কী হতো যদি আরও দুইটা দিন বা আরও বছর-দুই বেশি বাঁচতেন কবি নূরুল হক? নাকিকান্না আর মায়াবার্তায় কাজ নাই, জিন্দেগির পুরাটাই তিনি আমাদের হাতের তালুতে রেখে গেলেন মৃত্যুর ভিতর দিয়া, কাজেই আমরা এখন স্পষ্ট দেখতে পাবো উনার লাইফস্টাইল উনার লিভিং কেমন ছিল। উনি, আর-যা-ই-হোক-না-কেন, মণ্ডকাগজের দৈনিক পত্রিকায় কি লিটলম্যাগে বা হালের ওয়েবপোর্টালগুলায় লেখা ছাপায়া গাঙ বহায় দিতেন এমন বোধহয় তীব্র দুঃস্বপ্নেও হবার নয় তারে দিয়া। সারাজীবনে যে-ব্যক্তি তিন-চাইর পত্রিকায় ছেপেছে কি না তার কবিতা তাতেও সন্দেহ, বেঁচে থাকলে বাকি দুইদিনে বা দুই-চাইর বছরে তেরোটায় ছাপতেন ভাবার কোনো কারণ তো দেখি না। সারাজীবনে যে-ব্যক্তিরে তেরোজনেও চিনল না তারে তেরোশ’ নদীর পারের পাঠকেরা আদর করবে সহসা শেষের দুইদিনে বা আড়াই বছরে, এমন ভাবার কোনো কারণ নাই।
‘নিরন্তর’ নামে একটা কাগজ বেরোত এক-সময়, নাঈম হাসান সম্পাদিত, লেখা বাছাই থেকে শুরু করে মেকাপ-গেটাপ সব দিক দিয়াই ‘নিরন্তর’ দেখার মতো মনোরম ছিল। বোধহয় তিন-চারটা ভলিয়্যুম আছে এই পত্রিকার। বহুকাল আর বারায় না। আমি নূরুল হক নামে এই কবিকে কেবল ওই পত্রিকাতেই পেয়েছি, আর-কোথাও অনেক খোঁজাখুঁজি সত্ত্বেও পাই নাই। সুঁই খুঁজবার মতো খুঁজেছি এক-সময় এই কবিকে, যারেই জিগাইসি তিনি নূরুল হক সম্পর্কে তেমনকিসু জানাইতে পারেন নাই। ‘নিরন্তর’ পত্রিকায় আরেকজন কবি পেয়েছি যার সম্পর্কে আজও খুব বেশি কিছু জানতে পারি নাই। তিনি কাশীনাথ রায়। বহুকাল বাদে ২০২০ ফেব্রুয়ারিতে এসে নূরুল হকের কবিতাসমগ্র পেয়ে এই কবির জগজ্জীবন পুরা গ্র্যাব করবার মওকা মিলল। আগে এটুকু শুধু জানতাম যে এই কবি বাংলা সাহিত্য পড়ান, যেমন কাশীনাথ রায়ও পড়ান ইংরেজি, কিন্তু প্রায় সারাজীবনই গিয়েছে হকের কোনো প্রকাশিত কবিতাবই ছিল না — আগে এতটা ভাবি নাই। কাশীনাথ রায়ের ব্যাপারটা আজও অন্ধকারে, একদিন আলোয় আসবে, একদিন নিশ্চয় কাশীনাথ সম্পর্কে আমরা আলোকিত হব এবং সূত্রমতে সেদিন খুব দূরেও তো নয়। সেদিন দেখা যাবে এদেশের সিন্ডিকেটপাণ্ডা কাব্যবেপারিদের অনেকের লগেই উনার ইনবক্সিং হতো, অনুষ্ঠানে দেখাসাক্ষাৎও হতো, উনি সিন্ডিকেটকবিটিরে পেল্লায় সাইজের সমীহ করতেন ইত্যাদি নিউজফিড-ঘোরা গালগল্প। তবু সিন্ডিকেটসর্বস্ব কবিটি নিরিবিলি এই কবিটিরে তার পত্রিকায় বা তার ইয়ারবখশিদের মিডিয়ায় হাজির করে আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হইতে পারেন নাই। স্বীয় পোলিটিক্সে এই নিভৃতি এই নির্মোহ কবিতাচর্চা দিয়া আমাদের সিন্ডিকেটসাহিত্য অত জুত করতে পারে না।
