লেখার ব্রত ও লেখার খামার

লেখার ব্রত ও লেখার খামার

 

“খুব লিখতে ইচ্ছে করে। ফাঁকা ধু-ধু মাঠের মধ্যে বড় একটা ঘর। সেই ঘরের জানলার কাছে বসে আমি কেবল লিখে যাচ্ছি। ডাকের চিঠি ছাড়া অন্য কোনোভাবে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ নেই আমার।”

নিশ্চয়ই। লিখে উঠতে চাই কিছু ভালো লেখা। তা, আদৌ মন্দ নয় দিবারাত্রি নিশিগ্রস্ত স্বপ্ন দেখা। ভালো লেখার খোয়াব। ভালো লেখা বলতে কেবল কবিতা বা গল্প বা উপন্যাস বা প্রবন্ধ কচকচি ইত্যাদি নয়, নেসেসারিলি না, ভালো লেখার রূপ যে-কোনো অবয়বেই আসতে পারে। এমনকি একটা নোট কিংবা আটপৌরে চিঠিচাপাটি, ইত্যাদি, কি অন্যকিছুও হতে পারে। সেই লেখাটা এমন যে, একজন পড়ে ঠিকই বুঝতে পারবে এইটা ভালো লেখা, এমনকি নিজে আপনি লিখেও বুঝতে পারবেন সম্যক। তো, বলছিলাম, ভালো লেখা। পারব কি পারব না জানি না, আমি নিজে, কেবল আদাজল খেয়ে চেষ্টা চালায়া যাই। নিশিদিন ভাবনা চালাই, মকশো করি নিশিদিন, মহলা চালায়া যাই কিছু-একটা ভালো লেখার। কম তো নয়, দেড়-দশকের উপরে উঠল সচেতন স্বীয় লেখালেখির উদযোগ এবারে, এই দ্বিসহস্রতেরোয়, লেখা-লেখা খেলা আমার। তবু সচেতন, সংকল্পবদ্ধ, সত্যি সত্যি লেখা শুরু করতে পেরেছি কী আজও!

আজও আমি অসহায় রিহার্সাল চালাই, নিজে নিজে, ছালচটা-ওঠা আয়নায় একা একা রঙ মেখে ডায়লগ মারি। কিন্তু, হয়তো, কচুটাই হচ্ছে তাতে। ক্যালকাটা ডায়লেক্টে। কেবল কয়েকটা পাতা ভরাট হয়, এলাটিংবেলাটিং হয়, একটাকিছু অর্থ ও নন্দনপূর্ণ রচনা তাতে ওঠে না ফুটে। অথচ চারপাশে কতকিছু এখনো পড়ে আছে ভাষাহীন, মূক, বুঝে দেখতে চাই সেসবের মর্ম এবং বুঝেদেখে ভাষা দিতে চাই। সময়টাকে ঠিকঠাক ধরতে পারছি না আমি নিজে, কে পারছে বা পারছে-না কে সেদিকে তাকায়ে থেকে ফ্যাসাদ করার দরকার দেখি না। আমি শুধু জানি আমি নিজে কেবল উপরে-উপরে দেখে ও লিখে চলেছি দিনরাত। অথচ ভাবখানা যেন মহা আমি নির্মিত হয়েছি হ্বিটগেন্সট্যাইনের সাক্ষাৎ ভায়রাভাই!

কিন্তু পরানপণে এর থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। ইয়েস, আই ডু বিলিভ, অসম্ভব নয় বেরিয়ে আসা। যদি না-ই পারি বেরোতে, বাঁধিগৎ বুলি প্রকাশে যেয়ে কী লাভ! কোনো লাভ নাই, কোই ফায়দা নেহি হ্যায়। ভ্যাল্যু অ্যাড হবে না আধাচামচ, হবে কেবল ইগো-স্যাটিসফেকশন, অভ্যাসের প্রকাশফিকিরি। কিন্তু যাকে বলে চাষ করা অনাবাদী জমি, সেই কাজ হবেনাকো, ইতলবিতল চিতলমাছের পেটি হবে কেবল। হবে রেটোরিকের রবরবা। ভান হবে, ভনিতা আর ভড়ং হবে, ভালো লেখা বলা যাবে না সেসব কিছুকেই।

