রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য পেয়েছিলুম, তাই যদি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে দেখি তাহলে আশা করি সুশীল পাঠক এবং সহৃদয়া পাঠিকা অপরাধ নেবেন না।
রবীন্দ্রনাথ উত্তম উপন্যাস লিখেছেন, ছোটগল্পে তিনি মপাসাঁ চেখফকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন, নাট্যে তিনি যে-কোনো মিস্টিকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন, কবিরূপে তিনি বিশ্বজনের প্রশংসা অর্জন করেছেন, শব্দতত্ত্ব সম্বন্ধে তিনি যে গবেষণা করেছেন তার গভীরতা পণ্ডিতদের নির্বাক করে দিয়েছে, সত্যদ্রষ্টা হিসাবে তাঁর ব্যাখ্যান ভক্তজনের চিত্তজয় করতে সমর্থ হয়েছে, তাঁর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি আরো কত বৎসর ভারতবাসীকে নব নব শিক্ষা দেবে তার ইয়ত্তা নেই, আর গুরুরূপে তিনি যে শান্তিনিকেতন নির্মাণ করে গিয়েছেন তার স্নিগ্ধচ্ছায়ায় বিশ্বজন একদিন সুখময় নীড় লাভ করবে সে-বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই।
আমার কিন্তু ব্যক্তিগত বিশ্বাস, রবীন্দ্রনাথ এসব উত্তীর্ণ হয়ে অজরামর হয়ে রইবেন তাঁর গানের জন্য।
সুরের দিক দিয়ে বিচার করব না। সুহৃদ শান্তিদেব ঘোষ তাঁর ‘রবীন্দ্রসংগীত’-এ এমন কোনো জিনিস বাদ দেন নি যে-সম্বন্ধে আপনি আমি আর-পাঁচজনকে কিছু বলে দিতে পারি। আমি বিচার করছি, কিংবা বলুন মুগ্ধ হয়ে ভাবি যে, কতগুলো অপূর্ব গুণের সমন্বয় হলে পর এ-রকম গান সৃষ্ট হতে পারে। সামান্য যে দু-চারটে ভাষা জানি তার ভিতর আমি চিরজীবন যে-রসের সন্ধান করেছি সে হচ্ছে গীতিরস। শেলি কীটস্, গ্যোটে হাইনে, হাফিজ আত্তার, কালিদাস জয়দেব, গালিব জওক্ — এঁদের গান বলুন কবিতা বলুন সবকিছুর রসাস্বাদ করে এ জীবন ধন্য মেনেছি, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বারবার বলেছি —
এমনটি আর পড়িল না চোখে,
আমার যেমন আছে।
তার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বারবার হার মেনেছি। রবীন্দ্রনাথের গান এমনি এক অখণ্ড রূপ নিয়ে হৃদয় মন অভিভূত করে ফেলে যে, তখন সর্বপ্রকারের বিশ্লেষণক্ষমতা লোপ পায়।
জর্মন যখন ‘লীডার’ কিংবা ইরানীরা যখন ‘গজল’ গান একমাত্র তখনই আমি রবীন্দ্রসংগীত-জাতীয় কিঞ্চিৎ রস পেয়েছি। তাই একমাত্র সেগুলোর সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের গানের তুলনা করে ঈষৎ বিশ্লেষণ করা যায়। তখন ধরা পড়ে :
রবীন্দ্রনাথের গানের অখণ্ড, সম্পূর্ণ রূপ। বহু লীডার এবং গজল শুনে মনে হয়েছে এ গান অপূর্ব, এ গান যদি আরো অনেকক্ষণ ধরে চলত তবে আরো ভালো লাগত, অর্থাৎ শুধু যে অতৃপ্ত রেখে গিয়েছে তা-ই নয়, অসম্পূর্ণ বলেই মনে হয়েছে এ ‘লীডার’ বা ‘গজল’ আরো কিছুক্ষণ ধরে চলতে পারত।
