আম্মার বিষাদ-সিন্ধু পাঠ
আমরা সুবোধ দুইবোন
পড়ার টেবিলকে অস্বীকার করে
সন্ধ্যায় আম্মার পালঙ্কে পড়তে বসতাম
শুয়ে শুয়ে যেদিন আম্মা
বিষাদ-সিন্ধু পড়তেন
নবির বংশ কতল হওয়ার শোকে
আম্মার কণ্ঠ অ্যাপোলো মন্দিরের দৈববাণীর মতো
ছড়িয়ে পড়ত আমাদের ব্যাকরণবই অবধি
‘রে সীমার! রে পাষাণ হৃদয় সীমার!
কী দুঃখে তুমি এত ত্রস্ত দৌড়াইতেছ?’
অমোঘ সত্যের মতো আমাদের দু-চোখের নোনতা পানি
তারও অধিক বেগে দৌড়াতে থাকে
তবু ভিতর-খালি-করা সে-স্রোত
আমরা উজানে ঠেলে দিতে চাইতাম
তখন ষত্ববিধি আবছায়ার মতো লেপ্টে থাকত বইয়ের পাতায়
আম্মার তেজস্বী কণ্ঠ শিশিরের মতো
ভেঙে পড়ত বারবার
পড়াভোলানিয়া এক জগতে আমরা হাঁটতাম
বরফের ওপর দিয়ে গা ছমছম ভয় নিয়ে
বালুময় তীব্র তাপের শহর কুফা
আমাদের তখন কাবু করতে পারত না!
আম্মার বিষাদ-সিন্ধুপাঠ সেই কতকাল আগে
তবু সীমারের ধারালো ছুরি আজও অনির্বাণ
প্রতিনিয়তই নির্মম পালাবদল কাঁটার মতো বিঁধে হৃৎপিণ্ডে
আম্মার শিশিরমাখা কণ্ঠ আর সন্ধ্যাসংগীত নয়
তবু আমরা কান পাতি দূরে—
কুফার মরুভূমি থেকে কখন ভেসে আসবে সুর
হাসন-হোসেন কতল হওয়ার শোকের মতো
অভিসম্পাতিত রাহু পেরিয়ে আম্মার শিশিরকণ্ঠ
বারবার ভেঙে পড়বে, মাতম করবে
সময়-বেসময় শুধুই আমাদের জন্য।
মাতৃত্ব
মাতৃত্ব আসার আগেই মা হলেন তিনি
দুধবরন জোছনায় থইথই তার কোল
ছাওয়ালের কান্না শোনাার আগেই টের পান তিনি
সাদা জোছনার প্লাবন ঢেকে দিচ্ছে লহুর জোয়ার
শরীর থেকে ছেড়ে যাচ্ছে নতুন শরীর
ঝিকঝাক জীবনছবিগুলো উড়ে যাচ্ছে আকাশ ফেড়ে
কেবল জেগে ওঠে দুধধোয়া মুখ
লাল রক্তনহর আর অন্ধকার কবর
কবরের আন্ধাইর একসময় আলোয় ঢেকে গেল
জোছনা-ছাওয়াল হামাগুড়ি দেয়, কাঁদে হাসে কথাও বলে
তিনি টের পান জঠরে জোছনার নতুন বান
এইবার আশ্চর্য স্বপ্নের ভিতর হাঁটলেন তিনি
আহা রে ভ্রূণের ছাওয়াল,
ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে,
নড়ে, হাত পা ছোঁড়ে
পেটে লাথি মারে
মাতৃত্ব তার আসমানের ফকফকা আলো যেন
মাটির ছাওয়াল ততদিনে নেমেছে মাঠে
হেঁটে চলে পথে অথবা বেপথে—
বিচ্ছেদের কেবলই হলো শুরু!
বুবু
হাঁটতে হাঁটতে পা দেবে যায়, তবু হাঁটি
মাটির আখরে আঁকা চর্যাজনপদে
পলির শরীরজুড়ে কেবলই বেদনার দাগ
কোন পথে এলাম আমরা তবে
বুঝি হারিয়েই গেলাম জন্মপথ বেয়ে
চাঁদ-তারকা লাশঘরে হিম হিম লহুর শরীর
শেষরাতে শৃগালের শোরগোল
যতই বাড়তে থাকে
কবিতার ঘরটি কেবল শূন্যে ওড়ে
ধূমকেতুর পুচ্ছের মতো ঝরে পড়তে চায়
আর আমি কেবল বুঝতে চেয়েছিলাম
তাদের হৃদয়ে কোনওদিন কোনও গান ছিল কি না!
