দলে দলে লোকে কোথায় চলিয়াছে — দলে দলে লোকে ঈদগাহে চলিয়াছে — আজ ঈদ — ধনী-গরিব সবাই আজ সমান — সবার মুখ আজ হাসিখুশি — পলান্ন ও রেজালার ঘ্রাণে আজ বস্তিঝুপড়িগুলো ভুরভুর করিতেছে — পথকুকুরের কণ্ঠে আজি সিনার হাড্ডি আটকানো ঘর্ঘর আওয়াজ — সতত সুখের এই পির্থিমি —
এইসব কথাবার্তা সম্বলিত একটা চ্যাপ্টার ছিল আমার ছেলেবেলার স্কুলপুস্তকে — ‘আমার বই বাংলা’ ছিল নাম তার — হুবহু বলি নাই, বলা সম্ভবও নয় আজ আর — সেই বইটিতে এই ঈদ বিষয়ক চ্যাপ্টারটি ছিল অন্যরকম প্রিয় আমার — সরব আবৃত্তি করতাম সেইটি — সঙ্গে ছিল ছবি, ঈদগাহের, বটগাছের, কোলাকুলির — হাশেম খান আর সম্ভবত সরদার জয়েনউদ্দীন নামের আরেকজন শিল্পী আঁকতেন আমার ছেলেবেলার বইগুলিতে — শাদাকালো ছবিতে অরণ্য-বনবীথির ফোকর ঢুঁড়ে বের করতাম শিল্পীর সিগ্নেচার — সেইজন্য ভুলি নাই আজও — ভুলিব না — কভু ভুলিব না — কোটি মন্বন্তরেও ভুলিব না আমি দিনগুলি-রাতগুলি —
কিন্তু বড় হতে হতে বুঝতে পারি, বইপুস্তকে ঢের ধাপ্পা আর বুজরুকি মারা — আজ আমি জানি যে, এমনকি শিশুপাঠ্য পঠনোপকরণেও যারা ধনী-গরিব যুগলমূর্তি একনিঃশ্বাসে একবাক্যে পাশাপাশি বসায়ে দেয় তারা ফাজিলের একশেষ — এইসব ফাজিলে ভরে আছে বেসরকার-সরকার — এরা জীবনে শিশুকালীন বইটাও যদি ঠিকঠাক পড়ত, তবে দেশের এই হাল হইত না —
দ্যাখো দ্যাখো, কথায় কথায় দেশ তুলে শাসানি-ধমকানি তো কোনো কাজের কথা না ভাই — আজ্ঞে — নটরাজনীতিকরাও তো অদ্য ওই বদখাসলত আনস্মার্ট কন্সিডারপূর্বক ছেড়ে দেবার কসরত করছে — জাতীয় ইশ্যু না-হলে জাতিকে জড়ানোর পাঁয়তারা তারা বক্তৃতায় করছে না আর —
আমার মেয়েকে ঈদ বিষয়ে বোঝাতে গিয়া ফাঁপড়ে পড়লাম — ছেলেবেলার বইয়ের গাঁজাখুরিই দেখি হড়হড় বলে চলেছি তারে — সে-ও গোগ্রাসে গিলিতেছে — একটাও পৌক করছে না, খোঁচা মারছে না — নায়্যিভিটি দেখে, ওর মধ্যে ক্রিটিক্যাল কনশাসনেস গ্রো করে নাই দেখে, এক্সট্রা আদর করে দিলাম চিবুক ও থুতনি নেড়ে — আসলে নিজের মিথ্যাচারজনিত অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাবার আশে একটু কম্পেন্সেশন —
পরে ব্যাপারটা নিয়া ভাবলাম — মনে মনে বললাম, যতদিন এমন সরল থাকবি, মা রে, ততদিনই পৃথিবীটা তোর মনের মতো থাকবে — যেই ক্রিটিক্যাল মাঙ্কি হবি, অমনি ফস করে ফসকে যাবে হাত থেকে দুনিয়াটা তোর — ওরে আমার গানের খাতা, জানের পানি, ওরে আমার রাত্রি-বিকেল-ভোর — তুই গান গা ইচ্ছেমতো, বাতাসকে খুশি করে বাঁচ, সবুজের বুকপাতা শিশিরে পা ডুবিয়ে হাঁট — ওরে আমার বয়কাট চুলছাঁট — তুই বৃথা সাধতে যাসনে এসেংতেসেং গদ্যপদ্য বড়লাট-ছোটলাট —
