আবুল হাসান মারা যান ১৯৭৫ সালে। তখন এবং তারপর আরো বহুবছর তিনি তরুণদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি ছিলেন। তবে তার জনপ্রিয়তাকে নব্বই সালের আগে খুব পজিটিভলি দেখা হতো না। বড়রা ভাবতেন আবুল হাসান ‘কিশোরমনস্ক’ কবি। সেন্টিমেন্টাল কবি।
কেন এমনটা ভাবতেন তারা?
আমার ধারণা, আবুল হাসান সত্তরের দুইটা গ্রান্ডন্যারেটিভকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলেন। এক, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। দুই, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন। তার বদলে তিনি তার কবিতায় অত্যন্ত ইনোসেন্টভাবে এঁকেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের ডিস্টোপিক চেহারা। যে-চেহারা আমরা ছাড়া ছাড়া ভাবে মাহমুদুল হকের গল্পে দেখেছি, ফকির আলমগীর কিংবা আজম খানের গানে পেয়েছি। কিন্তু আবুল হাসান তাদের আরো আগেই এই অন্ধকার-সত্তর নিয়ে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এটাই ছিল সত্তরের বৃহত্তর তরুণ সমাজের পালস। কিন্তু বড় দুই ন্যারেটিভের ডামাডোলে মেইনস্ট্রিমে সে বেশি জায়গা পেত না। বিষাদের এই বয়ানকে হয় ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ না-হয় ‘পাতিবুর্জোয়া সেন্টিমেন্ট’ বলে উপহাস করা হতো।
যে বড় দুই ন্যারেটিভের কথা বললাম, তার আকর ছিলেন নির্মলেন্দু গুণ। পাশাপশি, উন্মুল জীবন যাপনের কারণে তিনি লেজেন্ড হয়ে উঠেছিলেন। গুণ ও হাসানের বন্ধুত্ব আমাকে আজো বিস্মিত করে। কোনো আদর্শিক যোগাযোগ তাদের মধ্যে দেখি না। একজন প্রবল আশাবাদী, নানা কিছুর আগেই সমাজতন্ত্র চাইতেছেন! অন্যজন রাত জেগে নুলো ভিখিরির গান আর দারিদ্র্যের অভিমান দেখতেছেন।
গুণ মাঠে ও দরবারে সমান জনপ্রিয় ছিলেন, কারণ তিনি প্রচুর আশাবাদ ছড়াতে পারতেন। সেটার দরকারও ছিল রাজনৈতিকভাবে। আর আবুল হাসান দেখাতেন চাঁদের অন্ধকার পিঠ। কেন তারা পরস্পরকে ভালোবাসতেন?
মহাদেব সাহা অবশ্য এরচেয়েও বড় প্রহেলিকা। তাঁকে লোকে কেন পড়ে? তিনি জনপ্রিয়, কথা মিথ্যা নয়। মিষ্টি মিষ্টি কিশোরী-পটানো প্রেমের কবিতাই কি এর কারণ? নাকি তার ওয়েল-ম্যানেজড পোয়েটিক পারসনা? আমার ধারণা, তাঁর কবিখ্যাতির পেছনে তার ধবল কেশরাশি, গেরুয়া পাঞ্জাবি আর কাঁধের ওপর একপাশে ভাঁজ করে ফেলে রাখা চাদরটির ভূমিকাও কম নয়। তবে তাঁর প্রসঙ্গে সেই হুজুরের দোয়াটিও মনে পড়ে, যিনি মোনাজাতে বলেছিলেন, হে আল্লাহ অনেকগুলো ভালো বেগুনের সাথে দোকানদার যেমন দুয়েকটা খারাপ বেগুন পার কইরা দেয়, তেমনি আমরা কয়েকজন গুনাহগার বান্দাকে তুমি তোমার নেকি বান্দাদের মাঝ দিয়া পার কৈরা নিও!
- গালিবের কবিতা ও তৌহিদি জনতা || সুমন রহমান - February 17, 2025
- অভ্রবিপ্লব || সুমন রহমান - February 13, 2025
- কথাসাহিত্যিকের প্রস্থান : ফেয়ারোয়েল টু ফয়জুল ইসলাম || সুমন রহমান - January 26, 2025
COMMENTS