মধুমতি নদীর ধারে—
নির্জন একলাবেলার সময়
না মনে পড়ে না
আমি তবু তার শীতল ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
জানি না ঠিক কতকাল
কতকাল ছিলাম অপেক্ষায়—
লহুর সাগর পেরিয়ে ক্লান্ত ফুলগুলো ঝরে পড়লে
মনফুলই যেন হয়ে যায় তীব্র মিসাইল
ঘায়ের রক্ত শুকালে পরে
রোদে শুকাতে দেই মন
অঘ্রানের ধানের মতো, মাঠময়—
ছড়িয়ে রাখি তার ঘ্রাণ, বিছিয়ে রাখি মায়া
ঘ্রাণ
রোদেরা ভিজে না
কেবল ভিজে যায় তার ঘ্রাণ
রঙচোখে লেগে থাকে পুরনো কাজল
মানুষ হেমন্তের মাঠ, ছায়াহীন
আমারে নিয়া চল সাতবিলায়
ধ্যানী শীতসরালির কাছে
এবার আমার শিক্ষা শুরু হোক।
আমার শহর
বন্ধু বলে—‘তোমার শহর’
ওই কি তবে আমার শহর
ঠিক মনে নেই কোন সে প্রহর
পায়ের নিচের শক্ত পিচে
হারিয়ে গেছে খোয়াব সকল
আমার নিদান খুব গোপনে
এই আমারেই পোড়ায় কেবল
আমার শহর ঠিক অচেনা প্রেমের মতন!
দূরত্ব
ওপারের নদী বড় শীর্ণ
এপারের নদী তাই ছুঁয়ে দিতে পারে না
তার শরীর
চার চোখ হয়ে ওঠে আরও বড় সরোবর
জল লেপ্টে থাকে জলের বিনিময়!
কে আমারে পথে নিলো ডাকি
কে আমারে পথে নিলো ডাকি,
বলি গেল ফাল্গুনের হাওয়ায়
তেতো ঘুমের আসরে
যেন কক্ষপথের নিদাঘ ছায়ায়
আমি জীবন প্রদক্ষিণ করি।
বুঝি মায়া গলে গলে পড়ে
আঙুলের ফাঁক দিয়ে
কেন বিস্ময় জাগিয়ে রাখে নদের চাঁদ
যাও পাখি
ধানের চেনাঘ্রাণে ফেরা হলো না
এবার গিন্নির খোলাচুল বড় শ্রীহীন
হিমকবরী তেলের অভাব এই শহরে
করোটিতে পোড়া আতরের ঘ্রাণ
পায়ের তলে শাহপাথরিয়ার মাটি
শিশিরচুয়া দিন শেষে
অথবা লুকোচুরির সকাল-বিকাল
শেষতক এই জীবন পাখির ডাকে জাগবে তো!
সারিগুটি হিজলে
মাটির পেটভরা বিষ
অমরাবতীর স্বপ্নযাত্রায় দ্রাবিড় সানাই
ফুল ফুল ফুল টি
তেল টি
জাম টি
গালভরা বাবল
চোয়ালের কোনায় বিষদাঁত
সুষম সুষম সুষম টি
এ কে দুঃসুষম টি
কোথায় সাকিন
আবুখালির পাড়ে ক্রন্দন থেমে নেই
যুদ্ধকথা
খামোখার এলেমবাজি
তারাজাম তারাজাম টি
একে দুত্তারাজাম
কদম কদম টি
এ কে দূর কদম টি
আমার ফুলেল শৈশব কেঁদে কয়!
ফেরা
যেদিন ফিরব—
আমি চাই বৃষ্টিতে ভিজে
আরও সবুজ হয়ে যাক শাহারপাড়া
আমাকে স্বাগত জানাক একদল সান্ধ্য জোনাক
আলোর পাহারায় নিয়ে যাক শেষ গন্তব্যে
আমি চাই—যেদিন ফিরব
বাঁশতলায় বেগুনি ফুলগুলো
ঠিক সূর্যোদয়ের আগেই
তাদের পাপড়ি মেলে ধরুক
সুঘ্রাণ ছড়াতে থাকুক
সারাদিন শোকার্ত স্বজনের মাঝে
আমি কোনও কোলাহল চাই না আজ
জনমমাটি যেন বিদার দেও
অনায়াসে আমাকে কোলে তুলে
বন্ধ করো আপন কপাট।
যেদিন আমি ফিরব আমার প্রথম ও শেষ আশ্রয়ে
আমি জানি আবুখালিতে তখন হাঁটুপানি
তবে সেদিন হতে হবে ভরাবর্ষা
মন বলে ঝমঝম বৃষ্টিতে
আমার স্বাচ্ছন্দ্য নাওয়া হয়ে যাবে!
হোসনে আরা কামালীর ১০ কবিতা গানপারপ্রকাশ জুন ২০২৫
গানপারে হোসনে আরা কামালী
গানপার কবিতার, কবিতার গানপার
- লোককবি তাজউদ্দিন ও তাঁর গান || জফির সেতু - November 25, 2025
- শাহজালাল শাহপরান গ্রামবাঙলায় গাজির গান || তুহিন কান্তি দাস - November 22, 2025
- আমাদের গ্রামের নাম আমাদের নদীর || কাজল দাস - November 19, 2025

COMMENTS