কবি নূরুল হক : জল যেন তোমার চোখ || চরু হক

কবি নূরুল হক : জল যেন তোমার চোখ || চরু হক

চাঁদ এখনো ওঠেনি
তাই চেনা যায় না
তবু কেমন যেন মনে পড়ে
পুরোনো দিনের কথা।

ট্রেনটা ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে দূর-থেকে-ভেসে-আসা করুণ কান্নার মতো বিউগলের সুর।

কবি নূরুল হক। নিজ জেলা নেত্রকোনার বালালী গ্রামের পবিত্র ভূমিতে চিরশান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। “ঝরা পাতা আর মরা বাতাসের গভীর বিস্তীর্ণ পথে পবিত্র মৃত্যুর চিহ্ন” রচিত হতে থাকে হাওরের হাহাকারভরা বাতাসে।

তিনি আমার বাবা। আধুনিক বাংলা কবিতার সবচেয়ে গহীন কাব্যসাধুর নাম। ২০২১ সালের ২২ জুলাই করোনার নিষ্ঠুর করাল গ্রাসে না-ফেরার গহীনতম দেশে চলে গেছেন তিনি। আর পেছনে রেখে গেছেন সজল মেঘে ভেজা তার ভালোবাসার পৃথিবী, চেনামুখ, দোয়েলের ডানা, পৈশাচিক শহরের পথহারা কাক আর প্রিয় মা-জননীর নাম। হায়! ফেরা আর হবে না কখনো এই মনুষ্যজন্মে, হয়তোবা, তবে সত্যিই কি আর কখনো ফিরবেন না তিনি? ধুলোর ডাকঘরে পাঠানো তার অন্তরতম ডাক পাঠকের রক্তদানায় সূতীব্র আঘাতে আঘাতে ফোটাবে না রক্তচন্দন?

হাওরের গ্রাম এবং গ্রামবাসীর জীবনে মিশে গেছেন তিনি আজ, যে-গ্রামের মিষ্টিরাত মিশে গেছে চাঁদের সীমানায় —

তোমার রাত একটি চাঁদে গিয়ে মিশেছে
বাতাসে মিশেছে হাওরের গ্রাম
                        এবং গ্রামবাসীর জীবন।
এতদূরের স্বপ্ন এখানকার স্বচ্ছজলে
.                                 খণ্ডবিখণ্ড হয়
দেখে মোটেই বোঝা যায় না
এগুলো বর্তমান ভবিষ্যৎ আর
.                      অতীতের ভাঙচুর,
আর জল যেন তোমার চোখ।
(স্পর্শ / নূরুল হক)

তাঁর কণ্ঠে বলতে শুনেছি বহুবার —

আমি তো মনে করি, কবিতা কোনো খেলা নয়, নয় কোনো পরীক্ষানিরীক্ষাও। বিনোদন তো নয়ই। কবিতা হলো জীবন। জীবন নিয়ে তো আর মস্করা করা চলে না। চলে না কোনো হেলাফেলাও। ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ তাঁর এক শিষ্যকে বলেছিলেন, “যখন বাদ্যযন্ত্রটা ধরবে, লাঠিয়ালের লাঠির মতো ধরবে না,অন্ধের যষ্ঠির মতো ধরবে।” কবিতা লেখার বেলায়ও এ-কথাই প্রযোজ্য। অথচ আমরা তো এখন কবিতায় লাঠিয়ালের লাঠিখেলা দেখাতে পছন্দ করি। খেলা শেষে লাঠি ফেলে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাই, কিন্তু অন্ধের মতো লাঠির সঙ্গে খোদ জীবনকে জড়িয়ে রাখি না।

এবং তাঁর  কণ্ঠনিঃসৃত এ-ভাবনা তাঁর জীবনকে সঞ্জীবনী সুধাধারা ঢেলে এমনই প্রাণরসে সিক্ত করে রেখেছিল আজীবন যে, অন্য কোনো দিকে আর চাইতে হয়নি।

হঠাৎ করেই
      রূপার আগুন
জ্বলে উঠেছে শূন্যে,
আকাশের বুকে ঢুকে পড়েছে
ইন্দ্রলোকের
.       কলজেধারা।
(দোলপূর্ণিমা / নূরুল হক)

দিনটি ছিল ১৯৪৪ সালের ২৫ নভেম্বর। ইমাম আবু সাইদ মুনশির ঘর থেকে ভেসে আসলো আজানের সুর। ষোলোটি সন্তান জগতে আবির্ভাবের পরপরই না-ফেরার দেশে চলে গেছে। একটি সন্তানকেও তারা ধরে রাখতে পারেননি। অসীম যন্ত্রণা বুকে নিয়ে দিন গুনছিলেন মজিদা খাতুন। ভয় আর আতঙ্কে গুনে যাচ্ছেন দীর্ঘ নয়টি মাসের প্রতিটি দিন। শেষরাতে আবু সাইদ মুনশি স্বপ্নে দেখেন পশ্চিমাকাশে জোড়া চাঁদ।

বাবা মায়ের চোখে খুশির আনন্দধারা বইয়ে এক মাহেন্দ্রক্ষণে জগতের আলোয় চোখ মেললেন শিশু নূরুল হক। শয়তানের বদনজর যাতে না-পড়ে, বাবা তাড়াতাড়ি শিশুপুত্রের কান ফুটো করে দিলেন। পরবর্তীতে জন্ম নিলেন আরো এক পুত্রসন্তান। তার জন্যও একই ব্যবস্থা। সৌভাগ্যক্রমে যমদূতের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে গেলেন দুই ভাইই।

অতি আদরের এই সন্তান মা-বাবার চোখের মণি হয়ে বেড়ে ওঠে। সাধারণ গৃহস্থ পরিবার। খুব-একটা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য তো নেই, তবু বড় সন্তানের জন্য  সবচেয়ে স্বাদু খাবারটা, গোটা রসুন দিয়ে বাচ্চা মুরগির সালুন রেঁধে পাশে বসে না-খাওয়াতে পারলে মায়ের মনে যেন তৃপ্তি মেলে না কোনোমতেই। বাবা-মা তাকে আদর করে ডাকতেন নূর মিয়া।

শিশু নূর মিয়া প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন পাড়াপ্রতিবেশী সকলের কাছে। বাবা মসজিদের ইমাম হওয়ায় বাবার কাছ থেকে শেখেন কোরান তেলাওয়াত। সেই কোরান তেলাওয়াত তার সুরেলা গলায় শুনতে ভালোবাসতেন আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি সবাই।

তৈরি থেকো
.        আমি ফিরে আসব পথে
হাতের তালুতে করে
.                   নিয়ে আসব
অচেনা পাখির ডাক
জগত-জনের জন্য
যে পাখির ঠোঁটটি চিকণ।
আর
আকাশে ফুটে উঠবে
              একটি নতুন তারা
অমল নিভৃতে।
ঘুমঘোর থেকে
.         জেগে উঠব
.                সঙ্গে নিয়ে
অদেখা কোমল যত দিন।
(জগত-জনের জন্য / নূরুল হক)

নূরুল হকের অনেকগুলো পরিচয় আছে। তিনি একজন অধ্যাপক, কবি, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, এককালের বামপন্থী সংগঠক, সংগীতবোদ্ধা, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তাঁর প্রথম এবং প্রধান পরিচয় তিনি একজন কবি। এবং তাঁর শেষ পরিচয়ও কবি। তিনি স্বপ্নে কবি ছিলেন, তিনি জাগরণে কবি ছিলেন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তিনি কবি ছিলেন। কবি ছিলেন সর্বোতভাবে। তিনি সমস্ত শরীরে, সত্তায় কবিতাকে বহন করতেন। বহন করতেন রক্তের ধারায়। তাই, “আমার সমস্ত সত্তাটাই কবিতা দিয়ে তৈরি। কবিতার বাইরে আমার আর কোনো সত্তা নাই।” — এ-ধরনের বাক্য কবি নূরুল হকের কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হওয়ায় আমরা মোটেই চমকে যাই না।

আবার একই পথরেখা ধরে তিনি বলেন, “কবিতা হলো সমস্ত মানুষের সত্তার পরিচয়। কবিতা হলো মহাজগতের মাতৃভাষা। ফলে মহাজগৎ থেকে সৃষ্ট সকল অণু পরমাণু বস্তুকণাতেই কবিতা থাকে। এ সেই মাতৃভাষা, যে-ভাষায় আমরা নিরন্তর আন্দোলিত হতে পারি, মহাজগতকে পাঠ করতে পারি হৃৎচক্ষু উন্মীলিত করে।”