আরেকটা কান্না আমাদের প্রায় জাতীয় বৈশিষ্ট্যের মর্যাদা পেয়ে গেছে এরই মধ্যে। কেউ মরলেই তারে নিয়া কান্নাটা কমন যে জীবদ্দশায় তারে কেউ মূল্যায়ন করল না … আহা রে … বাংলা বা উর্দু অ্যাকাডেমি কিংবা ব্যাংক-বিমা অ্যাওয়ার্ড জুটল না … এইসব বলে শেষে একটা সাধারণ শত্রুমূর্তি ইম্যাজিন করে হ্যাতেরে খিস্তি করা। কারণ এদের আর কিছুই করার নাই। এরা তাদের বাপদাদারে দেখে নাই চিনে নাই। খিস্তি মুখে নিয়া রাস্তায় জন্ম এদের। এরা খিস্তিবীর। অথচ এই ভূখণ্ডে চিরদিনই গুণীর গুণকীর্তন হয় মৃত্যুর পরে। জীবদ্দশায় কানে-তালা-লাগানো গুণকীর্তন গুণী অ্যাপ্রুভ করে না, করার কথাও নয়, তার বাপদাদাদেরে দেখেছে সে এবং যেহেতু তার বাপদাদারা তা করে নাই। জীবদ্দশায় কীর্তন আয়োজনের খর্চাপাতি গুণীকেই যোগাতে হয়। যেমন রবীন্দ্রনাথ অল্প বয়স থেকেই নিজেদের বসতভিটায় প্রিন্টিং প্রেস বসায়া ঢাকঢোল যা-কিসুই পিটাইসেন। কত পয়সাপাতি বিনিয়োগ করা লাগে জীবদ্দশায় সেলিব্রিটি হতে! তারপর ধরা যাক শামসুর রাহমান গুণী মানুষ। প্রধান কবি হইসেন জীবদ্দশায়। এই জিনিশগুলার প্রোসেস তো আমাদের জানা। কাশীনাথ রায় কিংবা নূরুল হক এই বাজারে খুব অল্পই বিক্রিবাট্টা করসেন, খরিদ্দারও অতটা না তারা।
বাংলাদেশে জীবদ্দশায় কাউরে অ্যাওয়ার্ড দেয়া বা কারো গুণকীর্তন করা ধান্দা ছাড়া আর কিছু হতে পারে এতে বাংলাদেশ নামের হারাধনের একটিমাত্র গণতন্ত্রদল আওয়ামী লীগ তথা আপনার-আমার মতো সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ বিশ্বাস করে না। বাংলাদেশে শ্রেষ্ঠ কবি বর্তমানে মুহম্মদ নূরুল হুদা, নানা সাইজের কবিরা তারে সেই শিরোপা দিসে সম্মিলিতভাবে। এর মাস-দুয়েক আগে শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন হাবীবুল্লাহ সিরাজী, ইন্তেকালের পরে কেউ টুঁ-শব্দও করে না উনারে নিয়া। প্যান্ডেমিকটা পারাইতে পারলে শ্রেষ্ঠহুদার কামরায় যায়া আগের শ্রেষ্ঠের নামে গিবত গাইবে আমাদের চল্লিশোর্ধ্ব তরুণ কবিসাইত্যিকেরা। কাজেই, আমরা সাধারণ জনতা, আমরা সবাই আওয়ামী লীগ করি, আমরা ধান্দাবাজি করি না পারতপক্ষে, আমরা মউতের পরেই নির্ধারণ করি কে ভালো ছিল কে খারাপ।
মৃত্যু খুব দরকারি। ব্যক্তিমূল্যায়নের বেলায়, পরিপূর্ণ বিবেচনায় ব্যক্তিমূল্য নিরূপণের বেলায়, মৃত্যু খুবই এসেনশিয়্যাল। অনেক আগে একটা ছায়াছবি দেখসিলাম, ‘দেজা ভ্যু’ বোধহয় ছায়াছবিটির নাম, সেখানে ডেনজেল ওয়াশিংটনের মুখবাহিত সংলাপে এ-রকম কিছু কথা জানতে পারসিলাম। শুধু মরণের পরেই একটা মানুষকে ইন-অ্যা-নাটশেল দেখতে পারি আমরা, তার আগে পারি না। পারা সম্ভব নয়, পারা প্রাকৃতিক নয়, মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত একবাক্যে একলাইনে একরেখায় কাউরে খারাপ বা ভালো বলা আদৌ সম্ভব নয়। কাজেই, জীবনের অস্তিত্ব মূল্যায়নের জন্য মরণ দরকারি। সিনেমায় পাওয়া এই কথাগুলা আমি একযুগেরও অধিক হয়ে গেলেও মনে রাখতে পারসি।
