কবিতা-সংক্রান্ত জিজ্ঞাসা নিয়ে আমরা কত আলাপ করি, নানান ভাষায় লেখা (কাঠামোর দিক থেকে) কত রকমের কবিতার কথা শুনি এবং যথাসম্ভব পড়িও। নানান ভাষায় কবিতার কত রকম সংজ্ঞা — বর্ণনা। কত সংজ্ঞায় — বর্ণনায় কবিতার কতশত চোখ, মুখ। কবিতার ঝুলবারান্দা, অলিগলি, রাস্তাঘাট বিচিত্র। নানান সময়ে কবিতার নানান সৌন্দর্য — রূপ। বস্তুত কবিতা কী, কোথায়ই-বা পাওয়া যায় তাকে, এবং কবিতার কোনও উপযোগিতা আছে কি না আমাদের জীবনে, সব ক্ষেত্রে তা বোঝার মতো বোধ/উপলব্ধি সমাজে সকলেরই থাকে বলে আমরা ভাবতে পারি না। নিজে বুঝতে পারি না, কবিতাকে শনাক্ত করতে সত্যি কোনও সংজ্ঞা-বর্ণনা কাজে লাগে কি না। মনে হয়, কোনও সংজ্ঞা-বর্ণনায় কবিতাকে ঠিকঠাক শনাক্ত করা যায় না।
আমরা জানি যে, কবিতা কোনও অলীক ব্যাপার নয়। মনুষ্যপৃথিবীতে সত্যিই কবিতা বলে একটা-কিছু আছে, এবং এর দীর্ঘ ইতিহাসও আছে। কবিতার দেখা পেতে — কাব্যপ্রভাকে উপলব্ধি করতে আমাদের আপন কাব্যবোধশক্তির উপরে নির্ভর করতে হয়।
‘কবিতা’ অভিধায় নানান রচনা পাঠ-উত্তর কাব্যপ্রভাকে ঠিক বুঝে ওঠা হোক বা না-হোক, নানান ভাষায় কবিতার সংজ্ঞা/বর্ণনা যেমন নানান রকম, তেমনই কবিতা এবং তার পাঠকও আছেন নানান রকম। কবিতাকে উপলব্ধির সামর্থ্য বা অভিজ্ঞতা সব পাঠকের সমান হওয়ার কথা থাকে না। আমরা বিশ্বাস করতে পারি, পাঠক-শ্রোতার বোধ-উপলব্ধির আলোয় কবিতা ধরা পড়ে, অর্থাৎ কবিতার সঙ্গে দেখা হয়। সবসময় না-হলেও মাঝে মাঝে দেখা হয়। কবিতা জিনিসটা কবির ভাবনার ডালপালা বেয়ে যাতে স্থিত হয়, তা শব্দ, এবং পাঠক শব্দরূপ থেকে কবিতাকে পান। কিন্তু, যেখানে শব্দ, সেখানেই কি কবিতার আশ্রয়? না, আসলে তা-ও নয়। এক্ষেত্রে মনে হয় কবি-প্রাবন্ধিক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বক্তব্যের অংশবিশেষ থেকে আমরা কিঞ্চিৎ সহায়তা নিতে পারি। নীরেন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, “কবিতা আসলে শব্দ নয়, বরং শব্দকে ব্যবহার করবার এক রকমের গুণপনা। ভাষার মধ্যে যা কিনা অন্যবিধ একটি দ্যোতনা এনে দেয়।” (দ্র. ‘কবিতার কী ও কেন’ — নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)। শব্দ উপস্থাপন করে ভাব — অর্থ — চিত্র — ব্যঞ্জনা। কবিতাকে আমরা শুধু শব্দরূপে বিবেচনা করতে পারি না, ভাব/বিষয়বস্তুকে বিবেচনায় নিই। আমরা অনুমান করতে পারি যে, ভাব-কল্পনার সঙ্গে কবির শব্দ-ব্যবহারের গুণপনা, অর্থাৎ — জুতসই প্রকাশভঙ্গির অনুকূলে কাব্যপ্রভা পুষ্টি লাভ করে।
