউড়া ইত্যাদি)।

ঈশা খাঁ-র মৃত্যুর পরে তাঁর ছেলে মুসা খাঁ শাসন-ক্ষমতা গ্রহণ করেন। জনশ্রুতি থেকে জানা যায় মুসা খাঁ-এর শাসনবিস্তারকে প্রতিহত করতে সুসঙ্গ রাজ রঘুনাথ সিংহ যুদ্ধযাত্রা করেন। সংবাদ পেয়ে মুসা খাঁ-র বাহিনিও অগ্রসর হয়। বর্তমান আটপাড়াস্থ মগড়া নদীর দক্ষিণ তীরে মুসা খাঁ ও উত্তর তীরে রঘুনাথ সিংহের বাহিনি অবস্থান নেয়। এই যুদ্ধে রঘুনাথ সিংহের বাহিনি পরাজিত হয়। মুসা খাঁ-র সৈন্যবাহিনি যুদ্ধজয়ের আনন্দে ঐ স্থানে একটি শহর গড়ার কাজ শুরু করে। মগড়া নদীর তীরের উচ্চ ভূমিতে স্থাপিত এই জনবসতির নাম মুসা খাঁ-র নামে ‘শহরে মুসাইয়া’ দেওয়া হয়। এই ‘শহরে মুসাইয়া’ কালক্রমে শরমুসাই>শরমুইস্যা>স্বরমুশিয়া-তে রূপান্তরিত হয়।

যদি প্রশ্ন করা হয় কিউপিড ও মদন-এর মধ্যে সম্পর্ক কী? সাধারণ্যে একটি হাসির বিষয় হবে নিশ্চয়- কোথায় আগড়তলা, আর কোথায় চৌকিরতলা! একটু  খোলাসা করা যাক। প্রাচীন রোমীয় ভালবাসার দেবতা হলেন কিউপিড; ভালবাসার দেবী ভেনাস-এর পুত্র। রূপের দেবী সাইকি’র প্রতি ভেনাসের প্রতিহিংসা, ক্রোধ, বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে কিউপিড ও সাইকি’র মিলনের কাহিনি প্রেমিকমনকে আন্দোলিত করে ভীষণভাবে। অপরদিকে, অভিধান অনুযায়ী মদন শব্দের অর্থ হলো ‘কাম ও প্রেমের দেবতা’ বা ‘কামদেব’, হিন্দু প্রেমের দেবতা, কৃষ্ণ, কিউপিড-এর প্রতিরূপ। মৈমনসিংহ গীতিকার কাহিনিগুলো মূলত মদন, খালিয়াজুরী ও কিশোরগঞ্জের হাওড় এলাকার পটভূমিতে রচিত। গ্রিক বা রোমান পুরানের মতো এই লোকগাঁথাগুলো সৌন্দর্য, প্রেম, প্রতিহিংসা, প্রতিবন্ধকতা, ত্যাগ ও পরিণয়ের রোমঞ্চকর কাহিনিতে ভরপুর। তাই, ‘মদন’ ও ‘কিউপিড’ সমার্থক। এমন যোগসূত্র যদি ভ্রমণপিপাসুদের মধ্যে positive externality তৈরি করে এবং নেত্রকোণার পর্যটনকে promote করে তবে ক্ষতি কী? মদন উপজেলার নামকরণের এমন একটি ব্যাখ্যা তাই দাড় করানো যেতেই পারে! যদিও ঐতিহাসিকগণের মতে ফার্সী শব্দ ‘মুদন’ যার অর্থ ‘শহর’ বা ‘নগর’ থেকে এই মদন নামের উৎপত্তি। কারণ ১৮৩৭ সালে ইংরেজ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই এলাকার রাষ্ট্রীয় কাজে ফার্সী ভাষা ব্যবহৃত হতো।

