কবিরে পাবা না তুমি জীবনচরিতে, এমন একটা বাক্য সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের বরাত দিয়া আমরা মুখজবানি দিসি আমাদের বাল্যে। এইটা কি ঠিক যে কবিরে পাবো না আমরা জীবনচরিতে? কবিরে না-পাই, কবিতারে তো পাই। জীবনচরিত থেকে একজন কবির কাজে তথা তার কবিতায় আরেকটু ঘনসন্নিবিষ্ট প্রবেশ পথ ও পন্থা আমরা খুঁজে নিতে পারি। জীবনানন্দের বা উৎপলকুমারের আপাতদুর্বোধ্য অনেক পঙক্তির পাঠোদ্ধারে তাদের জীবনচরিত তথা নানাবিধ সাক্ষাৎকার, অ্যানেকডোট্যাল ইত্যাদি থেকে ক্লু নিয়া আমরা অ্যাক্সেস পাইসি অনেক দূর পর্যন্ত যাবার। ব্যাপারটা যে-কোনো কবির ক্ষেত্রে সত্য।
জয়দেব বসু, জয় গোস্বামী, নির্মল হালদার, একরাম আলি, নিশীথ ভড়, সুব্রত রুদ্র, সব্যসাচী দেব ও ভাস্কর চক্রবর্তী — এই আট কবির অতি নিরুপম অন্তরঙ্গ ছবি পাই আমরা প্রতিমা ঘোষের আপনজন ক’জন কবি শীর্ষক বইটায়। এর মধ্যে দুইজন কবি — নিশীথ ভড় সব্যসাচী দেব — ওইভাবে এখানকার কারো পঠনপরিচিত না-হলেও অন্যরা প্রায় সকলেই বাংলাদেশে কবিতাপাঠকদের কাছে পরিচিত ও কয়েকজন তো বহুল পঠিত বলা যায়। আট কবির মধ্যে জয়দেব বসু ও ভাস্কর চক্রবর্তী আলোচ্য বইটা ড্রাফটের আগেই জীবনাবসিত। তা, যাক। বইটা নিয়া খানিক বলা যাক।
মোটমাট ১৬০ পৃষ্ঠা, পাক্কা ১০ ফর্মা, বইয়ের কলেবর। তবে রেগ্যুলার বুকসাইজ নয়। এর সাইজটা পকেটসদৃশ নয় আবার নিয়মিত পুস্তকসদৃশও নয়। কিউট একটা সাইজ। বইনকশা, পাতাবিন্যাস, টাইপসেট সমস্তই রিডারফ্রেন্ডলি। বইটা বাইর হয়েছে কলকাতা থেকে, ‘পাঠক’ নামে এক প্রকাশনী এর পাব্লিশার, ২০১৫ সনে। এর লেখক প্রতিমা ঘোষ।
আচ্ছা। এই বই সম্পর্কে একটা কথা এইভাবে বলে নিতে পারি যে এ ভীষণ সুন্দর ও সহজ স্বরভঙ্গির বই। যেন কবি-অষ্টক নিয়া কেউ খোলা আড্ডায় কথা বলতেসে, এমন ভঙ্গির বই। আটজন কবির ফটোগ্র্যাফ ইউজ করা হয়েছে লেখারম্ভের আগে একটা আস্ত পাতায়। মার্জিত উপস্থাপন। কবি নিয়া আলোচনা সাধারণভাবে যেমন হয়া থাকে, এ তেমন না। আলোচনা না। এই বই ভীষণ স্নেহকণ্ঠী, ভীষণ মমতাদ্রাবী, ভীষণ বাৎসল্যোসারী গদ্যে লেখা। যারা এই কবিদেরকে কিংবা এদের একজনকে বা একাধিকেরে পছন্দ করেন তাদের কাছে এর মূল্য আলাদা হবে বলা যায়। আর যারা আদৌ কবিতার বা এই কবিদের কাউরেই সাবস্ক্রাইব করেন না তারা খামাখা পড়তে যাবেন কেন? যদিও পড়তে শুরু করলে ভাল্লাগবে কবিতাসান্নিধ্যছাড়া পাঠকেরও।
