শোক, শক্তি, ভক্তি, মুক্তি, বুলবুলি, মস্তক, শিঙাড়া ও গণরুদালিরা

শোক, শক্তি, ভক্তি, মুক্তি, বুলবুলি, মস্তক, শিঙাড়া ও গণরুদালিরা

শোকদিবস। এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছিলেন, সপরিবার, ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে। এ-কথাটা ডায়রিতে টুকে রাখছি খুবই প্র্যাক্টিক্যাল নেসেসিটি থেকে। একদিন এই মাতম থামবে, পৃথিবী আবার শান্ত ও স্বাভাবিক হবে, একদিন হয়তো এই ফেবুডায়রিতে টুকে-রাখা সাধারণ তথ্যটি পড়ে কোনো ইতিহাসাগ্রহী লোক খুঁজতে বেরোবে তার গতজন্মের গলতি ও গঞ্জনা। আপাতত গণমাতম চলছে, এইটা চালু রহুক, এর ফলে ইতিহাস শক্তপোক্ত হচ্ছে। একুশ বছর শোকে থেকে সেই শোক এমন শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পেরেছেন শেখতনয়া, যা দিয়া একুশ বছর শক্তি প্রদর্শন তো সম্ভব হলোই, বিরোধীর বংশ মোটামুটি নিকেশ করা গেল, ইন-অ্যাডিশন আরও একুশ সম্পন্ন হবার পথে, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ-বিপর্যয় না এলে এমনধারায় একুশের সিরিজ জয়যাত্রা ব্যাহত হবে না আশা করা যাচ্ছে। এমনিতে ইলেকশন ইত্যাদি ভীতিকর রাহুর খপ্পর থেকে বাউলি কেটে খেইড় নিজের হাতে নিয়ে নেবার একটা আর্যা-ফর্ম্যুলা বাইর করা গেছে। এইবার আর পায় কে! এইবার পিনোশেট বা ইদি আমিন কি মুয়াম্মার গাদ্দাফির লিডারগিরির রেকর্ডটা আমরা অতিক্রম করবার পথে।

অ্যানিওয়ে, যা-হোক, প্রতি পাঁচবছর অন্তর বাংলাদেশের এই শোকদিন তার জাতীয় তথা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা হারাইত আগে, এখন হারাইতে হয় না। আগে কেন হারাইতে হতো — কতদিন চলছিল অমন হারানো-খোয়ানো — সকলেই মালুম। তবে এ-নিয়া ভ্যানতারা-টানাবাহানা ইমিডিয়েট বন্ধ করা দরকার। সেইসঙ্গে এমনকিছু সুস্পষ্ট বন্দোবস্ত করা দরকার যাতে কেউ পনেরো আগস্ট শোকদিবস বিষয়ে অহেতু বুজরুকি না করে। এহেন বন্দোবস্ত যিনি বা যারাই করে দেবেন, জাতি তাকে মনে রাখবে, সকলেই শোকর গোজার করবে। একটা ব্যাপার তো ঠিক, রাষ্ট্রীয় মেশিন্যারিজ ও ম্যাকানিজম ব্যবহার করে সবকিছু সুচারু হয়ও না, কাউরে কোনোকিছুতে বাধ্য করে তেমন দূর যাওয়াও যায় না। তা বিলক্ষণ। তবে শোকদিবস ইশ্যু নিয়া মানুষের আবেগ মোটমাট পক্ষে, এইটা বোঝার জন্য পোলিটিক্যাল অ্যানালিস্ট কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বাচাল অধ্যাপক হইতে হয় না। ধান্দা অন্যত্র, অতীব পুরনো, ফলে পাঁচবছরান্তরে দৃশ্য বদলায়া যায়। যেত অন্তত আগে। এইটাও হয়তো ঠিক, রাষ্ট্রের সাবালক হওয়া আমরা ঠেকায়ে রাখতে চাই।