মনে পড়ে গেল, এই ঈদটা আমাদের কাছে আসত যতটা-না আনন্দের তারচেয়ে অধিক বিষাদের হয়ে — খাজুল মুখে আমরা ভাবতে থাকতাম, আহা, আরও পাক্কা একবছরের ধাক্কা, তারপর ঈদ আসবে একখানা, এত্ত দূর — বকরা ঈদে এসে শেষ হয়ে যেত বছর আমাদের — অতল-দীঘল প্রতীক্ষা শুরু হতো — গরু কুরবানি দেয়া দেখে সেরে মনে হতো, সকলি ফুরলো — কুরবানির ঈদ আমাকে পশুপ্রেম উপহার দিয়েছে — পশুমমতা — না না, মায়া জন্মাইবার জন্য জবাই করতে হবে, এইটা ফালতু কথা — তা, তদ্দিনে গল্পের কিছু পশুপাখি-তরুলতা বুকপকেটে নিয়া হাঁটা শুরু করে দিয়েছি বটে — আমার সহোদর ছোটভাই পাঠশালা পাশের আগেই লিখে উঠছে প্রেমের উপন্যাস — নরনারীর প্রেম — সেই নিয়া আমাদের উচ্চাভিলাষী উত্তেজনাও চরম — পড়ে ফেলেছি রবিবাবুর ছুটি কিংবা বলাই, দইওলার হাঁক শুনতাম হজমি-ঘিচমচমবিক্রেতার মুখে — অমলের মুখ দেখতাম বিকেলবেলা হোমওয়ার্কের হ্যাপায় গৃহান্তরীণ ক্লাসমেটের অবয়বে — শরতের মহেশ আমাদেরে তাড়িয়ে বেড়াতে শুরু করেছে তদ্দিনে বখ্রাঈদের সিজনে —
এইসব মনে পড়ছিল — সারাদিন — চুপচাপ — দুপুরবেলা একলা একটা পাখি ডেকে ডেকে দৃশ্যের অন্তরালে মিইয়ে গেল — জবাফুলগুলো ঝুলে ছিল চোখের একটু দূরে — এভাবে কাঁদে না, বাছা, বলছিল ফুলগুলা পাখিগুলা —
বারোমাস বিপণিবিলাস
দুর্গাপূজা বা বড়দিনের উৎসবগুলো তো প্রত্যেক বছরই দেখি। দূর থেকে দেখি, কাছে যেয়েও দেখি। ক্রিসম্যাসের কয়্যার শুনতে গেছি ভোরবেলা চার্চে, ফের সন্ধ্যায় গেছি আলোকসজ্জার হাতছানিতে। দুর্গাপূজায় সরস্বতীপূজায় মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরেছি। জীবন্ত দেবীদের সাজসজ্জা, ঘাম ও পার্ফিয়্যুম, তাদের মুখনিঃসৃত পিয়ানোনিন্দিত কুজন ও কলস্বর। সবকিছু ছাপিয়ে যে-জিনিশটা দ্রষ্টব্য তা হচ্ছে ফেস্টিভিটি। বিচিত্র উৎসব-অ্যাক্টিভিটি। মিউজিকবাদ্যি। ঈদে এই জিনিশটাই মিসিং। পারস্য অথবা আরব্য ঈদের খবর জানি না, আমাদের দেশগেরামে ঈদের অ্যাক্টিভিটি বিশেষ কিছুই নাই। কিংবা আগে একাধটু উৎসবহুল্লোড় যা ছিল ঈদের সময়কার, মেলা বা ষাঁড়ের লড়াই বা সরালি মুর্গার লড়াই ইত্যাদি, কুস্তি বা বলিখেলা বা ঘুড়ি ওড়ানো, এখন তা-ও উধাও। উৎসবের আমেজ বলতে ঈদে শুধুই কেনাকাটা। কাপড়চোপড় এক ঈদে, আরেকটায় গরুছাগলভেড়া। তারপর ঈদের দিনের সকালবেলায় নামাজ সেরে এসে একঘেয়ে খাওয়াদাওয়া। আড়াই থেকে তিন-সাড়েতিন ঘণ্টার ভিতরেই ঈদ ফুড়ুৎ। এইসব বিবেচনায় রেখে বলা যায় এখনকার দিনে এদেশের জনজীবনে বারোটা মাসের প্রায় প্রত্যেকদিনেই ঈদের হাওয়া। বাজারেই দিনরাইত কাটায় এখন লোকে। কিছু-না-কিছু কিনছে সবাই সারাক্ষণই। ঈদের আলাদাত্ব রইল কই!