রবীন্দ্রনাথের গান কখনোই অসম্পূর্ণরূপে আমার সামনে দাঁড়ায় নি। তাঁর গান শুনে যদি কখনো মনে হয়ে থাকে এ গান আমাকে অতৃপ্ত রেখে গেল তবে তার কারণ তার অসম্পূর্ণতা নয়, তার কারণ অতিশয় উচ্চাঙ্গের রসসৃষ্টি মানেই ব্যঞ্জনা এবং ধ্বনিপ্রধান। তার ধর্ম সম্পূর্ণ তৃপ্ত করেও ব্যঞ্জনার অতৃপ্তি দিয়ে হৃদয়মন ভরে দেওয়া। তখন মনে হয়, এ গান আমার সামনে যে-ভুবন গড়ে দিয়ে গেল তার প্রথম পরিচয়ে তার সবকিছু আমার জানা হলো না বটে, কিন্তু খেদ নেই, আবার শুনব, তখন সে-ভুবনের আরো অনেকখানি আমার কাছে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে আর এমনি করে একদিন সে-ভুবন আমার নিতান্ত আপন হয়ে উঠবে। কোনো সন্দেহ নেই এরকম ধারাই হয়ে থাকে, কিন্তু আরেকটি কথা তারচেয়েও সত্য : রবীন্দ্রনাথের কোনো গানই কখনো নিজেকে সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে না।
শব্দের চয়ন, সে-শব্দগুলো বিশেষ স্থলে সংস্থাপন এবং হৃদয়মনকে অভাবিত কল্পনাতীত নূতন শব্দের ভিতর দিয়ে উন্মুখ রেখে ভাবে, অর্থে, মাধুর্যের পরিসমাপ্তিতে পেঁছিয়ে দিয়ে গান যখন সাঙ্গ হয় তখন প্রতিবারই হৃদয়ঙ্গম করি, এ গান আর অন্য কোনো রূপ নিতে পারত না — নটরাজের মূর্তি দেখে যেমন মনে হয়, নটরাজ অন্য কোনো অঙ্গভঙ্গি দিয়ে আমার চোখের সামনে নৃত্যকে রূপায়িত করতে পারতেন না। তাই বলি, নটরাজের প্রত্যেকটি অঙ্গভঙ্গির মতো রবীন্দ্রনাথের গানের প্রত্যেকটি শব্দ।
লক্ষ করেছেন নিশ্চয়ই, চমৎকার সুর-তালজ্ঞান, মধুরতম কণ্ঠ, তবু কোনো কোনো গায়কের গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গান ফিকে, পানসে অর্থাৎ ফ্ল্যাট বলে মনে হয়। কেন এরকম ধারা হয় তার কারণ অনুসন্ধান করলে অধিকাংশ স্থলেই দেখতে পাবেন, গায়কের যথেষ্ট শব্দ-সম্মান বোধ নেই বলে প্রতিটি শব্দ রসিয়ে রসিয়ে গাইছেন না আর তাই যেন নটরাজের প্রতিটি অঙ্গ আড়ষ্ট হয়ে গিয়ে তাঁর নৃত্য বন্ধ হয়ে গেল।
মৃত্তিকার বন্ধন থেকে রবীন্দ্রনাথ কত শতবার আমাদের নিয়ে গিয়েছেন ‘নীলাম্বরের মর্মমাঝে’। আবার যখন তিনি আমাদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন তখন এই মৃত্তিকাই স্বর্গের চেয়ে অধিকতর ‘মধুময় হয়ে ওঠে’।
তারায় তারায় দীপ্তশিখার অগ্নি জ্বলে
নিদ্রাবিহীন গগনতলে —
শুনে কি কল্পনা করতে পারি যে :
ওই আলোক-মাতাল স্বর্গসভার মহাঙ্গন,
কোথায় ছিল কোন যুগে মোর নিমন্ত্রণ!
তারপর যখন মনকে তৈরি করলুম সেই স্বর্গসভার নব নব অভিজ্ঞতার জন্য তখন আবার হঠাৎ আমি
কালের সাগর পাড়ি দিয়ে এলেম চলে
নিদ্রাবিহীন গগনতলে।।
তারপর এ ধারার কী অপরূপ বর্ণনা :
হেথা মন্দমধুর কানাকানি জলে-স্থলে
শ্যামল মাটির ধরাতলে।
হেথা ঘাসে ঘাসে রঙিন ফুলের আলিম্পন
বনের পথে আঁধার-আলোয় আলিঙ্গন।
কখনো স্বর্গে কখনো মর্ত্যে, আপন অজানাতে এই যে মধুর আনাগোনা, মানুষকে দেবতা বানিয়ে, আবার তাকে দেবতার চেয়ে মহত্তর মানুষ করে তোলা — মাত্র কয়েকটি শব্দ আর একটুখানি সুর দিয়ে — এ অলৌকিক কর্ম যিনি করতে পারেন তিনিই ‘বিশ্বকর্মা মহাত্মা’।
লেখকের রচনাবলি প্রথম খণ্ড থেকে নেয়া। প্রথম প্রকাশ চতুর্থ মুদ্রণ বৈশাখ ১৩৯৩, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, কলকাতা
… …
- শিরোনাম রাষ্ট্রসংস্কার - September 6, 2024
- হাসিনাপতন : পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া ও তাৎক্ষণিক সংযোজন || মোস্তাফিজুর রহমান জাভেদ - September 4, 2024
- শিক্ষকের পদ || পূজা শর্মা - August 27, 2024
COMMENTS