বিস্তীর্ণ তলার হাওরের প্রান্তিক গ্রাম বালালী।  তখন যোগাযোগব্যবস্থা অনুন্নত ছিল, বৃষ্টিবাদলও বেশি হতো, বর্ষাও ছিল দীর্ঘস্থায়ী। ফলে বর্ষায় তলার হাওর একটা বিশাল সমুদ্রের মতো হয়ে যেত। বাড়ির কাছেই ছিল নদী। একটি বালুই, আরেকটি মগড়া। এই অকৃপণ নিসর্গের সাহচর্য তাঁকে কবি হওয়ার পেছনে অনেকখানিই ইন্ধন জুগিয়েছে। সাথে যুক্ত হয় লোকসাহিত্যের এক মণিময় ভাণ্ডার।  তাঁরই ভাষায় —

“কখন যে আমি ছেলেবেলায় কবিতা লেখার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলাম তা আজ আর মনে নেই। শুধু এটুকু জানি যে, সেই সুদূর শৈশবেই কবিতা লেখা আমার স্বাভাবিক জীবনধারার অন্তর্গত হয়ে গিয়েছিল। আমার জন্ম গ্রামে। নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চলে। বিস্তৃত হাওর সেই এলাকাটিকে ঘিরে রেখেছে। সেই হাওর আর আকাশভরা জনপদে রাত্রিদিন লোকসাহিত্যের নানা আঙ্গিকে আসর লেগেই থাকত। বাতাস ভরে থাকত সারিগান, জারিগান, কবিগান, কীর্তন, বাঊলগান, ঘাটুগান, মেয়েলি গীত, পুঁথিপাঠ, যাত্রাগান এবং গল্প-কথকতায়। বিশেষত জালাল উদ্দিন খাঁ, উকিল মুনশি, অন্ধ খুরশিদ, আব্দুস সাত্তার প্রমুখ বাঊল সাধকদের গান চারদিকে জ্যোৎস্নাধারার মতো ভেসে বেড়াত। আমার গৃ্হশিক্ষক চারণকবি রুকন উদ্দিনের কবিতায়ও মাটির মানুষের সুখদুঃখের কথা বেজে উঠত স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তাঁর বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ‘পেটের কাহিনী’ কবিতা থেকে কয়েকটি পঙক্তি শুনিয়ে এর ধরনটা বলছি :

আলেম ফাজেল যত সংসারমাঝার
সবাই করতেছে ভাই পেটের কারবার।
হায় পেট, হায় পেট, হায় মাইল্যা পেট
তোমার লাগিয়া কত করব কেট কেট

তোমার কারণে আমার রথ পড়িয়া যায়
জীবন শেষ করে দিলাম আর কত কুলায়।
(ক্ষুধা / রুকন উদ্দিন)

জ্ঞানতাপস যতীন সরকারও তাঁর বিখ্যাত ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’ বইয়ে উদ্ধৃত করেছেন এই গৃ্হশিক্ষকের কবিতার পঙক্তি —

বুঝ দিবার জিনিস নয় বুঝ দিব তারে
ক্ষুধা লাগলে দারুণ পেট বাঘের চিৎকার মারে।”

এদিকে বাবা আবু সাইদ মুনসি একজন সাধারণ কৃষক এবং মসজিদের ইমাম হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন যথেষ্ট উদার মানসলোকের অধিকারী। কাব্যিক অনুরাগ তাঁর মধ্যে নিহিত ছিল। পুঁথিসাহিত্য পড়তে ভালোবাসতেন।  দরদি গলার এই পুঁথিপাঠ শিশু নূরুল হককে মালার মতো পেঁচিয়ে রাখে। পিতার সাহিত্যানুরাগ, গৃ্হশিক্ষক রুকনউদ্দিনের এইসব কাদামাটির ভাষায় লেখা কবিতা এবং চারপাশের সকল উপাদান কবিকে প্রভাবিত করে এবং এভাবেই তিনি কবিতা লেখার ব্রত হৃদয়ে ধারণ করে নেন।  আর এ-কারণেই জীবনের পড়ন্ত বেলায়ও এসে বলতে পারেন অবলীলায় —