বিপণিবিপন্ন ভুবনশহর
দেশের শহর-বন্দর-গঞ্জ নির্বিশেষে এখন বারোমাসা আলোঝলমলে বিকিকিনির উতল-তুতল হাওয়া। ত্রস্ত ক্রেতা, ততোধিক ত্রস্ত বিক্রেতা। তাড়া, বেচাবিকির তাড়া। তাড়া, কেনাকাটির তাড়া। ঈদের বাজার। পূজাবাজার। বৈশাখবাজার। বছরব্যাপী বিবাহবাজার। ব্যস্তসমস্ত বস্ত্রবাজার, সঙ্গে হেনতেন আনুষঙ্গিক নানাকিছু। নানান সাজের নতুন দোকানপাট, নতুন ভবন, অট্টালিকা-ইমারত পেল্লায় সাইজের, বাহারের আড়ম্বর, খদ্দের-আকর্ষক বহুবিধ রঙঢঙ, নতুন দিনের নতুন শপিংম্যল। দেখতে দেখতে এই দিলদরিয়া আদ্যোপান্ত মফস্বল শহরটা কোন ফাঁকে-যে হয়ে উঠল অমন সুপারমার্কেটের নগরী! অবিশ্বাস্য লাগে, নিজের শহর নিজের কাছে অচিন-অচিন ঠেকে। আহা, আমার শৈশবের শাহেনশা শহর! আমার স্মৃতির দ্যুতিস্নিগ্ধ শহর! আহা আমার মফস্বলগন্ধা বাবা শা’জলালের দেশ শ্রীহট্ট পুণ্যিমৃত্তিকা! আমার শ্রীচৈতন্যখণ্ড!
অথচ আমার ছেলেবেলায় কড়ে-গোনা গুটিকয় মাত্র বস্ত্রবিপণী ছিল : হাসন মার্কেট, বক্স ম্যানশন, লন্ডন ম্যানশন, সবুজ বিপণী, হকার্স মার্কেট, আম্বরখানার কাপড়ের গদি ও মহাজনপট্টির বস্ত্রাদি বিক্রির বনেদি গদিগুলো। এর অনেক পরে, আমাদের চোখের সামনে, গড়ে উঠেছে মধুবন বা কাজী ম্যানশন বা সিলেট প্লাজা ইত্যাদি। এখন তো সীমাসংখ্যা নাই, এত এত বিলাসব্যসনের ব্যাবসালয়! তখন ওই সীমিত পরিসরে কেনাকাটা হতো কতই-না আনন্দে ও আরামে! আর এখন? হাহ্! সবাই কেবল টেক্কা দিয়ে চলেছে এ-ওকে, সে-তাকে। টেক্কা দেয়ার হিংস্র আনন্দে আবিল সবাই, হিংসানন্দে বেহুঁশ হয়ে, কিনছে আর কিনছে। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না ফিরে। কেউ জিতছে, কেউ হারছে। সুপারমার্কেটের বহুতল শীর্ষে বসে এক ভূত, দৈত্য এক অতিকায়, কেবল অট্ট হেসে চলেছে।
তারপর এই বৃষ্টি এল। কত সাধনার ধন, ওগো বরিষা আমার, তুমি আমায় ভেজায়ে দিয়া যাও আমুণ্ডুনোখাগ্র। এই লিলুয়া বাজারের দেশে, এই বারোভাজা হুড়োহুড়ির মরশুমে, আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বিমূঢ় দাঁড়িয়ে আছি। ভিজি আমর্ম আমি, ভিজুক শহর আমার, ভিজুক ভিজুক এই বারোমাসী বিলাসবাজার …
শাড়িবিতানের বিক্রয়-সহায়িকারা
