“অনেককাল চুপ থাকতে হবে। যেমন নিশ্চুপ হয়ে আছে প্রাচীন গুহা, জাপানী উপাসনালয়ের ফিরোজা পাথর আর হ্রদের নিচে পড়ে থাকা চঞ্চল স্বভাব রূপসীর আঙটি। … চিন্তাটাই জরুরি — কে কথা বলল আর কে চুপ করে রইল আঘাতের একপাশে; ভোজসভার মহিলারা কিংবা তন্দ্রাচ্ছন্ন আকাশের নক্ষত্র, এরা কেউই তা জানতে চায় না জনতার ভিড়ে।…”
[সিকদার আমিনুল হক / সতত ডানার মানুষ]
একটা ভালো কবিতা পড়ার পর বহুকাল নিদ্রিত থাকা ভালো, কবি বিনয়ের বচন মনে হয় এইটা, ফিরে এসো, চাকায় যায় পাওয়া, আমার আজকাল এই কথাটা খুব কাজে লাগে, বিশেষত ফেইসবুক ইত্যাদিতে বেশকিছু সুন্দর কবিতা পড়া হয়ে যায় ফি-মাসে খেয়াল করেছি, হিসেব কষে দেখেছি ফিগারটা খারাপ না, কিন্তু গোল বাঁধে একেকটা ভালো জিনিশের লেজে-বাঁধা কমেন্টগুলোতে চোখ চলে গেলে, এবং চোখ তো খুব শাসনবারণ মানে না, কিশোরীর ন্যায় দৃষ্টির তথা চোখের খেয়াল থাকে না ওড়নার দিকে — খেলতে খেলতে খেলাচ্ছলে চোখ চলে যায় এদিক-ওদিক, মগ্নতা ব্যাহত হয়, এবং মনে হয় একেই তো বলে রৌরব কিংবা হাবিয়া দোজখ, কমেন্টের ছিরি দেখে গা রি রি করে, কেউ যখন মৃত্যুর মতো অনির্বচনীয় মনমোহন কবিতা পড়ে খেঁকিয়ে ওঠে — ক্যায়া বাত… ঔস্যম… অদ্ভুত… বিন্দাস… মারহাব্বা… মার কৈলাস… বিউটিফ্যুল… ফ্যান্টাস্টিক… ফাটাফাটি… পদ্য তো নহে যেন পাবকেরও গোলা… ব্লা ব্লা — দেখেশুনে কবিতাপাঠোত্তর আচ্ছন্ন আবেশটা যায় ছিঁড়ে… এখন, ওইসব শীৎকারসাউন্ড লোককথিত বঙ্গীয় অর্বাচীন সমালোচনাসাহিত্যের জন্য খুবই কিলোমিটারপিলার হতে পারে একেকটা, মাইলস্টোন-মাউন্টেইন হতে পারে একেকটা, সাময়িকভাবে কবিকেও উষ্ণ করে তুলতে পারে হয়তো-বা, পাঠকের জন্য তা আলবৎ কর্ণপীড়ক, মনে হয়, একটা কবিতা পড়ে এইসব তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়ার পরিসরগুলোতে একটাভাবেই অনেস্ট রেস্পন্স করা যায়, এবং সে-রেস্পন্স একদম মায়ের সঙ্গে কথা বলার সুরে, যেমন সেইটা — ‘ভালো লাগল’, … ‘খুব সুন্দর’… বড়জোর ‘চমৎকার’… বা ‘অসাধারণ’… অধিকন্তু, এরচেয়ে বেশি কিছু, কবির জন্য দোষায় কি না জানা না-গেলেও দর্শক-পাঠকের প্লীহা চমকায় … এরা তা-ও তো অত ড্রোন-ডেঞ্জারাস কিছু নন, যেমন দৃশ্যত দ্রোণাচার্যগণ যাদের নিজেদের শরীরে সাতসমুদ্র মুদ্রণবিভ্রাট থুয়ে একটি নিভৃত-নীল পদ্য পড়ে বানানসম্পাদক অথবা স্পেলচেকারের রোল প্লে করে কবির মরণোত্তর রচনাসমগ্রে অগ্রিম