কবিতা ও শব্দ সমার্থক — এমন বিবেচনার বাইরে থেকে এমনকী নন্দনতত্ত্ব বা ভাষাতত্ত্বের দিক থেকে ব্যাপারটি ঠিক রীতিসিদ্ধ নয় জেনেও বলতে চাই, কেবল উপলব্ধির দেউড়িতে একটি ঘুঘুর গানসহ বিশ্বপ্রকৃতির যতটুকু অনুভব-অবলোকন করি, ততটুকুকেই প্রকৃতির এক রহস্যময় কাব্য মনে হয়। মনে হয়, কবির জীবনপারে কবিতা ঘুঘুর গানের মতো কিছু। হ্যাঁ, কবিতা ঘুঘুর গানের মতো কোনও দ্যোতনা/ব্যঞ্জনা; ভালোবাসার — আনন্দের কিংবা বেদনার। সত্যিই আমরা জানি না, ঘুঘুর গানে/সুরে বস্তুত কী ব্যক্ত হয়। জানি না ঘুঘুর গান আসলে আনন্দ নাকি বেদনা, নাকি তার কোনওটাই নয়। তবে উপভোগ করা যায়। কোনও পাখিহৃদয়ের সঙ্গে মনুষ্যহৃদয়বৃত্তির কোনও তুলনা হয় না নিশ্চয়। পাখিদের কলকণ্ঠের সঙ্গে মনুষ্যহৃদয়ের তুলনা করা না-গেলেও বা কোনও অর্থময় যোগাযোগ না-হলেও আমাদের ভাবতে অসুবিধা নেই যে, অক্ষরজ্ঞানহীন ঘুঘুপাখিরা তাদের ভাষায়, সুরে-ছন্দে ভাব-অনুভূতিই প্রকাশ করে, যেমন একজন কবি তাঁর ভাব-অনুভূতিকে রূপময় করেন আপন কাব্যে (শব্দে—ছন্দে)।
পাখিজগতে কবিদের মতো কোনও শব্দার্থ/উপমা/ব্যঞ্জনা নিয়েও ভাবাভাবির দরকার পড়ে না। মানুষের মন জোগানোর কোনও বিদ্যানুশীলনও পাখিজগতে নেই। তবে, পাখিগান কোনও তাৎপর্য কিংবা উদ্দেশ্যের বাইরে থেকে মনুষ্যহৃদয়ে স্বতন্ত্র আনন্দানুভূতি সৃষ্টি করে। কাব্যে আনন্দানুভূতির প্রত্যাশা থাকলেও আনন্দানুভূতিমাত্রকেই আমরা কাব্য অভিধায় শনাক্ত করি না, শনাক্ত করি শব্দের সেই আধারে, যেখানে কবির ভাব-চিন্তার উৎসরেখায় একটা তাৎপর্য, সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়, কিন্তু কোনও পাখি-গানকে আমরা সোজাসাপটা কবিতা বলি না।
ঘুঘু কিংবা অন্যকোনও পাখির কলকণ্ঠে কোনও ভিন্নপাঠ থাকুক বা না-থাকুক, তা বিশ্বপ্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যের অংশ। কাব্যের পাঠক-শ্রোতা হিশেবে আমরা অনুরক্ত-মুগ্ধ হই, কাব্যকে শিল্প-মর্যাদায় নিরূপণ করি, কিন্তু প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যে মুগ্ধ-বিস্মিত হলেও প্রকৃতিকে শিল্প বলে শনাক্ত করি না। বাবুইপাখির বাসা আমাদের মুগ্ধ করে। বাবুইপাখিরা খড়কুটো দিয়ে যে-চমৎকার বাসা বুনে, তা দেখে আমরা পুলকিত হই এবং বাবুইপাখিদের ওই গুণপনার জন্য ‘শিল্পী-পাখি’ বলি। যদি সকল জাতের পাখি বাবুই পাখিদের মতো বাসা বুনতে পারতো তাহলে তো আমরা বাবুইপাখিদের আলাদাভাবে শিল্পী-পাখি বলে চিহ্নিত করতাম না।
