মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দু-শ’ বছর আগে ‘পাশ্চাত্যি শাস্ত্রীয়’ বা ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যালের ভিত থেকেই জন্ম হয় আজকের জ্যাজ্ সংগীতের। অ্যাফ্রিক্যান্ কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসরা এই নয়া সংগীত উপস্থাপন করেন। মার্কিনী ইতিহাসের বর্ণবৈষম্যের সেই কলঙ্কময় অধ্যায়; — শ্বেতাঙ্গরা তাদের কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের সংগীত ছাড়া আর-কোনো মানসিক উন্নতির প্রয়াসকে প্রশ্রয় দিত না। সেই কৃষ্ণাঙ্গরাই আজ ‘বিশ্বসংগীতের’ পৃথিবীতে রাখছে অকল্পনীয় অবদান। ক্রীতদাসদের দুঃখ বেদনা ভালোবাসা ও কষ্ট সবকিছুরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই সংগীতের মাঝ দিয়ে এবং তা প্রতিফলিত হয় তাদের আধ্যাত্মিক ও রাজনীতিক চেতনার মধ্যে। অ্যাফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বৈচিত্র্যপূর্ণ ছন্দ বা রিদমের ইম্প্রেশন্ বা ছাপ পাশ্চাত্য সংগীতের প্রথমদিককার সংগীতজ্ঞদের কাজে নতুন মাত্রা সংযোজন করে। বাকিটা ইতিহাস।
মানবজাতির সময় ও ধৈর্য যখন টানাপোড়েন ও পরীক্ষার মুখে, ঠিক তখনই জ্যাজসংগীত ছন্দ, লয়, মাত্রা, উপস্থাপনা ও সুরের আবহাওয়াকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে। দ্রুতলয়, সোলো, ইম্প্রোভাইজেশন্, যুগলবন্দি ইত্যাদিতে এগিয়ে নিয়ে আসে এক অভাবনীয় নতুন ধারা। জ্যাজ্ সেই ‘তখন’ বা ‘এখন’ … কখনোই কমার্শিয়্যাল্ বা বাজারীয় সংগীত ছিল না, যদিও-বা জ্যাজকে ভাঙিয়ে অনেক নতুন সংগীত সৃষ্টি হয়, যার অন্যতম রক্, যা শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের অনুসরণে আবিষ্কার করে।
এ-কথাও বলে নেবার প্রয়োজন বোধ করছি যে জ্যাজ্ আমাদের দেশের শাস্ত্রীয় বা আধাশাস্ত্রীয় সংগীতের মতো শুধু সম্ভ্রান্ত সামাজদারদের সংগীত নয়, কোনোকালেই ছিল না। যেহেতু এ-সংগীতের জন্ম কোনো রাজপ্রাসাদের দরবারে হয়নি বা ধনীদের পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি, তা সাধারণ মানুষের সব স্তর ভেদ করে এসেছিল বলেই আজ এর বিশ্বজোড়া ব্যাপ্তি ও চাহিদা। মিল শুধু এতটুকুই যে জ্যাজ্ আমাদের শাস্ত্রীয় বা আধাশাস্ত্রীয় সংগীতের মতো চর্চার খুব অভাব।
জ্যাজ্ তাই সকল বিবেচনায় খুব উঁচুমাপের সংগীত এবং যে-কোনো সংস্কৃতির উঁচুমাপের সংগীতের সঙ্গে খুব সহজে ও সফলভাবেই সংমিশ্রণ বা ফিউশন্ করা সম্ভব। যেমন আমরা করার চেষ্টা করেছি মুর্শিদী, মারফতি এমনকি রবীন্দ্রসংগীত ছাড়াও আমাদের শাস্ত্রীয় কিছু ধারার সঙ্গে। কথাটা খুব হাল্কা শোনালেও সত্য, এই জ্যাজ্-রক্ ফিউশন্ খুব ভালো জাতের আলু যা যে-কোনো তরকারিতেই মানানসই।
এই শতকের শেষে বিশ্ব যখন বর্ণ, জাত, স্তর বা ধর্মকে মানুষের যোগ্যতা নির্ণয়ের মাপকাঠি বলে আর মনে করছে না, যখন সংগীত কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা মেনে চলছে না, এই পরিবর্তিত পৃথিবী যেখানে কোনো আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক সংস্কৃতি নয় বরঞ্চ বিশ্বসংস্কৃতির বা গ্লোব্যাল্ কালচারের দিকে এগোচ্ছে, জ্যাজকে ঠিক তখনই বিশ্বজুড়ে সেমিক্ল্যাসিক্যাল্ বা আধাশাস্ত্রীয় সংগীত বলে গণ্য করা হচ্ছে।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী যখন ষাট দশকের আমাদেরই পথিকৃৎ বিটলস্-এর সংগীতকে আধাশাস্ত্রীয় সংগীত বলে মনে করা হচ্ছে, দু-শ’ বছরের পুরনো জ্যাজ্ সংগীতকেও এখনো সেমিক্ল্যাসিক্যাল্ বা আধাশাস্ত্রীয় বলে গণ্য করা হয়, তাতে এই সত্য প্রমাণিত হয় জ্যাজ্ তার নিজস্বতা এতগুলো বছরেও হারিয়ে ফেলেনি। তার মূল কারণ, এই সংগীতধারা সময়কে ধারণ করেছে সঠিকভাবে ও অন্যসব সংস্কৃতির মাঝে নিজের একাত্মতা বা অস্তিত্ব দুই-ই সদর্পে বজায় রেখেছে এবং তা সম্ভব হয়েছে জ্যাজের সংমিশ্রণ বা ফিউশনশাস্ত্রের দর্শনের কারণে।
জ্যাজ্-রক্ ফিউশন্ কখনোই ঐতিহ্যবাদী বা রক্ষণশীলদের সংগীত ছিল না। জ্যাজ্-রক্ ফিউশন্ খুব গুরুগম্ভীর শোনালেও বাংলা ভাষাভাষীদের কানে, বিশেষ করে ব্যান্ডসংগীতের শ্রোতাদের কাছে, তেমন নতুন কিছুই নয়। কারণ জ্যাজের আদলে আমি এর আগে অনেক গান সৃষ্টি করেছি ‘ফিডব্যাক’-এ থাকাকালীন; ‘…নিষিদ্ধ’-তেও তার অনেক প্রমাণ মেলে। পার্থক্য এইটুকুই যে ‘ওগো ভালোবাসা’ সেই অর্থে সম্পূর্ণাঙ্গ একটি জ্যাজ্-রক্ ফিউশন্ অ্যালবাম, সংকলন বা ফিতা। আমার ধারণা, বাংলা সংগীত শ্রবণের ক্ষেত্রে শ্রোতাদের কাছে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা বলেই বিবেচিত হওয়ার জোর সম্ভাবনা আছে। আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি এখানেই লিপিবদ্ধ করলাম। আশা করি আপনারা যা শ্রবণ করছেন তা ভালো লাগবে। তদুপরি শুভ শ্রবণ, হ্যাপি লিসেনিং!
লেখাটা ‘ওগো ভালোবাসা …’ অ্যালবামের ইনলে-কার্ড থেকে নেয়া। অ্যালবামের প্রকাশকাল ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ
… …
- Take a break folks and read this book - April 7, 2025
- Muchkund Dubey and Hindi translation of Fakir Lalon Shah’s work || Mac Haque - March 30, 2025
- Are we ready for Khilafa E Bangal? || Mac Haque - September 5, 2024
COMMENTS