পণে আনা (পণ করে আনা) তীর্থ, তাই নাম ‘পণাতীর্থ’। কিন্তু হালফিল দু-একটি স্থানীয় দৈনিক লিখছে ‘পণতীর্থ’, ‘পনতীর্থ’ বা ‘পূণ্যতীর্থ’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কেউ কেউ এ-সমস্ত পত্রিকাকে অনুকরণ করছেন।
আমরা অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখেছি, প্রাচীন বই-পত্রপত্রিকা প্রভৃতিতে পণাতীর্থই লেখা আছে। দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বৃহৎ বঙ্গ’, অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ প্রভৃতি আকর গ্রন্থে এমনকি প্রাচীন কামরূপ অঞ্চলের ইতিহাসবিদ পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদও পণাতীর্থ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সাধারণ্যেও এই নামটি প্রচলিত। আবহমানকাল থেকে প্রচলিত নামটিকে বিকৃত করার এই অপচেষ্টার কারণ কী হতে পারে? নিছক পাণ্ডিত্য ফলানোর মানসিকতা? নাকি সেরেফ অজ্ঞতা?
প্রাচীন রেণুকা নদীর (বর্তমান নাম যাদুকাটা) তীরে বাস করতেন সাধক অদ্বৈত মহাপ্রভু। তাঁর মায়ের গঙ্গাস্নানের তীব্র বাসনা ছিল। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁর ইচ্ছা পূরণের উপায় ছিল না। মায়ের ইচ্ছা পূরণের জন্য অদ্বৈত পণ করে বসেন। কথিত আছে, যোগসাধনা বলে তিনি পৃথিবীর সমস্ত তীর্থের জল একনদীতে একধারায় প্রবাহিত করে দিয়েছিলেন। আর এভাবেই জন্মলাভ করে এক মহাতীর্থস্থান — পণাতীর্থ।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় এই তীর্থ অবস্থিত। যাদুকাটা পাহাড়ি নদী হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য হয়ে দেখা দেয় ধুধু বালুচর। চৈত্র মাসের নির্দিষ্ট তিথিতে এই শুষ্ক নদীবক্ষে বৃষ্টিবাদল ছাড়াই হঠাৎ করে বান ডাকে। এই তিথিতে প্রতি বছর এখানে লাখ মানুষ সমবেত হয়। বিশ্বাসীরা পাপ স্খালনের লক্ষ্যে নদীর জলে স্নান করেন। এই স্নানকে বারুণী স্নানও বলা হয়।
প্রকৃতপক্ষে চৈত্রমাসের ত্রয়োদশ তিথির নাম বারুণী। ‘বারুণী’ শব্দটি জলের দেবতা ‘বরুণ’-এর নাম থেকে সৃষ্ট। লোকায়তিক বিশ্বাস, বারুণীর দিনে দেশের সকল নদী গঙ্গার মতো পবিত্রতা লাভ করে। তাই এই তিথিতে নদীর জলে স্নান করলে পাপক্ষয় হয় এবং পূণ্য অর্জন হয়। কিন্তু পণাতীর্থে কেবল গঙ্গাই নন, সকল তীর্থের সম্মিলন ঘটে। এই কারণে বলা হয়, “সকল তীর্থে বারবার, পণাতীর্থে একবার”। যদি তাই হয়, তবে পণাতীর্থে স্নান করাকে কেবল ‘গঙ্গাস্নান’ বলা কতটুকু যৌক্তিক? কিন্তু ইদানীং তাও শোনা যাচ্ছে!
একই সময় এই তীর্থভূমির অদূরে অবস্থিত সাধক হযরত শাহ্ আরেফিন (রহ.)-এর মোকামে অনুষ্ঠিত হয় ওরস। তাঁর মূল মোকাম সীমান্তের ওপারে। কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের আগে অনুষ্ঠানের সময় সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেওয়া হতো। দুই দেশের মানুষ অবাধে দুই তীর্থে যাওয়াআসা করতে পারতেন। ভারত কর্তৃক কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের পর থেকে আমাদের সীমানায় ওরস অনুষ্ঠিত হয়। তীর্থ ও ওরস উপলক্ষ্যে দু-জায়গাতেই বসে মেলা। একই সময়ে অনুষ্ঠান থাকায় এই দুই পূণ্যভূমি পরিণত হয় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের মিলনতীর্থে। বছরের এ-সময়টিতে এই বিরানভূমি লাখ জনতার উপস্থিতিতে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। অবশ্য এই সুযোগে কিছু প্রভাবশালী চক্র বিপুল পরিমাণ টাকাকড়ি কামিয়ে নিতেও বিন্দু পরিমাণ কার্পণ্য করে না।
সে-যা-ই হোক, একটি ঐতিহাসিক তীর্থস্থানের যুগ-যুগ-ধরে প্রচলিত নামটি আকস্মিকভাবে পরিবর্তন ঘটানোর অপচেষ্টা সত্যি অনাকাঙ্ক্ষিত।
- রচনায় ব্যবহৃত ব্যানার ও ভিতরকার আলোকচিত্র রচয়িতার সৌজন্যে পাওয়া — গানপার
কল্লোল তালুকদার রচনারাশি
গানপারে পণাতীর্থ ও তদানুষঙ্গ
- ১০ কবিতা || হোসনে আরা কামালী - June 26, 2025
- ঘুম ও না-ঘুমের গদ্যলেখা || ফজলুররহমান বাবুল - June 12, 2025
- অবসাদ ও অন্যান্য || জওয়াহের হোসেন - June 11, 2025
COMMENTS