কথা হল, মানবসমাজে শিল্প (Art) আসলে কী, এর উত্তর সহজে দেওয়া যায় না। অতি সংক্ষেপে একটা দায়সারা গোছের জবাব হতে পারে যে, শিল্প এক বিশেষ গুণপনা — যা সকলের মধ্যে থাকে না। কাব্য একটা শিল্প (Art)। কাব্যস্রষ্টা একজন শিল্পী; দ্রষ্টা/কল্পনাবিহারী। কবিসৃষ্ট কাব্য ও অন্যান্য শিল্পমাধ্যমে প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্য/সৌন্দর্য নানাভাবে ধরা পড়ে।
জেনে অবাক হই, হাল আমলেও পৃথিবীর কোনও কোনও অঞ্চলে পাখির (শিসের আদলে) ভাষায় একে-অপরের সঙ্গে যোগাযোগ/ভাব বিনিময় চলে। যোগাযোগের মাধ্যম হিশেবে মানুষের মধ্যে পাখির শিসের ব্যবহার অনেক পুরনো। স্পেন, তুরস্ক, গ্রিসের কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে আজও লোকেদের মধ্যে পাখির ভাষা অর্থাৎ পাখি-শিসের সাহায্যে যোগাযোগের কাজটা চলে। জানি না, আদিম মানুষেরা পাখির ভাষা ব্যবহার করতো কি না, ব্যবহার করলে কীভাবে এবং কী কী কাজেই-বা করতো, তা জানা গেলে ভালো হতো। যা-ই হোক, কেবল একটি গায়ক-পাখির গানের সঙ্গে আমাদের পরিচিত হলেই কবিতাসম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হয় না। যদি এভাবেই কবিতাকে চেনা বা চেনানো যেত, তবে এই প্রসঙ্গে এত আলাপের দরকার হত না। কেবল ঘুঘু নয়, কোকিলসহ কত পাখি গায়, আর আমরাও বুঝি যে — প্রকৃতির শিল্পালয় থেকে পাখিরা আপন-আপন গানে যেভাবে সুন্দরতা (fineness) পায় ঠিক সেভাবেই মনুষ্য গানে-কবিতায় সুন্দরতা হয় না। যে-কোনও গানের অবশ্য কোনও-না-কোনও অভিযাচন বা গুণ আছে। মানুষ গান রচনা করে এবং গায়। মানুষ ভাষার সাহায্যে জ্ঞানের চর্চা করে। পাখিরা সহজাত বৈশিষ্ট্যে গায়, কিন্তু শব্দ-ধ্বনির সাহায্যে জ্ঞানচর্চা করতে পারে না। পাখি কিংবা অন্যকোনও প্রাণী মানুষের মতো ধ্বনি সৃষ্টি বা উচ্চারণ করে মানুষের পক্ষে বোধগম্য অর্থজ্ঞাপক শব্দ/বাক্য তৈরি করতে পারে না।মানুষ্যপ্রতি়ভার সঙ্গে তুলনা করার মতো প্রাণিজগতে কোনও বহুমুখী সৃজনশীলতার নজির নেই। কবিতা মনুষ্যপ্রতিভাজাত।শব্দ কবিতার মাধ্যম, এমন কথা আমরা জানি; আর জানি — যে-সব শব্দে কবিতার রক্তমাংস তাতে বিশেষ গুণপনার কাঙ্ক্ষা থাকে। স্রেফ শব্দের সমাবেশকে আমরা কবিতা হিশেবে গ্রাহ্য করি না; একাধিক গুণবৈশিষ্ট্যেই গ্রাহ্য করি। ভাব-কল্পনার আলোকে কবিতার শব্দবিন্যাসটা সর্বতোভাবে সেরা হতে হয়। শব্দবিন্যাসের ত্রুটি কাব্যপ্রভাকে নিশ্চয় জীর্ণ করে।
বিচিত্র শব্দমুখরিত এই পৃথিবীতে কবিতা আসলে কী, এবং কী বলতে চায়, এমন জিজ্ঞাসা আমার মনেও নিভৃতে হাজিরা দেয়। জবাবসন্ধানে মনোযোগ দিতে গিয়ে দেখি বড্ড ঘুম পায়! আসলে এই ঘুমকাতরতা কি প্রশ্ন থেকে পালানোর জন্য কোনও দেউড়ি?