মৃত্যুর পরেই খিয়াল করতেসি নূরুল হক প্রথম কবিতাবই ছাপসেন ২০০৭ সালে। এরপর, পরপর, ২০১০, ২০১২, ২০১৪ ও ২০১৫। কবিতাসমগ্র ২০২০। মনে রাখতে হবে এই কবির জন্মসাল ১৯৪৪। এর আগে ‘নির্জনতম কবি’ বিশেষণে খ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশ নিজের কবিতাবই নিজে উদ্যোগ নিয়া ছাপসেন, এক নয় দুই নয় তিন-চার পর্যন্ত, মরার আগে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ অব্দি; সেদিক থেকে এই কবি, নূরুল হক, কী বলব, বলতেই হবে এমনকিছু ধরাবান্ধা নাই। কিন্তু ৭৬ বছরব্যাপী জীবনের প্রায় ৬০ পার করে একজন কবি নিজের অভিষেক কবিতাবই রিলিজ করা যায় সিদ্ধান্তটি নিতেসেন, এইটা মার্ক করে রাখবার মতো। তৎপূর্বে এই কবিরে কেউ টলাইতে পারে নাই, রিচই করতে পারে নাই ইনডিড।
আমাদের এইখানে অনর্থ (অর্থাগম নাই অর্থে) খাতের কায়কারবার হিশেবে কবিতাসাহিত্যশিল্পকলা চালু থাকে ব্যক্তি-উদযোগে। এর চাক্কা চালু রাখবার কোনো প্রতিষ্ঠান নাই। বাংলা অ্যাকাডেমি? শিল্পকলা অ্যাকাডেমি? কিংবা শিশু অ্যাকাডেমি? এইগুলা আছে তাদের ধান্দায় ব্যস্ত। জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য প্রভৃতি ইশ্যুতে এই প্রতিষ্ঠানগুলার কোনো মস্তকব্যথা নাই। দেশের মানুষেরও এইসব প্রতিষ্ঠান নিয়া কারো কোনো বক্তব্য নাই। পয়সা যা কামায়, ট্যাক্স দ্যায়, সেই ট্যাক্সের পয়সায় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলা কারা চালায় কী করে না বইয়া বইয়া মাছি মারে এইসব জনগণ অত পুঁছতাছ করে না। বাঁচোয়া। কাজেই জীবদ্দশায় কে কবি আর কে নয় তা জানা অ্যাকাডেমি-ফ্যাকাডেমির হেডেইক না।
ব্যক্তির জীবদ্দশায় ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করবে প্রতিষ্ঠান। নূরুল হকের কবিতা পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়া আসা থেকে শুরু করে তার কাজের গতিবিধি নিরিখ করবে এবং তদনুযায়ী থিসিস প্রকাশ ও প্রচার করবে প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি নয়। ব্যক্তির কাজ শুরু হয় মৃত্যুর পরে। ব্যক্তি স্মৃতিচারণ করে। এই দেশে চিরকালই তা হয়ে এসেছে। এই জিনিশ নিয়া আজও মরাকান্না হয় কেন, বুঝতে পারি না। ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় তার কাজকর্মের উপাদান সংগ্রহপূর্বক জনস্বার্থে বিলানো বা কাজে লাগানো সংগঠিত শক্তিসামর্থ্যের তথা প্রতিষ্ঠানের কাজ। ব্যক্তি আমার রয়েছে কত-না খেলাধুলা, আছে বলদ বন্ধুদের বই নিয়া শোর মাচানো, বলদ সংঘের ষণ্ডা হিশেবে নিজেরে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা। আমার কী ঠেকা পড়সে নূরুল হক নিয়া মাতামাতি