“কবিতা লিখতে হয় জীবনমান সমৃদ্ধ করার জন্য। দুঃখের বা বেদনার কবিতা লিখতে হলেও অন্তর পরিপুষ্ট রাখতে হয়। অন্তর পরিপুষ্ট থাকলেই দুঃখে বা বেদনায় বা ঘৃণার সঙ্গে পরিপূর্ণ সাড়া দেওয়া সম্ভব। আমার মতে পরিপূর্ণভাবে সাড়া দেওয়ার অবস্থাটাই হলো কবিতা লেখার মানসিক অবস্থা। আংশিক সাড়া দিয়ে কোনো কবিতা লেখা যায় না। আর পরিপুষ্ট অন্তরের লোকজন যত দারিদ্র্যে থাকুন তাদের বেঁচে থাকার প্রকৃত মানটির অন্যদের চেয়ে অনেক উপরে অবস্থান। এটাকেই আমি বলি কবিতা লেখার প্রাপ্তি বা পুরস্কার। সেই প্রাপ্তি বা পুরস্কার যিনি না পান তিনি বাইরের বা অন্যের পুরস্কারের জন্য ছুটাছুটি করতে থাকেন।”

২০২০ সাল। বালালী গ্রামের এক রজনি। আদিগন্ত নিকষ কালো আকাশে দু-একটা তারা ঝিকমিক করছে। অনুজ চাচাতো ভাই লাল মিয়া। গ্রামে গেলে ছায়ার মতো মিশে থাকেন বড় ভাইসাবের সাথে। কবি নূরুল হক প্রায়ই লাল মিয়ার ঘরে ঘুমাতে ভালোবাসেন। সেদিনও শুয়েছিলেন তার ঘরে। বড়ভাই খাটে, পাশেই মেঝেতে বিছানা করে ছোটভাই। অন্য ঘরে যাবার চেয়ে বরং ভাইয়ের পাশে ফ্লোরে ঘুমানোও শান্তির স্পর্শ দিয়ে যায়। হঠাৎ মাঝরাতে লাল মিয়া ঘুম ভেঙে গেলে দেখে বড় ভাই বালিশ ছাড়া ঘুমাচ্ছে। পিরের মতো যাকে শ্রদ্ধা করে তিনি ঘুমাচ্ছেন বালিশ ছাড়া! বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। খানিকটা ইতস্তত করে আস্তে করে ডাক দিলেন, “ভাইসাব, আপনি বালিশ ছাড়া ঘুমাচ্ছেন? হায় হায়!” ভাই জবাব দিলেন, “কবরে কি আমাকে বালিশ দিয়ে দিবে?” বড়ভাইয়ের এ-উত্তরে নিশ্চুপ লাল মিয়া।

কিশোর নূর মিয়ার বিবাগী মন বাউল হওয়ার জন্য উচাটন করে ওঠে। একদিন সন্ধ্যায় মোমবাতি হাতে নিয়ে দরগায় গিয়ে মানত করেন যেন বড় হয়ে একজন বাউল হয়ে ওঠেন। সেই বয়সেই লিখতে শুরু করেন বাউল গান। আহা! কত-না মন উন্মনা করা সেইসব লাইন —

নদীতে খুব ঢেউ উইঠাছে
কেমনে পাড়ি দিব আমি ওপারে মোর বন্ধু আছে।

পড়াশোনার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি লোকসংস্কৃতির করতলে মাথা রেখেই শৈশব পাড়ি দিচ্ছিলাম। স্কুলে ঢুকবার আগেই, বইয়ে চোখ ফেরাইনি তখনো, অন্যরকম পাঠাভ্যাসে ডুবেছিলাম। তখন মানুষের চেহারা পাঠ করতাম, পথিকের চলাচল পাঠ করতাম, বৃক্ষ পাঠ করতাম, আকাশ পাঠ করতাম, নদী পাঠ করতাম, বাসায় বাসায় পাখির ডিম পাঠ করতাম, রাত্রি পাঠ করতাম, ঘাস পাঠ করতাম, খালবিল-ডোবানালা-গরুছাগল — সব পাঠ করতাম। তারপর আর লাগে কী? চিরকালের বাঁধাই করা যে-বইটা আমার চোখের সামনে পড়ে থাকত, তার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে সারাদিন কেটে যেত।”

তাই অমনি বসে থেকে ডাকঘরের অমলের মতো কবিমন সুর তুলে যায় গভীর নিবেদনে —

গাছ-গাছালি দেখলেই আমি
.                             কেমন
                                 বিমূঢ় হয়ে যাই,
কারণ এগুলোই আমার স্মৃতিকথা, রাতের চাঁদ।

ফুলের ভাঁজের কাছে এলে
.                                আমি
আজও আটকা পড়ে যাই
কারণ ওই ভাঁজই আমার মায়ের কোল
.                                         ছেঁড়া কাঁথা।
(রোদে দোলায়মান পঙক্তিগুলো / নূরুল হক)