শাড়ির দোকানে কাজ করেন যে-মেয়েরা, এই শহরে, তাদেরকে দেখে ফের সাহস করে বেঁচে থাকবার প্রেরণা পাই ফিরে। ব্যাপারটা আমি ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারব না, জানি, কিন্তু অল্পকথায় একটুকুন বলার কোশেশ করি এখানে। কেউ লক্ষ করেছেন কি, বিক্রয়-সহায়িকা হিশেবে কর্মরত বস্ত্রদোকানের মেয়েদের বেশিরভাগের পারিবারিক পর্যুদস্ত মমতাকারুণ্যভরা চিত্র ফুটে ওঠে তাদের চেহারায়, চোখে ও অবয়বে? এ-রকম মনে হয়েছে আমার, যখনই গিয়েছি কিনাকাটি কিংবা দেখাদেখি করতে কোনো শাড়িবিতানে। এটা ভারি ভালো লাগে যে, এই মেয়েরা আরও অনেক পেশাজীবীদের মতো অহেতু মূষিক হয়ে ময়ূরডাঁট মেরে চলেন না, মানে তারা আলগা স্মার্টনেস্ প্রদর্শনের ধার ধারেন না, আপন সহজিয়ানা স্বাভাবিকতা তারা খামাখা লুকাতে ব্যগ্র নন। ভান ও ভনিতা তাদের চলাফেরায়, অন্তত কর্মস্থলাঞ্চলে তাদের হাঁটাচলায়, দেখা যায় না তেমন। যখন ঝলমলানো বস্ত্রমণ্ডপের সুরম্য স্নিগ্ধবর্ণিল শাড়িদোকানে যাই, এটা-ওটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি আর প্রাইসট্যাগ নাড়াচাড়া করি, এগিয়ে আসেন সেই বিক্রয়-সহায়িকা মেয়েরা। তাদের কথায় থাকে নরম ও নির্জন ভদ্রতা, আলতো মোমমৃদু উচ্চারণ, খুব অন্তর-স্বস্তিকর ও ঘরোয়া তাদের উপস্থিতি। মোটেও উত্তেজক ঔদ্ধত্য দেখি নাই কখনো, যদিও অন্য অনেক পেশার পুরুষ ও নারীদের মধ্যে একপ্রকার উত্তেজক (অথবা তথাকথিত উত্তেজক, বলা ভালো) ঔদ্ধত্য সুলভ, বরং সস্নেহ সহায়তাভাবাপন্ন স্বর থাকে এই বিক্রয়-সহায়িকা মানুষগুলোর মধ্যে। এটা শুধু এই সীমান্তশহরেই নয়, দেখেছি রানীর শহরেও, মানে রাজধানীতেও, শৈলশহরেও পেয়েছি সেই একই অনুভূতিচিত্র, সৈকতশহরেও তথৈবচ। যদিও এই সেলসপার্সনদের মধ্যে, বিশেষত পোশাকদোকানের, চমৎকার পেশাদারিতা আমার ভালো লাগে। এ নয় সেইসব লুটেরা মুঠোফোনকোম্প্যানির ঝাঁ-চকচকে কাস্টোমার-কেয়ার পরিষেবা, এ একেবারেই ভিন্ন, এ হলো প্রশিক্ষণের উর্ধ্ব স্বভাব-সহজাত অন্তরাচরণ মানুষের। আবার, স্টোরির আদার-সাইড দেখলে, এটাকে পেশাদারিত্ব বলে গ্লোরিফাই করা কি ন্যায়সঙ্গত হলো? কত টাকা মাসোহারা মাইনে পান এরা? আমি বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, চিত্র অত্যাশ্চর্য, অতি সামান্য — অন্তত আমাদের মতো অনেক কুষ্মাণ্ডের মাসব্যাপী আকামের পর লভ্য পয়্সাপাতির তুলনায় সামান্য তো বটেই — তাদের মজুরিগ্র্যাফ অন্যায্যভাবেই ক্ষীণতনু। অবাক হয়ে ভেবেছি, এইটুকু পয়সায় এরা তাদের সংসারে একটুখানি অবদান রাখেন — সেই তৃপ্তিই কী তাদের চেহারায় ওঠে ফুটে? এবং সেই কিংকর্তব্য অসহায়তা? এত-যে ভাবছি আমি, সমস্তই তো কাল্পনিক। ওদের কারো সঙ্গে একবার কথা বলে দেখা