কিছু নাম রয়েছে যা থেকে নামকরণের কারণ সম্পর্কে সহজেই অনুধাবন করা যায়। ‘পেতনি বিল’ ও ‘ভুড়ভুড়িয়া বিল’ নাম পৃথক হলেও নামকরণের কারণ একই। বিজ্ঞান অনুযায়ী যুগ যুগ ধরে মাটিতে মিশে যাওয়া গাছপালা, আগাছা ও বিভিন্ন জৈব দ্রব্য পচে মিথেন গ্যাস তৈরি হয়। পানির মধ্য দিয়ে উঠে আসা এই মিথেন গ্যাস বুদবুদ বা ভুড়ভুড়ি তৈরি করে। অপরদিকে, শুষ্ক মৌসুমে হাওড়ে বা বিলে কাদামাটি থেকে বের হয়ে আসা গ্যাস বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে আগুনের শিখা তৈরি। দিনের বেলা এই শিখা দেখা না গেলেও রাতের বেলায় দেখা যায়। প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট এই আলেয়াই স্থানীয় মানুষের মাঝে পেতনির (ভূত-পেতনি) কারসাজি হিসেবে পরিচিত। তাই, পেতনি বিল ও ভুড়ভুড়িয়া বিলের নামকরণের প্রেক্ষাপট সহজেই অনুমেয়। একইভাবে বেদেদের আনাগোণা থেকে বাইদ্যার হাওড়, প্রাকৃতিক পাঙ্গাশ মাছের রাজকীয় বিচরণ ক্ষেত্র থেকে পাঙ্গাসিয়া হাওড়ের নামকরণ হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। গোমড়ার আভিধানিক অর্থ গম্ভীর, মলিন কিংবা মুখ ভার করা। আবার গোমরাহি অর্থ হলো বিপথগমন বা সত্যমিথ্যা সম্পর্কে অজ্ঞতা। এই হাওড়ের মেজাজ মোনালিসার হাসির মতো রহস্যময়। এখানের আবহাওয়ায় সার্বক্ষণিক গুমোটভাব কুলক্ষণের দিকেই ইঙ্গিত দেয়। শান্তরূপের হঠাৎ করেই ভয়ঙ্কর রূপে আবির্ভূত হওয়া থেকেই ‘গোমড়ার হাওড়’ নামকরণ বলে অনুমেয়। অপরদিকে, কিছু নাম আছে যা থেকে এর নামকরণ সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায় না; কখনও কখনও এই নামগুলো বিভ্রান্তিও তৈরি করে।হাওড়…একটি নির্দিষ্ট এলাকা; যার শুনতে পাওয়ার কোনো বালাই নেই, তার নাম ‘বয়রা’ (যে কানে শুনতে পায় না) হওয়া…‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’ হওয়ার মতোই ঘটনা নয় কি? একজনকে প্রশ্ন করা হলো, ‘কোথায় যাচ্ছ’? উত্তর এলো, ‘সেইচাহনী’। ‘টু দ্য পয়েন্ট’ উত্তরের মানদণ্ডে অবশ্যই লোকটির মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগবে। বাস্তবতা হলো একটি গ্রামের নাম ‘সেইচাহনী’।বাঙালিদের মধ্যেও এমন অনেক নাম রয়েছে যা থেকে তার ধর্ম বা লিঙ্গ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় না। ‘মন্টু সরকার’ বা ‘মিলন চৌধুরী’ হিন্দু নাকি মুসলিম? সুমন, পলাশ, রানা, বিপ্লব, পল্লব, রাখি, রাজু, সীমা, বাপ্পী’র মতো ছোট নামগুলো হিন্দু বা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে খুবই কমন। আবার শিশির, মিঠু,শিমুল, নাহিদ, বারুদ বাশামীম নামগুলো ছেলে কিংবা মেয়ে উভয় শ্রেণির মধ্যেই বিরাজমান। ‘মুচিরাম গুঁড়ের জীবনচরিত’ গল্পে এমন নামকরণের একটি সরল ব্যাখ্যা দিয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়। তাঁর ভাষায়, ‘এত নগেন্দ্র, গজেন্দ্র, চন্দ্রভূষণ, বিধুভূষণ, থাকিতে তাঁহার মুচিরাম নাম হইলো কেনো, তাহা আমি সবিশেষ জানি না, তবে দুষ্ট লোকে বলিত যে, যশোদা দেবীর যৌবনকালে কোনো কালো-কালো কোঁক্‌ড়াচুল নধরশরীর মুচিরাম দাস নামা কৈবর্ত্তপুত্র তাঁহার নয়নপথের পথিক হইয়াছিল, সেই অবধি মুচিরাম নামটি যশোদার কানে মিষ্ট লাগিত’। সোজা কথায় ‘যার বয়ানে যা প্রকাশিত ভালো’।