কিন্তু লজ্জাশরম তো আজ-হোক কাল-হোক হতেই হবে। এই দিবস নিয়া বাহানামূলক অস্বীকৃতি টাল্টিবাল্টি নির্লজ্জ অর্বাচীনতারই লক্ষণ। তবে সেইসঙ্গে এইটাও ঠিক, শোকপ্রকাশের বহর ও প্রক্রিয়াধারা নিয়াও বোধোদয় হওয়া দরকার আমাদের। নাজিম হিকমত বলেছিলেন কবিতায়, যে, পৃথিবীতে শোকের আয়ু কুল্লে তিনদিন। কথাটা কাব্যিক ও ব্যবহারিক উভয়ত সত্য ও তাৎপর্যবহ বলে মনে হয় আমার কাছে। কিন্তু চতুর্থ দিন থেকে — ধরা যাক মাতৃমৃত্যু অথবা জনকের প্রস্থানজনিত — শোক পুরো ভুলিয়া যাই আমরা? আত্মীয়বিয়োগজনিত শূন্যতা আর বোধ করি না আগের মতো? করি, জীবনভর, করিই তো। তবু ভুলে যাই, গিয়ে প্রবিষ্ট হই জীবনে, আবার ভুলি না। মায়ের অথবা নিকটাত্মীয়ের বিয়োগজনিত শোক ঠিক যেভাবে এবং সুস্থস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যেমন প্রবাহিত রহে এবং অধিকতর জীবনলগ্ন করে রাখে আমাদেরে, এবং পালন করি শোক যেভাবে বছরের নির্দিষ্ট একটি দিন এলে, যদিও শূন্যতার একটা শান্ত ছায়া আমাদেরে একটা মুহূর্তও ছেড়ে যায় না, জাতীয় তথা রাষ্ট্রীয় শোকদিবসও যেন অনুরূপ স্বাভাবিকভাবেই পালন করতে শিখি।

মৃত্যুজনিত মর্সিয়া একটা নির্দিষ্ট সময়পর্ব পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত, পরে একসময় এইটা হয়ে ওঠে স্রেফ অভিনয়, একসময় এইটা আনুষ্ঠানিকতার ঘেরে আটকে পড়ে। যেমন ধরা যাক, দেখা গেল, প্রচারযন্ত্রের সামনে এসে এক লোক কেঁদেকেটে একসা হলো শোকদিবস স্মরণে। এখন এইটা কি ফার্সিক্যাল নয়? সেইটা না-ও হইতে পারে ব্যক্তিভেদে, কিন্তু সুস্থ মানুষ হিশেবে আমাদেরে ভেবে নিতে হবে যে, এতে শোকদিবসের ‘ভাবগাম্ভীর্য’ ব্যাহত হচ্ছে। এই কান্নাকাটি দিয়া যেন কোনোভাবেই জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটির মর্যাদাহানি না-ঘটে। এইখানে স্মর্তব্য ফের প্রচারযন্ত্রের ভূমিকা, খাস করে রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রের ভূমিকা, এবং সেই যন্ত্রাচরিত ও প্রদর্শিত বহুবিধ অনুষঙ্গসমূহ। কুলখানিতে যেমন হুজুর ডেকে মিলাদ ও দোয়াখায়ের ইত্যাদি দিয়া মাহফিল করা পারিবারিক তথা সামাজিক রুসুম ও সৌন্দর্য, শোকদিবসে টেলিভিশনসেটে সেই জিনিশ ততটাই অসুন্দরদৃশ্য। বুঝতে হবে যে, এই দিবস নিয়া আমার বাপের প্রজন্মের আবেগ আর আমার নিজের প্রজন্মের আবেগ এবং সর্বোপরি আমার সন্তানের প্রজন্মের আবেগের এসেন্স এক হলেও অভিব্যক্তি ও আবেগপ্রকাশ তথা প্রকাশপ্রক্রিয়া এক নয়। ঈদভ্যাকেশনেও প্রতিষ্ঠানগুলার শোকদিবস পালনের বাধ্যতায় বিশেষ কিছু মূল্য সংযোজিত হলো কি? শিথিলতা থাকলে অ্যাপ্রিশিয়েবল হতো মনে হয়। এই ব্যাপারগুলো খুব সুক্ষ্ম, পার্থক্য ধরতে হয় সময়মতো এবং সেইমতো প্রকাশধারা নবায়ন করে নিতে হয়। অ্যাডপ্ট করা অর্থে নবায়ন। পরিবার তথা সামাজিক পর্যায়ে যা বা যেসব আচার-অনুষ্ঠানকৃত্য সুন্দর, রাষ্ট্রীয় তথা জাতীয় পর্যায়ে সেসব হুবহু সুন্দর না-ও হইতে পারে তো! অসুন্দর বরং, সর্ববিবেচনাতেই অসুন্দর বলব।

লোকে এখন — শুধু এখন তো নয়, সেই শুরু থেকেই প্রায় — বঙ্গবন্ধুকে অবিসংবাদিত প্রতিদিনের হাওয়াবাতাসে-মিশে-থাকা মানুষ হিশেবে গণ্য করে। এইটা গ্রাহ্যে রেখে শোকদিবস পালন করলে শোকসভা ও শোকাচারসমূহ সর্বাঙ্গসুন্দর হয়। এই দেশের জনরুচি বরং অনেক এগিয়ে, আমার মতে, এখানকার প্রতিষ্ঠানরুচি তথা এস্টাব্লিশমেন্টের ম্যাচিউরিটি এখনও গড়ে ওঠে নাই। তা সেটা সরকারি হোক, অথবা অসরকারি। কিন্তু শোকদিবস নিয়া টানাহ্যাঁচড়া যেন দেখতে না হয় আর, শোকদিবস যেন শোকদিবসের জায়গাতেই থাকে, এইটা আমরা অবিলম্বে এনশিউর করি।