দরকার, কেন তারা এত অল্প টাকায় এই পরিহাসভরা চাকরি করেন, অন্য যে-কোনোকিছুই তো হতো অধিক অর্থকরী তাদের জন্য। তবে এই প্রশ্ন তো নিজেদেরকেও করতে পারি আমরা, কেন গোলামবৃত্তির মোহে সাধের যৌবন তামা করিতেছি কাতারে-কাতার বাপে-পুতে মিলে? এইটুকু একরত্তি মাসশেষে নগদ পরিহাস গ্রহণের তরে! একটা ব্যাপার বলে এখন যতি টানি এইখানে। সেলসপার্সন এইসব শাড়িবিপণীর মানুষদের দেখে কেন যেন তাদেরকে আমার ছোটবোন-ছোটবোন মনে হয় সবসময়। একটা কবিতার একটা লাইন আমি মেমোরাইজ করে রেখেছি বহুকাল ধরে। একটা বয়সে বেশ কবিতা ইত্যাদি পড়তাম যা-কিছুই পেতাম হাতের কাছে। এখন ওসব বালাই চুকেবুকেছে। সেলসে বিশেষ সুবিধা করে উঠবার পারি নাই। কিন্তু কখনো হঠাৎ তরঙ্গহীন পুকুরে পুঁটিমাছের টুপটুপির মতো ছলকে ওঠে বহুঅব্দ পূর্বেকার কোনো কবিতার ঠোঁটচোখভুরুচুলচিবুক। কবিতার লাইনটা শোনাই : আজ আমার সারাদিন বোন-বোন লাগছে। … এই লাইনটা আজ আবার মনে জেগে গেল কুড়ি কুড়ি বছরের ওইপার থেকে। ছোটবোনের মতোই পৃথিবীটা মায়াময়, মৃদু, কিচিরমিচিরমুখর। কবিতাটা রাখছি নিচে :
বোন-বোন
আজ আমার সারাদিন বোন-বোন লাগছে। যাদের বোন আছে আর যাদের একটিও বোন নেই, তোমাদের সাথে আমি ভাব করি। তথাপি বোন-নেইদের কাছে বোনের মর্ম বলি : আমার বোনের চোখ মনে করে আমি কত সফল হয়েছি।
আমাদের ছোটবোন ভয়গুলো প্রার্থনায় রেখে আমাদের গায়ের গন্ধ গন্ধরাজার মন্দিরে রেখে আসে। চৈত্রের খরালাগা দুপুরের মাঠধর্ম পেরিয়ে বিকেল লেগে এলে গন্ধরাজ-শিকড়পল্লব যথারীতি জলের শুশ্রূষা পেয়ে থাকে।
কত বোন নারী হল, আমার একটি বোন আজও বোন হয়ে আছে।
- জাফর আহমদ রাশেদ । যজ্ঞযাত্রাকালে । ঐতিহ্য ২০০১ ঢাকা
পকেট নোটবুক, বখ্রাঈদের ভুক্তি
দিন ফুরাল। সন্ধ্যার আজান হলো। বছরের দ্বিতীয় ঈদের দিন চলে গেল। বছরের শেষ ঈদ। বহুদিন ঘুরে ফের আবার আসিবে ফিরে ঈদ এ-জীবনে। কে জানে, হয়তো আসিবে না। আসুক অথবা না-আসুক, এসেছে যে, এসেছিল যারা যারা এ-জীবনে, তাদেরে কেমনে হেলা করি ভাই! ঈদ আছে কেবল আমার, কুল্লে দুইখানা, আমার তো ফুকোলাকাঁড্যারিডা বা কার্নিভ্যাল নাই। কিন্তু আমার যাহা যাহা নাই, তাহা তাহা আমি আরও বেশি করে পাই। কীরূপে, ক্যামতে, ব্যাখ্যাসমেত উদাহরণ দিতে নারাজ