কন্ট্রিবিউশন রাখেন … ভাবখানা তাদের এমন, বলতে চান তারা যেন, কবিতা আসলে তো শুদ্ধ বানানের সমাহার … কবিতা হয়ে ওঠে শুদ্ধ বানানে যেন, কবিতা যেন গুটিগুচ্ছ শব্দের বিন্যাস-সমাবেশ … কম্বিনেশন অ্যান্ড পার্ম্যুটেশন অফ রাইটমোস্ট ওয়্যর্ডস … লোল … এলওএল …। ধরুন, কোনো কবিতা পাঠোত্তর আপনার মনে হলো কবিকে ডেকে বলবেন যে কেমন লেগেছে কবিতাটা … দুইতিনটা বানান ভুল ধরায়া দেই, কিছু প্রয়োজনীয় নসিহত … কিন্তু পরক্ষণে ফের মনে হলো, নো, সুবিচার হবে না, জাস্টিস হবে না যাকে বলে, এই কবিতাটার প্রতি, বানানমেক্যানিক নাই-বা হলুম, বয়ান-বকবকানো টুপি-আচকানপরা হুজুর নাই-বা হলুম … ভাবলুম, বরং রহি নীরব-নিথর দূরনিবদ্ধচক্ষু সুনির্জন … কবি ইমরুল হাসানের কবিতায় প্রাপ্ত ‘পলোগ্রাউন্ডের মাঠের মতো’ … ‘অথবা সকালে ঘুম থিকা ওঠার পর একটু বইসা থাকা’ হবে যখন, তখন রবীন্দ্রভক্ত-সমালোচক আবু সয়ীদ আইয়ুব সেজে ক্রিটিক করব ‘অতীব ঔস্যম’ বলে … এক-দুইটা বানানবিচ্যুতি কি চিত্রানুভূতি ‘ইমামের খুতবার সময় অন্যমনে’ (ইমরুল হাসানের কবিতার পঙক্তিচূর্ণ) এসে ঘাই মারবে চোখে … এবং যদি মারে, তো, তবেই তো কবিতাটা জারিত হয়েছে বুঝতে পারব হৃদয়ে আমার … কবিতার হয়ে ওঠা তো এই পথে এইভাবে, এর আগে যা-কিছু সব কবিতার আব্রুহরক অথবা ইন্ডিসেন্ট বাংলামাশটারি … ঈশ্বরী, সেইভ মি! … কিন্তু কবিকেও তো কবিতাপাঠপূর্বক কিছু-একটা ফিডব্যাক দেয়া স্বাস্থ্যচৈতন্যওয়ালা পাঠকের কর্তব্য, তা সেই ফিডব্যাক ভার্ব্যালি কিংবা আর-কোনো সুস্থায়ী-সাস্টেইন্যাবল ফর্মে যেভাবেই হোক-না-কেন, কবিকে সো-ফার সরাসরি তীর্যকতাহীন অবহিতকরণ উত্তম, সো, সোচ্চার হই এবে, এটুকু বলি শুধু, কবিতাটা ভালো লাগল … হয়তো পরক্ষণে এত ভালো-লাগা থাকিবেক না বজায়, কেন লাগিল ভালো ‘তা জানে ওই টসটসে ভিজে জামরুল’ … ওই পিককের ক্রিটিক … ওই সাকুরার শায়ের … কবিতা এইভাবে দোদুল্যমান সর্বখন হওয়া-না-হওয়ার হাওয়ায়, এবং বাস্তবিকই একটা ভালো কবিতা পড়ার পর এইসব বাক্য রইদে-ট্যানট্যানা মাঠের বালির মতো অনর্থ, নয়ছয় শব্দনিচয় … এইসবে একজন কবি কস্মিনকালেও ন দেবেন ভ্রুক্ষেপ ও কান।
- প্রকাশ্য সন্ধ্যায়, শীতে - January 4, 2025
- মর্মস্পর্শী মিসকিনদের দেশে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড - January 1, 2025
- যেহীন আহমদ, অনেক অনেক দিনের পরে… - December 12, 2024
COMMENTS