করবার? আমি নিজের লেখাটাই লিখি ও প্রকাশ করি নিজের খেয়ে নিজের পয়সায় বা বাপমায়ের, অন্যের বিচার করবার ভার আমি তো পয়সা খর্চে পারব না। আমি লেখক হই বা না, আমার এইখানে একটাই কাজ এবং সেইটা হচ্ছে পড়া। আমি লেখক হলেও বা না-হলেও অন্যের লেখার আমি পাঠক মাত্র। স্বতঃপ্রণোদিত সমালোচক হব কি না তা নিয়া আমারে ব্লেইম করবা না। আমি যার দ্বারা উপকৃত হই তারে নিয়া হাটে মেলা বসাই না, বাপমায়ের মতো গোপন রাখি, যার স্তন চুষি তারে নিয়া স্তব গাই না। যারে একফোঁটাও দরকার নাই তারে নিয়া আলোচনা করে আপদ বিদায় করি নগদে, যেন এই বলদ নিয়া আর দোসরা ভাবতে না হয়। আমি চিরদিনই তা-ই। বিদেশে সমালোচক আছে, ক্রিটিক আছে, কেননা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলা সচল। আমাদের এইখানে প্রত্যেকটা দৈনিক পত্রিকা তাদের নিজেদের ছেলেমেয়ে-বউবান্ধবীদের রিভিয়্যু করেই জিন্দেগি পার করে, মালপানি কামায়, এইটাই আমাদের ল্যান্ডের বৈশিষ্ট্য। চিরদিনই তা-ই। আমাদের এইখানে ব্যাঙের মতো বর্ষাকালীন আওয়াজের ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রী প্রকাশনীগুলা লেখকদের গাঁট কেটে ভিয়্যেকল-বিল্ডিং বাগায়। চিরদিনই তা-ই। আর এইটা এমন কান্নাকাটির কিছুও না। কাজকাম করা যার রক্তদানায়, তার বহিরঙ্গী কিছুর অভাবে কিছুই আটকায় না।
আগে নূরুল হকের গোটা-পঁচিশেক কবিতা ছিল আমার পাঠাভিজ্ঞতায়, ‘নিরন্তর’ ইত্যাদি কাগজবাহিত, রিসেন্টলি ২০২০ ফেব্রুয়ারিতে একলগে উনার কবিতাসমগ্র ‘চৈতন্য’ নামে একটা প্রকাশনীর ব্যানারে বেরোনোয় অভিজ্ঞতার বহরটা খানিক বেড়েছে। একেবারে আঙুলে না-গুনলেও অনুমান চার-সাড়েচারশ কবিতা আছে অ্যান্থোলোজিটায়। ছিপছিপা ছোট ছোট গতরেরই কবিতা নূরুল হকের বেশিরভাগ। সরোজ মোস্তফা ‘যে কথা আগে বলতে হবে’ শীর্ষক একটা প্রাক-বক্তব্য লিখেছেন বইটায়, যেমন হয় এই কিসিমের ভূমিকাগুলা তা থেকে এইটা আলাদা কিছু নয়, নূরুল হকের কবিতায় এই-সেই বিবিধ গুণ আছে যা থাকতে হয় ‘বড় কবি’-র কবিতায় ইত্যাদি বলা হয়েছে; যেইটা বলা দরকার এইখানে তা এ-ই যে, এই কবিতাসমগ্র প্রকাশের পেছনে মেহনতটুকু করেছেন মূলত সরোজ মোস্তফা, যা কবি নিজেও বলতেসেন দেখলাম কোনো-এক ইউটিউবকথিকায়, আর এই কারণে কবি সরোজ মোস্তফাকে আমরা মনে রাখব, দোয়া করব আল্লা যেন উনারে এমন কাজ করার আরও তৌফিক এনায়েৎ করে।