স্কুলে যাওয়ার বয়স হলে বালক নূর মিয়াকে ভর্তি করা হলো বালালী গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। অল্প কিছুদিন সেখানে আসাযাওয়ার পর তাঁকে ভর্তি করা হলো পাশের গ্রাম ধোবাওয়ালার প্রাইমারি স্কুলে। জল-অধ্যুষিত প্রত্যন্ত এ-অঞ্চলে বর্ষাকালে যাতায়াত হয়ে গেল সুকঠিন। কী আর করা, পরের বছর আরেক পাশের গ্রাম দৌলতপুরে ভর্তি হতে হলো। দৌলতপুর আর বালালীর মাঝখানে মগড়া নদী।  বাধ সাধলো মগড়ার জল। খেয়া পারাপারের ঝামেলা চুকিয়েবুকিয়ে দিয়ে ফের তিনি ফিরে আসলেন আপনালয় বালালী গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। এ-পর্যায়ে এসে গৃ্হশিক্ষক হিসাবে পেলেন মৌলবি কবি রুকন উদ্দিনকে, যার নাম আগেই উল্লেখ করেছি।

১৯৫৬ সাল। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েও মাঝপথে পড়াশোনা দেন চুকিয়ে। নানা কারসাজি করে দুই বছর আগে ভর্তি হওয়া মদন থানার জাহাঙ্গীরপুর হাই স্কুল  থেকে কোনোমতে ফসকে বের হন তিনি। গৎ বাঁধা পড়াশোনার অসহ চাপ আর ইংরেজি ক্লাসে শিক্ষকের সুন্দি বেতের বাড়ি পড়াশোনার প্রতি কিশোর নূরুল হকের  মনটা দিলো বিগড়ে। কোনোভাবে পালিয়ে বাঁচলেন তিনি। বিবাগী মন আটকে থাকতে চায় না পাঠ্যবইয়ের একঘেয়ে মৃত বিষয়বস্তুতে। যার দৃষ্টি আকাশের দিকে, অমৃতলোক যার কাম্য, তিনি কীভাবে কূপমণ্ডূকের মতো জীবনকে বেছে নিয়ে তুষ্ট থাকবেন! বেরিয়ে পড়তে চান তিনি খোলস ভেঙে এবং বেরিয়ে পড়েনও, ছড়িয়ে দেন নিজেকে জগতের ডালে ডালে। ডুবে যান সেইসব গানের আসরে, খেলাধুলায় এবং খোলা জীবনে। তখন সবকিছুই স্বাধীনভাবে ভাবতে শেখেন তিনি। কিন্তু কপাল খারাপ, পরের বছরেই বাবা ভর্তি করে দিলেন মাদ্রাসায় জমাতে দহমে। কেননা তাঁর পিতার দৃঢ বিশ্বাস দেখা দিলো যে এত কান্নাকাটি, আকুলিবিকুলির ফলশ্রুতিতে পাওয়া সন্তানকে আল্লাহর হাওলায় দিতে হবে, ঠিক এই রকমই মানত করেছিলেন এই সন্তানটি জন্মাবার সময়।

কিন্তু হায়,এই প্রকল্পও বৃথা গেল। সেইসাথে খুলে গেল তাঁর জীবনের এক নবতর অধ্যায়।

নিজের ভেতরে নেমে মাটি খুঁড়লে
.                     স্তরের পর স্তর দেখা যায়।
.                                 স্তরের ভেতর গর্ত
                  গর্ত থেকে জল উঠে আসে
আমি আশ্চর্য হয়ে তাকাই
.                   সে জল আমার গ্রামের।

জলের ভেতর গ্রাম, পড়শি গ্রাম
                                  টলমল করে
গ্রামের গভীর নিচে বনরাজি
.                          ছায়া দেখা যায়
আমি অবাক হয়ে জানতে পাই
সে-ছায়া আমার মায়ের
.                            অর্থাৎ দেশের।
সে-ছায়ায় হাত রেখে কত দেশে
.                                 নৌকো ভাসাই
কত জনম পেরোনো নদী
.                               আকাশ জমিন
রোদে-মেঘে জীবনের ময়লা ধুয়ে যাই।
(দৃশ্য / নূরুল হক)


বাবাকে যেমন দেখেছি ১
চরু হক রচনারাশি
কবি নূরুল হক স্মরণ ও মূল্যায়ন : গানপার সংকলন
জুলাই জেনোসাইড, লাল জুলাই : গানপার সংকলন

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you