গল্পলেখকের দায়বদ্ধতা হলো গল্পের ক্ষতস্থানটি ব্যান্ডেজ খুলে পাঠককে দেখানো। একই দায়বদ্ধতা কবির। চিত্রশিল্পীর। এবং গায়কের।
কথাটা আদৌ সত্যি কি না, জানতে চাইলেন জনৈক কবিতাপাঠক। বলা বাহুল্য, বঙ্গমুলুকে ‘কেবলমাত্র কবিতাপাঠক’ বাস্তবে বেঁচে নেই একজনও। সর্বশেষ শুধুমাত্র-অর্থে-শুদ্ধ কবিতাপাঠকটিকে — পিউর-অর্থে-শুদ্ধ বলা হচ্ছে না এখানে — দেখা গিয়াছিল ছুটিঘণ্টি বাজাবার কাজে ব্যাপৃত দূর কোনো দশকের এক গ্রামের ইশকুলে। না, গ্রামার ইশকুলে কি না তা জানা যায় নাই, ছিলেন তিনি ইশকুলঘণ্টি অপারেটর এক পাড়াগাঁর পাঠশালায়। মাসোহারা মাইনের এক ফরমায়েশখাটা চাকুরে, মাস্টার মশাইদের হুকুমের গোলাম, এমনকি শিক্ষার্থীরাও ওটা-সেটা আব্দারের ছলে হুকুমই করত বেচারাকে এবং খুশিচিত্তে হুকুম তামিলও করতেন আমাদের এই লাস্ট অ্যান্ড দ্য লিস্ট কবিতাপাঠক।
কথাটা হচ্ছে গিয়ে যে এখন কবিতাপাঠকের সংখ্যা ইজ ইক্যুয়্যাল টু কবিসংখ্যা। ব্যাপারটা খারাপ না। বাংলা কবিতা বাঁক নিচ্ছে অন্তত পরিসংখ্যানগত বিচারে। একটা সময়, গেল শতকের অন্তিম দশকে, একটা দাবি নিত্যি তোলা হতো ঘনঘন বাংলা কবিতা বাঁকরত মর্মে। একের-পর-এক ছোট ছোট পত্রিকাপ্রাণ ছোট ছোট কবিতামিস্তিরিরা বাকবাকুম করতেন যে তেনাদের কবিতা বাঁক নিয়া গাছের মগডাল ছেড়ে আকাশে উঠিয়া সারা। বাদের মাসে ফের আরেক দঙ্গল কবিতাকারিকর কল্কিবিড়ির পাছা কষে টেনে হাঁক পাড়তেন কবিতা আদপে এইমাত্র তাদের হাতেই নিলো বাঁক, পূর্বের কবিদের দাবি ভিত্তিহীন ও ভুয়া, এবং কবিতা তাদের হাতে বাঁকিয়া যাইবার আগে একবার খালি তিরিশি কলকেতা কাব্যকুঙ্কুমদিগের হাতে একটু বঙ্কিম আলামত দেখিয়েছিল বটে। এইসেই ইত্যাদি হুজ্জুতিতে তখন আমরা কবিতার-সঙ্গে-আজোবধি-সংশ্রবহীন-লোকেরা আমোদ পাইতাম প্রভূত।
কবিতার পাঠক দুই রকমের, এই নিশ্চয়াত্মক জ্ঞানটাও আমাদিগের হয়েছিল গত শতকের অন্তিম দশকের তথা বিগত সহস্রাব্দের অন্তিম শতকের খতমুন দশকের কবিতারাজ কোবিদদের কাছ থেকে। বেগুনবিচারী পাঠক আর গুণবিচারী পাঠক, এই দুইটা টাইপ। যদিও প্রথমোক্ত ধরনের উল্লেখ মুখে অনুচ্চারিত ছিল। তখন ছিল এক আলগ প্রকারের বাকোয়াসদের বদগন্ধ ঢেঁকুর সহিবার যাতনা। আজকাল যাতনা অন্য, বাছবিচারবৈকল্যজনিত যন্ত্রণা — ঝাপসা কথায় এইটুকু সহজে কহা যায়।
কিন্তু বাংলা কবিতার বাঁক, বাকবাকুম ও ডিগবাজি কি ডনবৈঠক-য়্যুগাব্যায়াম অফুরান। দ্রৌপদীশাড়ির ন্যায় এই জিনিশ, বাংলা কবিতার বাঁক, আর কবিরা সেই ডিপ্লোম্যাট লর্ড কৃষ্ণা। তা যা-হোক, মহাভারতের কথা অমৃত সমান, এইখানে আমরা সংক্ষেপে হাল্কা চা-স্ন্যাক্স দিয়া আলোচনাচক্রের চক্কর থেকে বেরোতে চাই। বিশেষ কোনো ডে অবজার্ব করার ফান্ড বাগাতে পারলে বাকি আলাপ হবে অন্য কোথাও অন্যদিন অন্য কোনো ভেন্যুতে।