উৎসব। উৎ মানে উর্ধ্ব, সব মানে সবাই। ইজ ইক্যুয়েল টু সবাই মিলে একটু হলেও উপরে ওঠা। উন্নতি। মিলিয়া সকলে। বাউলা গান বা রক-ন্-রল। অথবা উভয় একত্রে। এবং অন্যান্য। সম্ভাব্য সমস্ত, আশঙ্কার নহে কিচ্ছুটি। নিগেটিভিটি নিরুৎসাহিতকরণ, পজিটিভিটির উদ্বোধন। উৎসব, অতি সংক্ষেপে, টু মি, এ-ই। কিন্তু উৎসব নৈব চ শুধু কল্কিদম, ধোঁয়াধামে উড্ডয়ন, খোঁয়ারি নয়, নেভার হ্যাঙোভার। টু মি, সকলি, অন্যদের কথা বলতে পারব না, টু মাই মাইন্ড শুধু। অন্যের নিকট উৎসব অন্য, হতেই পারে, উৎসবসংজ্ঞার কোনো য়্যুনিফর্মিটি থাকতেই হবে এমন নয়। একেকের কাছে উৎসবধারণা একেক হইতেই পারে। এমনধারা গাড়ল আমি না যে আমার উৎসবে তোমারে ঘ্যাঁটিঘাড় ধরে আমার মতো করে পরে পার্টিসিপেট করতে দেবো। ওইরকম লোকের সাক্ষাৎ এ-জীবনে, এই নিম্ন ৩৫ উর্ধ্ব ৭০ বছরের হ্রস্ব পরমায়ুস্প্যানে, ঢের ঢের লভিয়া থাকি আমরা। মাথা ঠাণ্ডা রাখিয়া তার পুত্রকন্যারে, নেভার তারে, ভেড়াতে চেষ্টা করে যাও দলে তোমার। একজীবনের বিপ্লবী কাজ ও কর্মসূচি বলতে এইটারেই জানি আমি।
কিন্তু সবাই বলতে তুমি কি বুঝাইতে চাইলা কবি, ঠিকঠাক বুইঝলাম না। তা, কথাগুলো খুব পণ্ডিতিবিকিরণকারক তো, বোঝার কথা না। আমি সবাই বলতে আমার চেনা চারপাশের মানুষগুলোকেই মিন করিয়া থাকি। আমার পরিবারের ও তুতো-পরিবারের মানুষজন, আমার নিকট ও দূর সম্পর্কিত স্বজনগণ, আমার জাতীয়-বিজাতীয় ধর্মীয়-বিধর্মীয় বন্ধুবান্ধবগণ ও তাদের পরিবারপরিজনবর্গ, আমার মিষ্টি-কালিকুষ্টি-বিশ্বজ্ঞ-মুখ্যুসুখ্যু-সুনন্দন-ভীমদর্শন ধ্রুপদাঙ্গিক-সমকালিক সহকর্মীগণ ও তাদের অঙ্গসংগঠন, আমার প্রেম ও প্রেমের নতুন নির্বাচন, আমার নিঃশেষে-বিবাহিত বন্ধুদের পর্দানশীন শ্যালিকাগণ, আমার ফেসবুকফ্রেন্ডগণ — এ-ই তো, ছোট্ট অতীব, দুনিয়া আমার। এর বাইরে নাই আর! না, থাকবে না কেন, আছে। পুরা জাহান পড়ে আছে। সেসব আমার প্রায়োরিটি লিস্টে নাই। ছি ছি! কবি! তুমি তো বিশ্বনাগরিক হইবার পারলা না! ভাই, মাফি মাঙতে চাই। দুইস্লাইস পাকা পেঁপের নরম বুকে লেবু চিপে ব্রেকফাস্টকারী বিশ্বনাগরিক হইতে আমারে কইও না মামণি! ইটিশপিটিশ কথায় আব্বুর পোষায় না।
তা, যা বলছিলাম, আজ্ঞে। বেশ দিন ছিল আজ। রৌদ্রোচ্ছ্বল, আশাকরোজ্জ্বল। যথাস্বভাব কাটিয়াছে দিন চোখ বুঁজে, পিটপিটিয়ে, কদাচ পূর্ণনেত্রপাতে। বেশ সুন্দর, সুমহান, সৌম্য ও সুধারসালো ছিল দিনখানি। দিনভর থেকে-থেকে ম্যুভি দেখলাম, কার্টুন ম্যুভি, পিচ্চিদের সঙ্গে। বেষ্টিত ছিলাম সশব্দ, সশস্ত্র, পুত্রকন্যা দ্বারা। আমার যত কাজিনপুত্রকন্যারা। আজিব কোনো জঙ্গলের মুগলি কি টারজান একেকটা। ঊর্মি, রোহান, সায়ান, ইভান, ইফতি। বিচিত্রিত