কিন্তু রুদালিদের কথাটাও কন্সিডার করা দরকার। সম্ভবত দেশে এখন রুদালিসংস্কৃতি বিকশিত হতে হতে বিকাশের চূড়া টাচ করে ফেলেছে। এরা যাবে কই, করবেটা কি, এই রুদালিরা? বাংলাদেশে বিকশিত ও বিকশমান এই গণরোদনের পথিকৃতেরা? মহাশ্বেতা দেবীর ছোটগল্প ‘রুদালি’ কে ভুলতে পেরেছে, একবার পড়বার পরে? এই স্টোরি নিয়া বানানো কল্পনা লাজমির ম্যুভিটায় ডিম্পল কাপাডিয়ার অভিনয়? কিংবা ছায়াছবিতে ব্যবহৃত ভুপেন হাজারিকার গান ও মিউজিক ডিরেকশন? গল্পে রাজস্থানের লোয়ার কাস্টের একটা নারী জনগোষ্ঠীকে দেখানো হয় যারা কিনা আপার কাস্টের পুরুষদের মৃত্যুশিয়রে/শবশিয়রে হাজির হয়ে রোদন করে গ্রাসাচ্ছাদন জোটায়। পেশাজীবী এই গোষ্ঠীটা রাজস্থানের সংস্কৃতির বা সোশ্যাল কাস্টমেরই একটা বাহন, সামাজিক গ্রিফের একটা কালচারাল ভঙ্গি। ক্রিশ্চিয়্যান গোরস্থানগুলাতেও দেখা যায়, ইংলিশ ম্যুভি-সিরিয়্যালে দেখেছি, এই ধরনের পুরুষ কান্নাকার একেকটা গোরের সামনে গিয়া হাপুস নয়নে কেঁদেকেটে পয়সা কামাচ্ছে। এইটার একটা সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব তো অবশ্যই আছে। এই জিনিশ বাংলাদেশে একদশকের বেশিকালের বনেদ গড়ে তুলেছে এরই মধ্যে। বর্ণিত দুই উদাহরণের লগে বাংলাদেশের তফাৎ এ-ই যে, এখানে এইটা সাংস্কৃতিক দিক থেকে একটা হাসিঠাট্টার ফেনোমেনা আজও এবং আশার কথা হচ্ছে এখানকার এবং এখনকার প্রেক্ষাপটে এর রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। সামনের দিনরাইতগুলায় এর গুরুত্বসীমা আরও বর্ধিত হবে, এই কথাটা হাফইঞ্চিও মিথ্যা না।

ভালো কথা, আগস্ট এলে আরো অনেক শোক বুকে বেজে ওঠে আমাদের। মনে পড়ে এই মাসেরই ১১ তারিখে, ২০০৪ সালে, দুর্ধর্ষ ধম্মের ষাঁড়ের শিঙের আঘাতে নিহত হয়েছেন দুর্বিনীত কবি ও ঠোঁটকাটা পণ্ডিত হুমায়ুন আজাদ। সুরাহার বহুদূরে রয়ে গেল আজও সেই বিচার। এই মাসেরই ১৭ তারিখে, ২০০৬ সালে, ছেড়ে গেছেন আমাদেরে একজন সর্বজননন্দিত তন্নিষ্ঠ কবি শামসুর রাহমান। শুধু এই দুইজনই তো নন, খুঁজলে এই মাসে বিদায়-জানানো মহাজ্ঞানী মহাজন আরও গোটাকয় পাওয়া যাবে না তা নয়। আগস্ট সত্যিই মৃত্যুশোকের মাস, বাংলাদেশে, পনেরো আগস্ট সন্দেহাতীতভাবে সেইসব সকল শোকের প্রদীপ হয়ে জ্বলে রইবে দিবানিশি। কিন্তু রুদালিদের কালচার ডেভেলপ করার ক্ষেত্রে একটু সচেতন-সনন্দন এফোর্ট দরকার মনে হয়। ক্যামেরার সামনে পেশাদারি কান্নাকারদের নিয়া, জাতির অন্তর্গত বছরভরা কান্নাপেশাজীবীদের নিয়া, ভাবা আশু দরকার। জাতির মানইজ্জত রক্ষাকল্পেই তা আরও জরুরি।

লেখা / জাহেদ আহমদ

… …

জাহেদ আহমদ

পরের পোষ্ট
আগের পোষ্ট

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you