লিখতে পারলে লেখো ভালো, নয়তো অপ্রকাশিত রয়ে যাও একটি জীবন আরও, ভংচং নাইবা লিখিলে। ক্ষতি কী, বিস্তর বলে ফেনা তুলে মুখে শেষে অব্লিভিয়নে না-গেলে! কেবলি নামপ্রকাশেচ্ছু, শুধু শুধু যশলাভেচ্ছুদের দলে না-ভিড়িলে যদি — ক্ষতি কী! আমি চাই ফুল ফুটুক, ফল ফলুক, পাখি ডাকুক পরিচিত-অপরিচিত সমস্ত খামারে। এসো হে নবীন বাল্মিকী, খামার ভরিয়ে তুলি খলবলে লেখায়! আমার লেখার খামার…ভালোবাসার একলার খামার।…

“এলিয়ট বলেছেন মধ্যবয়সে পৌঁছে কবিদের সামনে তিনটে রাস্তা খোলা থাকে — ১. লেখা বন্ধ করা  ২. পুরনো লেখার আঙ্গিকগত উৎকর্ষসাধন  ৩. সম্পূর্ণ নতুনভাবে লেখা। যদি ষাট বছর বাঁচি, এখন আমার একত্রিশ, মধ্যবয়স। এলিয়টের কথাগুলো এবার আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। ভেবেচিন্তে একটাকিছু সিদ্ধান্ত নেব। নিতেই হবে।”

 এখন, হাজির এই বান্দা, আমি কী করব! আমার এখন কী করা উচিত! পরিস্থিতি তো ব্রতর সঙ্গে মিলে যাচ্ছে পুরো। অমিলও রয়েছে একটা জায়গায়, ‘হাঙরের দিন করাতের রাত’ কবিতাবইয়ের অন্তর্ভূত কবিতাটুকরোটি যখন প্রকাশিত হয়, ততদিনে ব্রত চক্রবর্তীর তিনের অধিক বই গিয়েছে বেরিয়ে, ব্রত ততদিনে পাঠকগ্রাহ্য খ্যাতিমান কবিই বলা চলে। এদিকে আমি তো অদ্যাবধি কিচ্ছুটি করে উঠতে পারি নাই। ব্রত কবি ছিলেন, কবি আছেন, কবি থাকবেন। অন দ্য কন্ট্র্যারি, কবিতা দেখলেই ভালুকের ন্যায় কম্প্র দিয়া জ্বর আসে আমার।

সুতরাং, আমার এখন কী করা উচিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তা এলিয়ট-নির্দেশিত ব্যবস্থাপত্র অনুসরণ করলে সিদ্ধান্তগ্রহণ দূরপরাহত হবে। দেখা যাক ব্যাপারটা খানিক খতিয়ে : ১. লেখা বন্ধ করব যে, লেখালেখি করলামটা কবে!  ২. আঙ্গিকগত ন্যূনতম একটা মান থাকলে তো উঠত উৎকর্ষের প্রশ্ন;  ৩. সম্পূর্ণ নতুনভাবে লেখার একটা চেষ্টা অবশ্য করা যায়, কিন্তু নতুনভাবে লেখার ব্যাপারটা তো মুড়ির মোয়া বা পাটালি গুড়ের পিঠা নয়।

শেষমেশ খুঁজছি, খুঁজেই যাচ্ছি, পাচ্ছি না পথ। বুড়ো বয়সে এসেও যদি পথের হদিস না-পাও, পাবাটা আর কবে হে! কে হবে এই পান্থজনের সখা! আবু সয়ীদ আইয়ুব হবার খায়েশও তো নাই তোমার, বাপু, রবীনজীবনও হইবার না-চাও। তো যাও, মরো গে! দিগন্তপরিপ্লাবী নিরাশায় দিনগুলি-রাতগুলি কাটছে, এরপরও অপেক্ষায়, একমুহূর্তের ভিক্ষামাগা গলিত স্থবির ব্যাঙ যেন।

জগদীশ্বর, লেখার দেবতা হে, লিখতে পারছি না। কাজেই ব্যর্থ ও মনোনিবেশহীন অন্য সর্বত্র কম্মেকাজে। একটুও চৈন নাই দিলে-দেহে। তুমি, হে দর্পণে-বসে-প্রসাধনরত দইয়ল প্রিয়তমা, উপভোগে-উদযাপনে কাটাতেছ দিন মাতোয়ালা। আমার এই অফলা দিনের দাঁতচাপা অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেব, তোমার সঙ্গে, সেই ফুরসতটুকুও নাই। ব্যস্ত রয়েছ ভুবনের সনে সখ্য স্থাপনে, তুমি হে তা-না-না-না, আমি তো অমনধারা বাজারযোগ্য নহি যে আমারে দেখায়া ভুবন মাতাবা তুমি! হে চাঁদ, ভুবনায়নের, হে গিরগিটি কৃষিবিনাশের!

জাহেদ আহমদ


এই সিরিজের অন্যান্য রচনা

জাহেদ আহমদ

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you