এই নিবন্ধে নূরুল হকের কবিতা নিয়া একটা বাক্যও বলি নাই। বলব না। কারণ, না, কারণও বলব না। পাঠকের যদি ইচ্ছে হয় নূরুল হকের কবিতাসমগ্র খরিদ করে নেবেন, অথবা কারো কাছ থেকে এনে পড়বেন, বই খরিদ করার উকালতি বা দালালি বাংলাদেশে করার দরকার নাই, একটা কানাপয়সাও তো বইকার পাবে না কনফার্ম, তাইলে কেন বই কিনবেন? তবু যদি কেউ খরিদ করতে চান, ৩০৪ পৃষ্ঠার উন্নত কাগজে ছাপানো বই গাত্রধার্য মূল্য ৫৫০ বিডিটি, মন্দ হবে না। আই ইনসিস্ট, নূরুল হকের কবিতা ট্রাই করে দেখেন। পুরা ফ্যামিলি মিলে কবিতা পড়ার দিন হয়তো-বা আসতে পারে এমন অকল্পনীয় উদ্ভট আশা ব্যক্ত করা যায় যে-কয়জন অঙ্গুলিমেয় কবির সাক্ষাৎ পেয়ে, বাংলাদেশের সাহিত্যে নূরুল হক তেমনই এক কবি। বিলিভ মি। একফোঁটা ব্যাটাগিরি নাই উনার কবিতায়, এককাত্রা পাণ্ডামি নাই, আল্লার দোহাই আমায় বিশ্বাস করেন।
কবিতা পড়ে কেউ যদি নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে চান তো করবেন, না চাইলে নাই, নূরুল হকের কবিতা আপনাকে বাকি জিন্দেগিভরা বার-কয়েক ডাকবে চুপচাপ অবকাশের দুপুরবেলায় বা যাতনা লাঘবের যামিনীতে। দেখবেন, কবিতায় কী নিরিবিলিতার অবিরল নৃত্য! দোহাই, ২০০৭-এ বই ছাপাবার অপরাধে বেচারারে আবার নিজের দশকের কবি ঠাউরায়েন না। আপনার-আমার লগে এই লোক একপাতে-একাসনে বসতে চায় নাই, দশকদরবারে দেখানোপনায় নিজেরে শামিল করে নাই, নিশ্চয় কবির সচেতন সিদ্ধান্ত এইটা। বান্দ্রামির সীমা রাখতে হবে এমন আব্দার বান্দরের কাছে করা অবশ্যই অন্যায়, বান্দর তো বান্দ্রামি করবেই, কিন্তু আপনার কাছে নিশ্চয় করতে পারি আব্দার। এমনও যদি হয় যে নূরুল হক আপনারে মহাকবি হিশেবে তোয়াজ করতেন, চুপচাপ স্বভাবের লোকটার মরণের পরে এইসব আগাচৌ গুলগপ্পো মেরে নিজেরে বেখাপ্পা বানায়েন না। সারাজীবন কবিতা বানায়া মারা যাবার পরে এই বিচিরিক্ত বলদবৃন্দের ফাইজলামি-ফিচলামি দেখে নেত্রকোনার বর্ষাভেজা মাটির তলায় নূরুল হক নিশ্চয় নারদ নারদ জপতেসেন।
নূরুল হক বাঙলায়, বাংলা ভাষায়, বিলাসদ্রব্যের মোড়ক বানান নাই কবিতারে। এই জিনিশটা বাংলার এবং বিশ্বের হরেদরে হ্যাংলা নায়কোচিত কবিতাপার্ফর্মাররা হামেশা করে থাকেন। নূরুল হক কবিতাকলায় তাৎপর্যপূর্ণ অনেক কাজ করসেন, এই কথাটার টেস্টিমোনি হিশেবে ২০২০ ফেব্রুয়ারিতে বেরোনো নূরুল হকের কবিতাসমগ্র রইল। বইটা বাইর হবার মাস পারাবার আগেই বিপর্যস্ত হয়ে যায় পৃথিবী প্যান্ডেমিকে। যে-একটুখানি নিজের কবিসিদ্ধি দেখে যাবার সম্ভাবনা হাজির হয়েছিল সমগ্র কবিতা পাঠকের হাতনাগালে আসবার পরে এই নিভৃত কবির, অন্তত চর্মচক্ষে নিজের কয়েকজন পাঠকের দুই-চাইরটা পাঠপ্রতিক্রিয়া পাবার সুযোগটা পাইতেন হয়তো পরিস্থিতি পূর্ববৎ নর্ম্যাল থাকলে, সেইটাও ঘটল না। আমরা যারা নূরুল হকের সমগ্র কবিতার বইটা হাতে নেব, সন্দেহাতীত স্বীকার করব যে এই কবির উজ্জীবন/পুনরুজ্জীবন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আমরা নূরুল হকের কবিতার উদযাপন, উজ্জীবন ও সঞ্জীবন কামনা করছি।
লেখা / জাহেদ আহমদ
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS