সাময়িক পত্রিকার অনলাইন অফলাইন || আহমদ মিনহাজ

সাময়িক পত্রিকার অনলাইন অফলাইন || আহমদ মিনহাজ

গানপার’-এ সংগীত বিষয়ক রচনার বৈচিত্র্যটা বেশ লাগে। বব ডিলানের গানের ভিন্নমাত্রিক ভাষ্য ও বাচনের তরজমা থেকে শুরু করে নানান ধাঁচের লেখা আপনারা সাইটে তুলছেন এবং কেন জানি মনে হলো পাঠকের সাড়া আরও ব্যাপক হওয়া উচিত ছিল সেখানে। হয়তো হয়েছেও। নতুবা অবিরত নতুন লেখা আপনারা পেতেন না। এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ছে সাগরময় ঘোষের আমলে ‘দেশ’ পত্রিকা আমরা আগ্রহ নিয়ে পড়তাম তার বৈচিত্র্যের কারণে। শুধু বাংলাদেশে প্রতি সপ্তাহে ছাব্বিশ হাজার কপি চলত বলে জানি। নীরদ চৌধুরীর একটি লেখাকে ঘিরে ‘দেশ’ বাংলাদেশে সাময়িক নিষিদ্ধ করা হযেছিল। সেই ধাক্কায় পাক্ষিক হতে হয়েছিল তাকে। সাগরময় বাবু মারা যাওয়ার পর সাহিত্যপত্রটি আর দাঁড়াতেই পারেনি। তিনি যতদিন ছিলেন বৈচিত্র্যের সঙ্গে লেখার গুণগত মান ও মাত্রা সম্পাদনায় ধারণ করতেন। বিজ্ঞান  আর পাঠকের চিঠিপত্র  বিভাগ দুটো দারুণ ছিল মনে পড়ে। প্রতিটি চিঠি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়া হতো, কারণ চিঠিগুলাও সের’ম ছিল তখন। নিয়মিত সংখ্যার তুলনায় পুজো সংখ্যা (অন্তত আমার কাছে) যদিও পানসে বলে মনে হতো। সে যা-ই হোক, ‘দেশ’ কিন্তু বহু ভালো লেখার জন্মদানে সেই সময় ভূমিকা রেখেছিল; যদিও বাংলাদেশের লেখকদের অংশগ্রহণ সেখানে ব্যাপক ছিল না। সাগরময় এটা ঘটাতে পারলে সাহিত্যপত্রটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকত তাতে সন্দেহ নেই। তারপরেও ‘দেশ’-এর পুরোনো সংখ্যাগুলো তার কাভারস্টোরি আর নানামাত্রিক লেখার বৈচিত্র্যের কারণে আজও স্মৃতিকে নাড়া দিয়ে যায়।

বাংলাদেশে ‘বিচিত্রা’, ‘রোববার’ ও ‘সন্ধানী’ পুরোদস্তুর সাহিত্যপত্র না হলেও গুণমান বিচারে মন্দ ছিল না। বিচিত্রার ফিচারধর্মী অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো চমৎকার ছিল। একগুচ্ছ মেধাবী সাংবাদিকের কারণে প্রতিবেদনগুলো পাঠ না করে উপায় থাকত না। যেমন ‘সংবাদ’ শুধু চারণ-সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জোরে পাঠযোগ্য হয়ে উঠেছিল একসময়। এ-রকম পরিশ্রমী, নিবেদিত, অনুসন্ধানী ও সাহসী সাংবাদিক কিন্তু বঙ্গে আজও হাতে-গোণা! যা-ই হোক, বিচিত্রার কথায় ছিলাম, মাঝেমধ্যে তারা বিভিন্ন বিষয়ের ওপর অ্যালবাম নামে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করতেন। পাঠককে বিনোদিত করার সঙ্গে সিরিয়াস তদন্তের একখান ভঙ্গি থাকত সেখানে। রুনা লায়লা-কে নিয়ে দারুণ অ্যালবাম তারা বের করেছিলেন সেই সময়। গায়িকা রুনা-র গায়কির বিশেষত্বের সঙ্গে তাঁর যৌন-আবেদনকে সেখানে তুলে ধরা হয়েছিল। ওয়েস্টার্ন আউটফিটে রুনা-র শরীরী উপস্থাপন বা সেক্সঅ্যাপিলকে ফটোগ্রাফে ধারণের এই ঘটনা সময়ের বিচারে সাহসী পদক্ষেপ ছিল বলতে হয়। অনুসন্ধানমূলক কাভারস্টোরি, সাক্ষাৎকার, ঈদসংখ্যায় অন্তত দু-তিনখান মনে রাখার মতো প্রবন্ধ, প্রবাসী পাঠকের চিঠিপত্র আর নানাবিধ বিষয়ের সমাবেশ বিচিত্রাকে জনপ্রিয় হতে সাহায্য করেছিল। বেচাবিক্রি ছিল ঈর্ষণীয়। যতদূর মনে পড়ে ঈদসংখ্যা  প্রায় লাখ খানেক বাজারে কাটত তখন!  সৈয়দ হক ও শওকত আলী বিচিত্রার ঈদসংখ্যায় একপ্রকার নিয়মিত ঘটনা ছিলেন। যতদূর জানি সেই সময় আখ্যান/আখ্যায়িকার জন্য তাঁরা বেশ মোটা অঙ্কের সম্মানী পেতেন। বিচিত্রার কোনও-একটি ঈদসংখ্যায় ‘রবিনসন ক্রুসো’ নিয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী-র একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম, যেটি তাঁর লেখার ধারা বিবেচনায় ভিন্নমাত্রিক ও ভীষণ সুখপাঠ্য মনে হয়েছিল।

ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ রোববার-এ তখন ধারাবাহিকভাবে মুদ্রিত হচ্ছিল মনে পড়ে। রফিক আজাদ সম্ভবত সম্পাদক ছিলেন তখন। রাহাত খানের ‘হে অনন্তের পাখি’ আর ইলিয়াসের ‘চিলেকাঠার সেপাই’-র জন্য অনতি কৈশোরের সেই দিনগুলোয় আমরা অপেক্ষায় থাকতাম। এখন ভাবলে বেশ নস্টালজিয়া বোধ হয়! সন্ধানী  তার অঙ্গসজ্জা ও কন্টেন্টের দিক দিয়ে ছিল ব্যতিক্রম এবং অনেকবেশি সাহিত্যলগ্ন। ঈদসংখ্যার বিচারে ‘সন্ধানী’ সেরা ছিল বলতে হয়। বিচিত্রার সঙ্গে রফিকুন নবী আর সন্ধানীর সঙ্গে কাইয়ুম চৌধুরীর একধরনের অচ্ছেদ্য সংযোগ তৈরি হয়েছিল। যেমন বিচিত্রাযুগ শেষ হলে পরে শাহাদত চৌধুরী সিনেম্যাগাজিন ‘আনন্দ বিচিত্রা’ বের করতে শুরু করলেন এবং সফলও হয়েছিলেন। বিনোদনপত্রিকা হিসেবে কন্টেন্ট ও কোয়ালিটি বিবেচনায় ‘আনন্দ বিচিত্রা’ ভারতীয় ‘আনন্দলোক’, ‘ফিল্মফেয়ার’ বা ‘সানন্দা’-র চেয়ে হাজার মাইল এগিয়ে ছিল বলতে হবে। রুচি, নান্দনিকতা, বিশ্লেষণী প্রতিবেদন ও গ্ল্যামার…সব মিলিয়ে উপভোগ্য ছিল ভীষণ! সেইসঙ্গে মাশুক হেলাল-এর সংযোগ পত্রিকার ইলাস্ট্রেশন ও উপস্থাপনার ধারা বদলে দিয়েছিল। শাহাদত চৌধুরীর মতো আধুনিক ও সম্মুখগামী সম্পাদক পরে বাংলাদেশে আর এসেছেন কি না জানি না। ঠিক যেমন পত্রিকার কলামলেখক হিসেবে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবুল মনসুর আহমদ, জহুর হোসেন চৌধুরী, আবু জাফর শামসুদ্দীন কিংবা সন্তোষ গুপ্তকে এখনও অবিকল্প বলেই মনে হয়। সাংবাদিকের চোখকানের সঙ্গে সাহিত্যের বোধ আর জীবনের অভিজ্ঞতা তাদেরকে কলামলেখক হিসেবে স্বাতন্ত্র্য দান করেছিল। আব্দুল গাফফার চৌধুরীও একসময় দারুণ চৌকস ছিলেন কলাম-বয়ানে, এখন দলকানা ও বয়সের ভারে সেই ধার অনেকখানি হারিয়ে ফেলেছেন।

ট্যাবলয়েড পত্রিকার চল বাংলাদেশে সত্তুরের শেষভাগ ও আশির মধ্যভাগেই ঘটেছিল এবং সেটা ওই সিনেমা সূত্রে। ‘পূর্বাণী’ ও ‘চিত্রালী’ দিয়ে সে-যাত্রার শুরু। অনেকে ভাবেন সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী-র ‘মানবজমিন’-এর হাত ধরে বাংলাদেশে ট্যবলয়েড যাত্রা শুরু করে। আকারে ট্যাবলয়েড না হলেও প্রকার বিবেচনায়  ‘পূর্বাণী’ ও ‘চিত্রালী’ কিন্তু ট্যাবলয়েডের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে একসময় নিয়মিত প্রকাশিত হতো; যেখানে সিনেপাড়ার কেচ্ছাকাহিনিই ছিল মূল উপজীব্য। তবে ‘পূর্বাণী’ ও ‘চিত্রালী’ বেশ রঙদার কাগজ হলেও গসিপ নামক কন্টেন্টকে অতুল করতে গেলে পাপারাৎজিটা যে-মানের হওয়া প্রয়োজন ছিল, যেটা আমরা ‘সান’ বা ‘মিরর’-এ পাই, তার ধারেকাছেও যেতে পারেনি। বাংলাদেশে বসে সেলিব্রেটির মান-সম্মানের বারোটা বাজানো হলুদ সাংবাদিকতার জন্য যে-পরিমাণ বিনিয়োগ ও দৌড়ঝাঁপ দরকার হয় সেকালের  ‘পূর্বাণী’ বা ‘চিত্রালী’-র পক্ষে তার যোগান দেওয়া সম্ভব ছিল না। হলুদ সাংবাদিকতা ভয়ঙ্কর হতে পারে কিন্তু এটা একটা শিল্পও বটে! কী মর্মান্তিক এই সাংবাদিক যে তার জীবনকে কেলেঙ্কারির স্টোরি তৈরির জন্য বাজি রাখে, অথচ দিনশেষে নিজেকে তার বড় শূন্য আর রিক্ত মনে হয়। ‘লা দলচে ভিতা’-য় (সুইট লইফ) ফেলিনি তাঁর স্বভাবসুলভ রসবোধ দিয়ে পাপারাৎজির জীবনকে অমরত্ব দিয়ে গেছেন বৈকি।

বাংলাদেশে সংবাদপত্রের জগতে আশির দশককে ম্যাগাজিন বা সাপ্তাহিক প্রকাশের দিক দিয়ে স্মরণীয় ও ব্যতিক্রম মানতে হয়। শফিক রেহমানের ‘যায় যায় দিন’ তখন সাপ্তাহিক ছিল। এরশাদশাহির সেই সময়টায় তিনি সত্যিকার অর্থে নতুন ধারা এনেছিলেন সাপ্তাহিকের প্রকাশনায়। মূলত রাজনৈতিক ঘটনাবলি ঘিরে আবর্তিত হলেও ‘যায় যায় দিন’-এ স্পোর্টস, বিটিভির অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা, পশ্চিমের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির টাটকা সংবাদ বা কনসার্টের খবরাখবর আর মার্ক টালি-র কলাম ও ফিচারধর্মী সাক্ষাৎকার ইত্যাদি পাঠ যেতে  ভালোই লাগত। রেহমান যেহেতু লম্বা সময় লন্ডনে কাটিয়েছেন তার জীবনধারার ছাপ পত্রিকার পরতে-পরতে উঁকি দিয়ে যেত। সোজাকথা ‘যায় যায় দিন’-এর প্রতি অঙ্গে লন্ডন বা পশ্চিমা দেশ থেকে যেসব কাগজ বের হতো তার একটা বঙ্গীয় ভাষ্য তিনি তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন। চৌকস এই উপস্থানরীতি পরে তিনি বজায় রাখতে পারেননি। ‘মৌচাকে ঢিল’ থেকে ‘দৈনিক যায় যায় দিন’-এ গমনের পুরোটাই চৌকস শফিক রেহমানের স্থূলতার দিকে যাত্রা বলা চলে। ‘মৌচাকে ঢিল’-এর অবদান বলতে জাতিকে ব্যাপক যৌন সুড়সুড়ি উপহার দেওয়া, সেইসঙ্গে ভালোবাসা দিবসকে তিনি বাংলায় জনপ্রিয় করে তুলতে পেরেছিলেন বটে! রম্যপত্রিকা ‘মৌচাকে ঢিল’-এ গমনের পর থেকে রেহমান স্থূলতার যে-বিমারে ভুগতে শুরু করলেন পরে সে-বৃত্ত থেকে আর বের হতে পারেননি। ভদ্রলোক কি এখনও বেঁচে আছেন? তাঁর ‘লাল গোলাপ’ অনুষ্ঠানটি কি এখনও হয়?

সাপ্তাহিকের তুলনায় দৈনিক সংবাদপত্র (আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায়) ব্যতিক্রম বাদ দিলে আশি অবধি কমবেশি পানসেই ছিল। দৈনিকের সত্যিকার উত্তরণ ঘটে নব্বইয়ের দশকে; মতিউর রহমান ও তাঁর দলবল যেদিন থেকে ‘আজকের কাগজ’ বের করতে শুরু করেন, যার পরবর্তী বিবর্তন ‘ভোরের কাগজ’ হয়ে ‘প্রথম আলো’-য় এসে থিতু হয় ও পূর্ণতা লাভ করে। ‘ইত্তেফাক’ জনপ্রিয় ছিল বা ‘সংবাদ’ মোনাজাত উদ্দিন ও বৃহস্পতিবারের সাহিত্য সাময়িকীর কারণে পাঠক টানত, কিন্তু একটি দৈনিক যেখান থেকে পুরোদস্তুর পাঠযোগ্য কন্টেন্ট হয়ে ওঠে তার সূচনা ‘আজকের কাগজ’-এর মধ্য দিয়ে ঘটেছিল। যত তর্কবিতর্ক থাক-না-কেন, বাংলা সংবাদপত্রের জগতে ‘প্রথম আলো’ স্মরণীয় ঘটনা এবং একখান ‘আনন্দবাজার’-এর চেয়ে কোয়ালিটি বিবেচনায় এগিয়ে। দৈনিকে কন্টেন্টের বাহার ও সাংবাদিকতার মান বিচারে ক্ষেত্রবিশেষে প্রচণ্ড উদ্দেশ্যমূলক বা একরৈখিক হলেও প্রথম আলোর বিকল্প হয়ে উঠতে পারে এমন দৈনিক কি আজও চোখে পড়ে? পেশাদারি সাংবাদিকতায় এই পত্রিকাটি যেমন মাইলস্টোন, কন্টেন্টের দিক দিয়েও নতুন ধারার প্রবর্তক। বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র ধারণ করে এমন দৈনিক প্রয়োজন ছিল এবং ‘প্রথম আলো’ সেখানে সকলকে ছাড়িয়ে গেছে। সহসা এর বিকল্প তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখি না।

প্রথম আলোর এই সকল দিক দিয়ে বাংলাদেশকে নির্ধারণ করার শক্তির নেগেটিভ ফল যদি বলি সেটা হচ্ছে সাপ্তাহিকের অপমৃত্যু। নব্বইয়ের শেষভাগ থেকে এর মানে ভাটা পড়তে শুরু করে, কারণ তারা যা ধারণ করতেন তার প্রায় সবকিছু ‘প্রথম আলো’ গোগ্রাসে গলাধঃকরণ করতে শুরু করে। ফলে মিনার মাহমুদের বিচিন্তার বাইরে দ্বিতীয় কোনও সাপ্তাহিকের কথা স্মরণ হচ্ছে না যা দৈনিকের নবযাত্রাকে রুখে দিতে সক্ষম ছিল। এটা দুঃখজনক বটে যে বাংলাদেশে ‘টাইম’, ‘নিউজ উইক’, ‘ইকনমিস্ট’-এর মতো সাময়িকী প্রকাশের ধারাটি শক্ত পায়ে আজও দাঁড়াতে পারেনি। কাভারস্টোরির নিম্নগামী মান ও বৈচিত্র্যের অভাবে পাঠক এখন আর সাপ্তাহিক খোঁজে না। অনলাইন সামিয়িকী নামে যেগুলা চলে এখন, তারা আসলে ঠিক কী বস্তু সেটি আমার বুঝে আসে না। অনলাইন দৈনিকের বিচারেও ‘প্রথম আলো’ সফল। যদিও ‘বিডিনিউজ24’-কে সেখানে অগ্রপথিক গণ্য করা উচিত। এই এক জায়গায় প্রথম আলোকে ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম একখান দৈনিকের দেখা মিলে এবং সেটা এর সম্পাদকের দীর্ঘদিন বিবিসি-র সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার কারণে সম্ভব হয়েছে বলে ধারণা করি।

সে যা-ই হোক, প্রচলিত সংবাদপত্র, সাময়িকী ইত্যাদি পঠনপাঠনের বাইরে কমিউনিটি ব্লগিঙকে যদি স্মরণ করি সেক্ষেত্রে সূচনাপর্বে ব্লগগুলো অগোছালো হলেও পাঠকের সক্রিয়তা সেখানে আনন্দপ্রদ ছিল। মন্তব্য বিভাগে তাদের অংশগ্রহণ উদ্দীপনামূলক ছিল মানতে হয়। কমিউনিটি ব্লগিং এখন আর আগের জায়গায় নেই।  স্মৃতির অবশেষ হয়তো ‘সচলায়তন’, বাকিগুলা একে-একে মরে গেছে। সেই জায়গাটা নিয়েছে কলাশাস্ত্রের চর্চায় সক্রিয় সাহিত্যপত্রের ধারায় সচল সাইটগুলো। তবে সেখানেও বৈচিত্র্যের অভাব টের পাই। কমিউনিটি ব্লগিঙকে প্রতিস্থাপনকারী এইসব সাইটে সাহিত্যের বাইরে বিবিধ বিষয়ের ওপর চর্চা তেমন চোখে পড়ে না।  আবার বিদেশে যেমনটা ঘটেছে, কমিউনিটি  ব্লগিং তামাদি হওয়ার ক্ষণে পার্সোনাল বা ব্যক্তিগত ব্লগিঙের চর্চা ব্যাপক হওয়ায় ব্যক্তির আগ্রহের জায়গা থেকে বিচিত্র বিষয়ে ব্লগ চোখে পড়ে, বাংলাদেশে এই ঘটনাটি সেভাবে গতি লাভ করেনি। দুঃখজনক ঘটনাটি হয়তো এখানে যে, কী  পার্সোনাল কী কমিউনিটি কিংবা অনলাইন সাইট…দেশে-বিদেশে সর্বত্র এই মাধ্যমগুলোয় পাঠকের অংশগ্রহণ অতীতের মতো সচল নয়। ‘কমেন্ট সেকশন’ সবখানেই খালিই পড়ে থাকে। আগের মতো মন্তব্য-প্রতিমন্তব্যে মুখর হয় না। ফলে বোঝা মুশকিল ব্যক্তিগত ব্লগ কিংবা কমিউনিটি ব্লগ অথবা ‘গানপার’-এর মতো সৃজনমুখী বিনোদনের লক্ষ্যে বিরচিত কোনও সাইটে পাঠকের ক্লিকবাজি শেষতক কোনও কন্টেন্টকে আদৌ পাঠ যায়, নাকি চোখ বুলিয়ে চট করে সেখান থেকে কেটে পড়ে। এমনও হতে পারে, পাঠক হয়তো আদৌ সাইটে ঢোকে না, ফেসুবকশেয়ারে কন্টেন্টের নির্যাস পাঠ যায় এবং আলগোছে লাইক বাটনে চাপ দিয়ে অন্যত্র ভাগা মারে। সকলে দৌড়ের ওপরে আছি বলে হয়তো মানবেন্দ্র অনূদিত ভাৎস্লাভ হাভেল-এর নাটিকা ‘মনঃসংযোগের ক্রমবর্ধমান অসুবিধা’-র খপ্পরে পড়ে কিছুই আর পড়তে ইচ্ছে করে না এখন! চোখের সামনে দিয়ে স্রোতের মতো কন্টেন্ট আসে-আর-যায় তথাপি কোনওটাই হাত বাড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে না। মনে হচ্ছে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার যুগ সত্যি অস্তমিত হওয়ার পথে!