এপিগ্রাফ হিশেবে যেই কথাটা এখানে শীর্ষঝুলন্ত, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এইটা কোথাও কোনো-এক ইন্টার্ভিয়্যুতে এর্শাদ করেছিলেন। কথাটা মনে ধরেছিল বলে ভুলিয়া যাই নাই। কিন্তু কোত্থেকে এইটেরে পেয়েছি সেই সূত্র ঘোঁট পাকায়ে ফেলেছে এই বক্তিমাবাজের প্রতারক স্মৃতি। বেদনার, তুমি, স্মৃতি। অ্যানিওয়ে। সম্ভবত ‘জারি বোবাযুদ্ধ’ বা ‘দাহপত্র’ বা এইরকম কোনো পত্রিকায়। সন্দীপনপ্রয়াণের পর দুনিয়ায় যত পত্রিকা তারে নিয়া স্পেশাল ইশ্যু করেছিল সবগুলোই নজর বুলিয়েছি আমরা, ফলে ব্যারাছ্যারা লাগিয়া যাওয়া বিচিত্র নয়। অ্যানিওয়ে শব্দপ্রয়োগে এ-যাত্রা আরেকটা লাফ দেয়া যাক। পরবর্তী বক্তারা আসবেন, বলবেন, চোদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করবেন পূর্ববর্তী বক্তার বা মাখন-রুটি খাওয়াবেন কথার মেয়োনেজ মিশায়ে পূর্ববর্তী বক্তারে, দুনিয়ার আলোচনাচক্রের এই দুই ভাগ, দুইমাত্র ঘরানা, বাইন্যারি অপোজিশনের অনিঃশেষ খেলাধুলার বিন্দাস দুনিয়া।
ব্যান্ডেজ খুলে দেখানোর কথা বলতে চেয়েছেন সন্দীপন। ক্ষতস্থানের ব্যান্ডেজ। গল্পের ক্ষতস্থানের। কবিতার বা গানের বা চিত্রপটের ক্ষতস্থানের। কবি যেই জিনিশটা প্রায়শ করে ফেলেন বলে মেহসুস হয়েছে আমাদের কাছে, তা হলো এ-ই যে, কবি নিজের ব্যক্তিক ক্ষতস্থান বা স্ফীতবক্ষ ব্রণ-ফুঁসকুড়িটার দিকে বেশি ফোকাস দিয়ে ফেলেন। গল্পকার এই জিনিশটা খানিক কম করেন, টেক্নিক্যাল কিছু লিমিট্যাশনের কারণে সেইটা হয়ে ওঠে না গল্পকারের পক্ষে, কবি তো মাশাল্লা ‘ইয়াআলি’ হুঙ্কারে জিন্দেগির প্রথমসূর্যের থেকে শুরু করে দিবসের অস্তসূর্য পর্যন্ত কবিতার ক্ষতস্থান ভুলে নিজের ফোঁড়া-পচা পুঁজকাঁচা ঘায়ের ব্যান্ডেজ খুলতে আর বুজাইতে ব্যস্ত রহেন। ফলে একটা আজিব বদবু বেরোয় এইধারা কাব্যজব্দ কবিতার গা থেকে। এই ব্যাপারটাও কি ব্যাখ্যা কর্তব্য?
ওয়েল ওয়েল ওয়েল, জরুর হো-গা, ব্যাখ্যাম্যাখ্যা মোতিমোগা, সাম আদার ডে। এখন শীতকাল। ঘরে ঘরে শীতের সকাল, উঠানে ধানের ন্যায় ছড়ানো রোদ। নো নো নো, রোদ নয়, রইদ। সিলেটে বলে রইদ তাবানি, আউটার সিলেট রোদ পোহানো এবং ইত্যাদি। কিন্তু গোটা ব্যাপারটা আঞ্চলিকতা-উর্ধ্ব। শরীর পাতিয়া দিনু সূর্যালোকে, টের পেনু কাকে বলে বেঁচে থাকার সুখ ও সমৃদ্ধি, টের পেনু বক্তিমাবাজির জিল্লতি ও ফিউটিলিটি।
বিকাল বুজে এল, শুরু হলো শিমের মাচায় কুয়াশার ডিউটি।
—জাহেদ আহমদ, ৩১ জানুয়ারি ২০১৫
- শীতসকালের স্মারক বক্তৃতা : ব্যান্ডেজ ও বৈদ্য - January 31, 2025
- মাধবী, বিপ্লব ও অন্যান্য মদন প্রসঙ্গ - January 24, 2025
- জানালাবায়োস্কোপ - January 23, 2025
COMMENTS