প্রাসঙ্গিকভাবেই একটি ঢাকাইয়াকৌতুক বলতেই হয়। এক ভদ্রলোক, নাম আনিস চৌধুরী। বাসার নিকটেই মোড়ের রেস্তোরাঁয় শিঙ্গারা, চপ, চা বাকিতে খান। মাস শেষে দাম শোধ করেন। নামস্বাক্ষর করে স্লিপ পাঠিয়ে দিলে কখনও দোকানের মালিক নিজেই খাবার নিয়ে আসেন অথবা বয় দিয়ে পাঠিয়ে দেন। একদিন আনিস সাহেব শিঙ্গারা ও চায়ের জন্য স্লিপ পাঠিয়েছেন; কিন্তু খাবার আসছে না। অনেকক্ষণ পরে মুখ গম্ভীর করে মালিক হাজির। আনিস সাহেব বললেন, ‘খাবার কোথায়? স্লিপ পাঠিয়েছি সেই কখন, এত দেরি কেন? আর আপনিই বা খালি হাতে কেন’? রীতিমতো জেরা।

দোকানদার গাম্ভীর্যের সঙ্গে মুখ খুললেন, ‘ছাব, আমরা কি মানুষ না নিহি? মনে হইতাছে গাড়া-গপ্পরে পইড়া গেছিগা। এত ইংখার করেন ক্যালা? তুইতুকারি করবার লাগাইছেন আইজকাইল’। আনিস সাহেব কিছু বুঝতে না পেরে বিমূঢ়ভাবে দোকানির দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আমি আপনারে তুইতুকারি করলাম কখন’? রেস্তোরাঁর মালিক আনিস সাহেবের সামনে স্লিপ মেলে ধরলেন; তাতে লেখা —

১। দুটো শিঙ্গারা
২। এক কাপ চা
— আনিস।

আপনেগো আতের ফাছা (হাতের আঙ্গুলের ফাঁকা) দিয়া পইড়া গেছি নিহি? দোকানদার বলতেই থাকেন।

আনিস সাহেব দম ফাটানো হাসি দিয়ে বললেন : ও, এই কথা! ভুল হয়ে গেছে ভাই। ওটা আমার নাম, এরপর থেকে পুরোটাই লিখব।

এরিস্টটলের Theory of Causality (relation between cause and effect) অনুযায়ী কোনো বস্তুর অস্তিত্ব বা বিলুপ্তি কিংবা কোনো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার বিজ্ঞান ভিত্তিক ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য তার কারণ বা কারণসমূহ সম্পর্কে অনুসন্ধান করা আবশ্যক। মহামতি এরিস্টটল এই কারণগুলোকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। দার্শনিকদের জন্য সমধিক প্রযোজ্যএই চারটি শ্রেণিকে সামান্য পরিবর্তনপূর্বক স্থানের নামকরণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে; অর্থাৎ কে এই নামকরণ করেছেন (the efficient cause), নামকরণের জন্য কী কী বিষয় বিবেচনায় নিয়েছেন (the material cause), নামটি কী হলো (the formal cause) এবং সামাজিক প্রভাব কী (the final cause)? এই তত্ত্বের সঙ্গে যদি বেঙ্গট প্যাম্পের নামকরণের শর্তাবলি মিলিয়ে নেওয়া হয় তাহলে নামগুলো অবশ্যই অর্থবহ হবে। নাম নিয়ে বিভ্রান্তি বা বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়ানো যাবে সহজেই।

নেত্রকোণার নামকাহন (দ্বিতীয় পর্ব)

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you