একটা কারণ হতে পারে যে ‘ফেসবুক’ আসার পর সবকিছু বদলে গেছে। এখন সবাই লেখক হওয়ার কারণে কে পাঠক সে-এক প্রশ্ন বটে! আমি এটাকে খারাপ বলি না, তবে নিয়মিত লিখতে গেলেও পাঠক কিন্তু হতেই হয়। জানি না, ফেসবুকে সে-ব্যাপারটি ঘটে কি না।

এহেন প্রতিকূলতার মধ্যে ‘গানপার’ নিজেকে সচল রেখেছে ভেবে মাঝেমধ্যে অবাক যাই। আপনি ও আপনার সহযোদ্ধারা ‘ছোটকাগজ’-এ একসময় সম্পৃক্ত ছিলেন বলে হয়তো ঘটনাটি এখনও সম্ভব হচ্ছে। স্বল্প পঠিত হওয়ার লক্ষ্যেই তো এর প্রচলন ঘটেছিল এক সময়। একটা ক্লান, কাল্টধর্মী মন্ত্রে জাগ্রত কতিপয় মানুষ, যারা সাড়ম্বরে নিজের গোষ্ঠীপ্রীতি ঘোষণা দিত এবং পরস্পরকে পাঠের মধ্যে সাহিত্যের মামলাটি তামাদি করত। যুগবিচারে এই গুহ্যচর্চা এখন আর প্রাসঙ্গিক মনে না হলেও এর একটা লাভের দিক এই যে এটা কারও তোয়াক্কা না-করে লেখককে লিখে যাওয়ার শক্তি দেয়। আমার কাছে ‘গানপার’ এবং এ-রকম আরও কিছু সাইট তাই ব্যতিক্রম ঘটনা হয়েই আসে। ক্রমবর্ধমান পাঠশূন্যতার মাঝেও এই সাইটগুলো নিজেকে সক্রিয় রেখেছে কারও পরোয়া না করে। লেখকরা সাইটে আর্কাইভড হচ্ছেন এবং তারা যদি শেষতক বেঁচেবর্তে থাকে, কে বলতে পারে সেই আর্কাইভ হয়তো কোনও পাঠকের কাছে খনি মনে হবে। সেই পাঠক তখন সেখানে তার পছন্দের লেখাগুলো পাঠ যাবেন এবং এভাবে নতুন ধারার প্রচলন দূর ভবিষ্যতে ঘটতেও পারে।

সত্যি বলতে কি আমরা একটা ট্রানজিশনের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি বহু বছর ধরে। জানি না এর শেষ কবে হবে! তবে যেদিন হবে সেদিন লেখার জগতে নতুন স্রোত নিশ্চয় দেখা দেবে। শুধু লেখা বা লেখক নয়, পাঠ বা পাঠকের যুগটাও সেদিন থেকে শুরু হবে। সেই পাঠককে দেখে যাওয়ার ভাগ্য আমাদের হয়তো হবে না, তবে লেখককে পড়তে গিয়ে তাকে ছাপিয়ে যাওয়া পাঠকের পুনরুত্থান ছাড়া কোনও দেশেই সত্যিকার অর্থে বড় লেখকের জন্ম হয় না।


  • লেখকের সঙ্গে সাইটসঞ্চালকের ইমেইল কনভার্সেশনের অংশবিশেষ। — গানপার

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you