ভুবনমালিক একেকজন। প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যবহা, আলগ-আলগ, সাদৃশ্য একটাই যে তারা প্রত্যেকে কার্টুনাসক্ত। খুব মন্দ লাগে না আমারও। যত-না কার্টুন দেখি, তারচেয়ে বেশি নজর থাকে বাচ্চাগুলোর কীর্তিকলাপের দিকে। কে কেমন রিয়্যাক্ট করে, কোন দৃশ্যে উল্লসিত হয় এবং কখন কোথায় হয় বিমর্ষ, কখন মগ্ন ও কখন হৈচৈ, বিশেষ কোনো দৃশ্যে আরক্তিম হয়ে উঠছে কি না, তাদের আনন্দাওয়াজগুলোর ওয়েভল্যাংথ…এইসব লক্ষ করি। বিকেলের দিকে বিটিভিপ্রোগ্রাম দেখলাম একটা। ব্যান্ডশো। পুরনো দিনের ব্যান্ডগুলো। কতদিন পরে মেসবাহ, মনি জামান আর টিপুকে দেখলাম! ডিফ্রেন্ট টাচ, সিম্ফনি আর অবস্কিউর! ফিডব্যাকের ফুয়াদ নাসের বাবু আর লাবু রহমান, কতদিন পর! ওয়ারফেজের একটা দারুণ আমাদের সময়ের অনুভূতিবহ রকবিটের গান! আমাদের সেই দিনগুলো! আল্লা এদের বাঁচায়ে রাখুক, যেন আমরা আমাদের নাতিপুতিদের দেখায়ে যাবার পারি যে দ্যাখ তোগো নানাভাইয়ের নৃত্যনন্দিত দিনগুলোর কিয়দংশ! ঝলক দিখলা যা, ইয়ার, ও লাল মেরা!
সাঁঝের বেলা বন্ধু-সমাগমও ঘটল, সবেধন নীলমণি, নির্ধনিয়ার ধন বন্ধু মম। সপুত্রক। সমাংশ। মানে, একহাতে পুত্র ও অন্যহাতে মাংশের পলিথিনপুঁটলি নিয়ে। এইটা এতদঞ্চলের রুসম। কুরবানির মাংশ যারা-কুরবানি-দিতে-অসমর্থ ও যারা আত্মীয়বন্ধু তাদেরে বিলিয়ে দেয়া। তা, সেই স্বজনবন্ধু যত দূরেই থাকুক, তার মাংশের হিস্যা রাখা হয় আলাদা করে, এবং পৌঁছে দেয়া হয় হাঁচড়েপাঁচড়ে নদী সাঁতরে। লো রাজকন্যে, আমি নদীর তীরে থাকি। প্রিয়তমা আমার নদীটি আর-কেহ নয়, যেনতেন নদী সে না, আমাদের সেই নদীর নামটি সুরমা। আমার তিন-তিনজন বন্ধু এই কাজটা করে আসছেন স্মরণকাল ধরে, নদী সাঁতরে ঝড়েজলে, যথাক্রমে তারা (না, যথাক্রম শব্দটা এখানে এডিট করে পড়তে অনুরোধ করি, যথাক্রম প্রযুক্ত হবে না, হতে পারে না, বন্ধুতার কোনো ক্রম নেই, থাকে না, ভালোবাসায় হায়ারার্কি থাকে না) : নামগুলা না-উচ্চারিলেও মনে ধরে রাখি। বিপন্ন লাগে, বিস্ময়ে, হেন আন্তরিক স্মরণে। না, কোনো ধন্যবাদ নয়, মহাত্মন, কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন নয়, কেবল সবিস্ময় প্রেমের জয়গান, কেবলি জীবন উদযাপন। মনে এত মর্মদ্রাবী দৃশ্যগুলো ঝাপট দিয়া যায়, যে, বেঁচে থাকা হইল আমার দায় …
লেখা : জাহেদ আহমদ ।। লেখাকাল ২০১৪
… …
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS