ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড, আর্টের সংজ্ঞায়ন ও কৌতুকশিল্পী || মৃদুল মাহবুব

ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড, আর্টের সংজ্ঞায়ন ও কৌতুকশিল্পী || মৃদুল মাহবুব

কথা‌শিল্পী শাহাদুজ্জামানের ‘কমলা রকেট’-এর মূল চ‌রিত্রের অ‌ভিনেতা মোশাররফ ক‌রিমকে শ্রেষ্ঠ কৌতুকশিল্পীর তা‌লিকায় পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে। চিত্রনাট্যকা‌র সহ অন্যান্যরা এ নিয়ে আপ‌ত্তি প্রকাশ করেছেন নানাভাবে। আমার একটু অবাক লেগেছে এটা ভেবে যে শিল্পী যা ভেবে শিল্প সৃ‌ষ্টি করেছেন ঠিক সেইমতো পাঠক-দর্শককে তা দেখতে হবে বলে!

লেখক শাহাদুজ্জামানের ভাষ্যমতে, “জানলাম এ-বছরের বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারের তালিকায় ‘কমলা রকেট’ ছবিটির জন্য জুটেছে এক অভিনব পুরষ্কার। পুরষ্কার শ্রেষ্ঠ কৌতুকঅভিনেতার জন্য। চিত্রনাট্য যখন লিখি মোশাররফ করিমের চরিত্রটিকে আর যেভাবেই ভেবে থাকি না কেন কৌতুকচরিত্র ভাবিনি ঘুণাক্ষরেও। এমন একটা বহুস্তরী চরিত্রের এ-ধরনের মুল্যয়নে আমি বেশ বিস্মিত এবং খানিকটা কৌতুকাচ্ছন্নও।”

অনেকেই তার সাথে সমমত। তা যে‌-কেউ ভাবতেই পারেন। আমার প্রসঙ্গ একটু অন্য হলেও এর সাথে রিলেটেড।

নিজের আর্টকে শাহাদুজ্জামান ডিফাইন করে দিচ্ছেন। এটা কৌতুকচ‌রিত্র না ঘুণাক্ষরেও বা বহুমুখী চ‌রিত্রের ভিজ্যুয়াল রূপ। আর্ট প্রকা‌শিত হওয়ার পর, পাব্লিকের হাতে যাওয়ার আগে বা পরে এই রকমের প‌জিশ‌নিং ঠিক করে দেওয়া কতটা কাজের? বা তা ঠিক করে দিলেও কি দর্শক কৌতুকের পরিবর্তে একে বহুমুখী চরিত্র হিসাবে দেখবে কি না?

চা‌র্লি চ্যাপ‌লিন বে‌শিরভাগ দর্শক হা‌সিতামাশার খোরাক হিসাবে দেখে। ‌লুটোপুটি-খাওয়া পাশ‌বিক আনন্দ আছে তাতে। চা‌র্লিকে বে‌শিরভাগ লোক কৌতুককার হিসাবে জানে। তো এখন এগুলো কৌতুক না বলে চার্লিকে বিয়োগাত্মক ক্রিয়েটর হিসাবে মার্ক করলে কী হবে? ধরেন আমরা বললাম যে দু‌নিয়ার শেষ ট্র্যাজে‌ডি অভিনেতা চা‌র্লি। লোক তাকে কৌতুকশিল্পী হিসাবে দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বে। ফোকফেস্টে যেমন বাসুদেবের গাওয়া ‘চল মে‌নি আসাম যা‌ব’-র সাথে সাথে দর্শক নাচতে থাকে। এই গানের বেদনা বোঝার দায় শ্রোতাকে দিলে সে নেবে না। সমাজের মধ্যে আর্ট কেমনে কাজ করে? ফলে, দুনিয়ার হা‌সি, কান্না, তীব্র‌ বোধ, বিবেচনা, গভীরতা যখন আ‌র্ট হিসাবে প্রকা‌শিত হয় তখন তা আর ঐ-সকল জিনিসের মতো থাকে না। আর্ট মাত্র মান‌বিক অনুভূ‌তির একটা টুলস হয়ে ও‌ঠে। রিয়া‌লি‌টি ডিস্টর্টেড হয়ে পড়ে। আমরা চরম দুঃখের কোনো সিন্ দে‌খার পর হিসাব করি শিল্পী কতটা দক্ষতার সাথে শিল্পমে‌শিনে দুঃখ উৎপাদনে সক্ষম। মানে শিল্পের ছাঁকুনির ভিতর দিয়ে বাস্তবতা প্রকা‌শিত হওয়ার পর তা অন্য কিছু হয়ে ওঠে। ফলে, অবসাদ, হত্যা, জিঘাংসার, কৌতুকের সফল শি‌ল্পিত প্রকাশ মানবমনে আনন্দ উৎপাদন করে।

শি‌ল্পপ্রভা‌বিত দুঃখ আমাদের আন‌ন্দিত করে। বরং আমরা লেখক-শিল্পীরা আর্টের যে ডিপার মি‌নিং দিয়ে জনগণ শাসন করতে চাই আর্ট সে-কায়দায় চলে না, লেখক হিসাবে চাইলেও চলে না। চা‌র্লি দু‌নিয়ার ট্র্যাজে‌ডি যা কৌতুক হিসাবে সমাজে দৃষ্ট। ফলে, টোড ফি‌লিপ্সের ‘জোকার’ যখন মেট্রোস্টেশনে তিনজনকে গু‌লি করে হত্যা করে তখন দর্শক খুব নিজেদের জিতে যাওয়ার হর্ষধ্ব‌নি দেয়। দর্শকের করতা‌লির আকাঙ্ক্ষা খুব প্রি‌ডিফাইনড। মানে আর্টের কোথায় তারা হাততা‌লি দিবে, কোথায় হর্ষধ্ব‌নি দিবে তা ঠিক করে দেওয়া। আর্টকে ঠিক করে দেওয়া মানে দর্শকের চোখে থ্রি‌ডি চশমা পরিয়ে দেওয়া। এর ভেতর দিয়ে না তাকালে ত্রিমা‌ত্রিক জগৎ উন্মোচিত হবে না। আর্টকে স্থির করে দেওয়া মানে জোকারকে প্র‌তিবাদের প্রতীক হিসাবে তুলে ধরার মতো ব্যাপার। দানবটাকে দেখা যায় না।

কোমল পানীয়ের যে অ্যাড তাতে দেখবেন, এটা না খেলে সাহস বাড়ে না, খেলে তা জীবনকে চনমনে করে দিবে, সারাদিনের ক্লা‌ন্তি মুছে দিবে ইত্যা‌দি ইত্যা‌দি। বা ব‌ডিস্প্রের অ্যাড যেমন দেখাবে আপনার চারপাশের বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে এর সুবাস অ্যারাউজ করবে। এগুলো সত্য না হোক, কাজ করে মনে হয় প্রোডাক্ট ফে‌টিশিজমে কালে। কোকাকোলা খেয়ে আমরা তারুণ্যের জয়বোধ ক‌রি। মাউন্টেন ডিউ আমাদের অবচেতনকে সাহসী থাকার সিউডো অনুভূ‌তি দেয়। ফলে, আমরা কিনতে থা‌কি। মান‌বিক বি‌চিত্র, বহুমুখী শিল্পের তকমাও এমন আরোপনই যা শিল্পের বহুমুখকে রুদ্ধ করে।

শিল্পকে ওপেন করে দিলে ভালো। তাতে বরং বহুমুখ তৈ‌রি হয়। আ‌র্টিস্ট নিজের আর্টকে সি‌রিয়াস কিছু হিসাবে উপস্থাপন করলে তা শুধু তার সি‌রিয়াসনেস নিয়ে বিরাজ করতেই থাকে। আর্টের সি‌রিয়াসনেস খুব সি‌রি‌য়িস বিষয়। আর্টকে ডিফাইন করাও এমনই ঘটনা‌ লেখকের তরফ থেকে। দর্শক-শ্রোতার অবচেতনকে আটকে দেওয়া বলে মনে হয়।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you