প্রতিমা ঘোষের গদ্য সম্পর্কে একটা ধারণা পাবার ক্ষেত্রে এই বই যে-কেউ পড়ে দেখতে পারেন। উনি ঠিক নিয়মিত অথার নন। তবে এর আগে ‘নয় বোনের বাড়ি’ শীর্ষক একটা বই রিলিজ হয়েছিল উনার। কম করে হলেও দশক-দেড়দশক আগের ঘটনা সেইটা। তা-ও পড়তে পারেন কেউ গদ্যানুসন্ধানী হলে। ভাল্লাগবে। যেমন এইটাও। অটোবায়োগ্র্যাফিকতায় কেমন করে নৈর্ব্যক্তিক একটা মিজাজ রক্ষা করা যায় তার নজির এই ইরেগ্যুলার লেখকের গদ্যে কেউ খুঁজে দেখতে এবং পেতেও পারে।
যে-কারণে সুন্দর ও সহজ স্বরভঙ্গির বই একে বলা হচ্ছিল, অন্তরালে এরও রয়েছে একটা কারণ। গদ্যে-ধৃত প্রত্যেক কবিকেই লেখক দেখেছেন দিনের পর দিন ধরে, দশকজুড়ে, ঘরোয়া আসরে-আড্ডায়। এই দেখাটাই ধৃত প্রতিমার গদ্যে। কেমন করে এমন আট-আটজন তৎকালের তরুণ কবিকে লেখক ফলো করে যেতে পারলেন এত লম্বা টাইম ধরে? ফেসবুকটেসবুক তো তখন ছিল না। তখন বলতে সেই সত্তর বা আশি ইংরেজির সময়টায়। সেই সময়টাই উঠে এসেছে এখানকার পৃথক আটখানা গদ্যে। কেমন করে পেরেছেন ফলো করে যেতে এত কবিরে একসঙ্গে, এর রিপ্লাই হচ্ছে যে লেখকের বাসায় নিয়মিতই ছিল এই আট এবং আরও অসংখ্য কবির আনাগোনা। কারণ, লেখকের স্পাউসের নাম শঙ্খ ঘোষ।
ফলে লেখক অত্যন্ত মমতায় দেখতে এবং লিখতে পেরেছেন বইটা। নানান অনুষ্ঠান, ভ্রমণ, চিঠিপত্র ও বহুবিধ অনুষঙ্গ ব্যবহৃত হয়েছে এর ন্যারেশনে। এবং ব্যবহৃত হয়েছে কবিদের কবিতাপঙক্তি ভীষণ লাগসইভাবে। এইখানেও বলা আবশ্যক যে এমনভাবে কবিতার উদ্ধৃতি সাঁটা হয়েছে, যে-দুইজন কবি অত পঠিত/পরিচিত নন তাদের সম্পর্কেও পড়ুয়ার আগ্রহ জন্মাবে। অবশ্য জয় গোস্বামীর ‘গোসাঁইবাগান’ বইপ্রবাহের কোনো খণ্ডে এই দুই কবি সম্পর্কে এর আগে পাঠক হয়তো পড়ে থাকতে পারেন।
এই কিসিমের বই কবিতার ভালো বৈ মন্দ করে না। পাণ্ডিত্যদর্পী ক্রিটিকমিমিক্রি কবিতার খুব-একটা কাজে আসে না। আলোচনার নাম ভাঙিয়ে এই বই কবিবিজ্ঞাপনী বা কাব্যরসিকের মনযুগানি বই এইটা না। স্বাদু গদ্যাশ্রয়ে একটা সাধু ননফিকশনের এই বই সাধারণের কাছে গ্রাহ্য হবে, এতে সন্দেহ করা কাজের কিছু না।
লেখা : মিল্টন মৃধা
… …
- অন্তরঙ্গ কবিচিত্র - January 28, 2021
- সঞ্জীব চৌধুরী : জীবনতথ্য - November 19, 2019
- বাঁশি ও বিচ্ছেদী - November 16, 2019
COMMENTS