শুনতে পাচ্ছি, ঘরের বাইরে বৃক্ষডালে বসে ঘুঘু ডেকে চলেছে আপন মনে। ‘ডেকে চলেছে’ বলছি কেন, ‘গান গাইছে’ বলছি না কেন! আমি কি ঘুঘুর ভাষা বুঝতে বা তার অনুভূতির সঙ্গে নিজের অনুভুতি মেলাতে পারছি? এ তো কোনও দুর্বোধ্য পাখি-লিমেরিক! হায় তবু ভালো লাগছে আর কোনও-এক সত্য ও সুন্দরকে উপলব্ধি করছি, সুর-ছন্দ বাজছে কানে, প্রবেশ করছে প্রাণে। ভালো লাগছে আর ঘুম পাচ্ছে আর আমার মনে হচ্ছে এ-ও তো এক ছন্দময় রচনা! আমি কি একে ‘প্রকৃতির কবিতা’ বলতে পারি না? প্রকৃতির মধ্যে কি কোনওরকম কবিতা নেই? যদি থাকে, তবে কোন ভাষায়? ঘুঘু কিংবা কোনও গায়ক-পাখির দুর্বোধ্য গানের/লিমেরিকের কোনও উপযোগিতা আছে কি আমার জীবনে? আমি বুঝি, যখন আমার ঘুম পাচ্ছে তখন উপযোগিতার দিক থেকে ঘুঘুর গান/লিমেরিক আমার শোবার ঘরে বিছানা-বালিশ থেকে বেশি দরকারি নয়। ঘুম পেলে আমার ঘুমোনো দরকার। তাই না? কিন্তু, ঘুঘুর গান আমাকে কি শুনতেই হবে? আর, জীবনে সবকিছুই কি আমরা কেবল কোনও উপযোগিতার মানদণ্ডে বিচার করব? ঘুঘু কিংবা কোকিলের গান ভালো লাগে, আর এটা শুনতে না-চাইলেও কখনও-সখনও শোনা যায়। গাছের ডালে বসে ঘুঘু আপন মনে গান গায়।
কবিতাকে আমরা আদিম শিল্প বলেই জানি, কিন্তু এটা জানি না যে, পৃথিবীতে মানুষ প্রথম-প্রথম ঘুঘু, কোকিল কিংবা অন্যকোনও গায়ক পাখির গান শুনেই কাব্য-গান সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল কি না।
একটা দুর্বোধ্য কবিতার/লিমেরিকের আলোকে আজ কেন আমি ঘুঘুর দুর্বোধ্য গান/লিমেরিক শুনতে চাই? ঘুঘুর গানে কি শ্রবণযোগ্য কবিতার কোনও অনুষঙ্গ নাই? কবিতার স্বপ্ন মাঝেমধ্যে এক অলৌকিক পাখি, ঘুঘু কিংবা কোকিলের মতো হঠাৎ গেয়ে চলে, উড়ে চলে হৃদয়-বনে। ঘুঘু-কোকিল সবসময় গেয়ে চলে না। কবিতার মুহূর্তও আসে না সবসময়, মাঝেমধ্যে আসে। কবিকে কবিতার জন্য অপেক্ষা করতে হয়; অনুসন্ধান করতে হয়।
কবি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে। কবিতা কোনও স্বপ্ন দেখা — চোখ খুলে কিংবা চোখ বুজে। কখনও সকাল লাফিয়ে চলে দুপুরের দিকে, তারপর বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যার পানে পা বাড়ায়। কত মেঘের ছায়া, রৌদ্রপথ ভেঙে অভীপ্সা সমাগত হয় একটি কবিতার দুয়ারে, তা কি ঠিক বুঝতে পারি আমরা? কোনও শীতরাতে কখনও কুয়াশা-গাঢ় ঠান্ডা হাওয়ায় দূরের বনে বৃক্ষডালে পাতায় পাতায় ঝেঁকে বসে নীরবতা, পাখিরা থামায় কলরব আর কিছু ঝিঁঝি কেবল গান গেয়ে চলে অদূরে, আর মনে হয় কারও জন্য লেখা যায় একটি কবিতা, যে-কবিতার জন্য আলো-অন্ধকারে সাঁতরানো যায় হিমশীতল দিঘি-জলে! স্বপ্নের তরঙ্গে এটা কি কেবল কোনও উষ্ণ-উজ্জ্বল আবেগের গলিপথে এক শিল্পীহৃদয়ের তৃষ্ণা, উচ্ছ্বাস?
কবিতা হঠাৎ ঝেঁকে বসে আর কবির হৃদয়ে জাগে বজ্রবিদ্যুৎ। এইরকম মুহূর্তে কবি কেনই-বা কবিতার কোনও উপযোগিতাকে খুঁজতে চাইবে? কবি জানে না ঠিক কবে কখন যে সোনালি-রুপালি পাখির ডানায় কাঙ্ক্ষিত কবিতাকে পাবে। জানে না। কোনরকম উপযোগিতার বাইরে আসলে কবিতা কবির কাছে একইসঙ্গে একটি স্বপ্ন এবং সত্য।
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
- মাসুম পারভেজ : কবি, কাব্যগ্রন্থহীন || সরোজ মোস্তফা - February 7, 2025
- ছত্তার পাগলার সন্ধানে আহমেদ স্বপন মাহমুদ ও সরোজ মোস্তফা - January 28, 2025
COMMENTS