ইলিয়াস কমল গ্রন্থিত হয়েছেন পয়লাবারের মতো। অভিষেক ঘটেছে তার, ২০১৭ সনের বইমেলায়, ‘অতিরিক্ত বাগানবাড়ি’ কবিতাবইয়ের মধ্য দিয়ে। সে-বছর বইটি প্রকাশ করেছিল ঐতিহ্য প্রকাশনী।
ইলিয়াস কমল কবিতা লিখছেন বর্তমান দশকের গোড়া থেকে। কোয়ান্টিটি বিবেচনায় অল্পপ্রজ হলেও কমলের কবিতাকাজের কোয়ালিটেইটিভ কন্টিন্যুয়েশন চোখে পড়ার মতো। সংখ্যায় নেহায়েত অল্পও বলা যাবে না তার প্রকাশিত কবিতা, যদিও মুহুর্মুহু প্রকাশ ও প্রচার থেকে এই কবিকে সতর্কভাবেই বিরত থাকতে দেখা গিয়েছে সবসময়। এবং এই বিরতপ্রকাশের প্রবণতা আন্দাজ করা যায় স্বেচ্ছাচয়িত। ফলে কমলের কবিতায় সেই সারল্যভরা রাহসিকতা অটুট রয়েছে প্রায় প্রাকৃতিক স্বতঃস্ফূর্ততায়।
তিন-তিনটি ভিন্ন পর্যায়বিভাজিকার আওতায় বিন্যাস্ত হয়েছে গোটা বাগানবাড়িটি। বিভাগত্রয়ীর ভিতরে অন্তর্ভূত কবিতাবলির মধ্যে একপ্রকার সুচয়িত সংগীতমূর্ছনা লাভ করা যায়, যেমনটা বাদী এবং বিবাদী স্বরের সম্মিলনে একটা বন্দিশ গড়ে ওঠে, যেমনটা আলাপ-আস্থায়ী-অন্তরা-সঞ্চারী-আভোগ মিলেমিশে একটা গানসৃজনের সম্পূর্ণাঙ্গ।
কমলের কবিতারাজিতে এমন একপ্রস্ত সহুজে স্বরগ্রাম লভ্য, এমন একটা আধচেনা-আধবোঝা জাগতিকতা, স্বস্তির সঙ্গে একটা আগ্রহও জন্মায় এর পঙক্তিবিতরিত অন্যতর অর্থোত্তোলনে। এহেন অনুসন্ধিৎসার ফল আখেরে যা-ই হোক, সন্ধিৎসু করে তোলা প্রাথমিক ও প্রধান ভূমিকাই বলা যায় কবিতার। বলা বাহুল্য, কবিতাপাঠকের অভিপ্রেত অনুসন্ধান আর গোয়েন্দা বা নার্কোটিক ডিপার্টমেন্টের অ্যাসাইনমেন্ট-অফিসারের অনুসন্ধান এক জিনিশ নয়। ইলিয়াস কমলের কবিতাপঙক্তি পাঠককে এক সদর্থ কবিতাচ্ছন্ন অনুসন্ধানপানে ন্যাভিগেইট করতে চায়।
ভিরিদিয়ানার বাড়ির পানে পাড়ি দিয়ে শেষপর্যন্ত কবি কি গিয়ে পৌঁছালেন সহিসালামতে? শেষপর্যন্ত চরিতার্থ হয়েছে কি কভু মনুষ্যহৃদয়? এইখানেই কবির জিৎ যে, শেষপর্যন্ত ‘পৌঁছানো’ বলিয়া আদৌ কোনো লৌকিক ক্রিয়া নাই পৃথিবীতে, এই পথে থাকার মধ্যেই নিহিত কবিতা, পথানুবর্তী থাকাই জীবন, প্রথানুবর্তনের পাঁচশ ক্রোশ দূর দিয়ে সেই পথানুবর্তন, পথেই শিল্প পথেই কবিতা। আলাপ অত চওড়া না যদিও, ছোট্ট করে কবি ভীষণ রহস্যাঢ্য বলে নিচ্ছেন কীভাবে, শুনি :
ভিরিদিয়ানার বাড়ি যাব।
বাসস্টপে বসে আছি।
আমাদের ছেড়ে গেছে মেঘ।
এই পথে আর ফিরবে না কৈশোরের জাহাজ।
নাবিকের ডানার মতো এলোমেলো — ভিরিদিয়ানার পথ।
আমি তোমার পথেই যাব
লক্ষণীয়, অলক্ষে এসে গেল ‘তুমি’ সর্বনামটি, প্রক্ষিপ্ত মনে হলেও প্রক্ষিপ্ত সে নয়। এ-ই হলো কবিতাম্যাজিক। কমলের কবিতা এইভাবেই নিশ্চেষ্ট কল্পনা ধারাবাহিকভাবে পাঠকসমক্ষে প্রেজেন্ট করে। যেমন, আরেকটা জায়গায় :
যে বন্ধুকে পাহাড় দিয়েছিলাম
সে গতকাল তা ফেরত দিয়ে গেছে;
এবার আমি হাসপাতাল উপহার দিলাম
এবার বেজায় খুশি — সে জানে
আমার পাহাড়ের চেয়ে হাসপাতাল প্রয়োজন ছিল বেশি।
নিশ্চেষ্ট অনায়াস গল্প বলেন কমল কবিতাকৌশলে :
মৃত ছিলাম কি কখনো? কখনো কি জেগে ছিলাম পুনর্জন্মে?
সেই গল্পের কথা বলি আজ — একটা ঘোড়া ছিল লাল-নীল ডোরাকাটা
রেসের ময়দানে ছিল না তার দৌড়
অন্তিমে কী হয় এই গল্পে, এই ছদ্মবেশী কিন্নরের আখ্যানভাগে? রেসকোর্সে না-দৌড়ানো ঘোড়াটার হালফিল জানতে চাইলে যেতে হবে এই অতিরিক্ত বাগানবাড়ির ধারে, এই বইটির পাশে যেয়ে বসতে হবে দু-দণ্ড, আঙুল বুলিয়ে নিতে হবে এর পালক ও পাখনায়।
ইলিয়াস কমল প্রণীত কবিতাগ্রন্থ পয়লা বালামের প্রচ্ছদশিল্পী রাজীব দত্ত, প্রকাশ করেছেন আরিফুর রহমান নাইম, ঐতিহ্য প্রকাশনীর ব্যানারে একুশে বইমেলায় এই বই ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে বেরিয়েছে বিশ্বের আলোজলবায়ুভূপৃষ্ঠে।
অ্যানিওয়ে। কবির কাছে মনে হলেও কবিতাপাঠকের কাছে এই বাগানবাড়িটি অতিরিক্ত নয়, রিপোর্টারের যেমন হয়েছে মনে, এ অনিবার্য ও অবধারিতই।
অতিরিক্ত বাগানবাড়ি। ইলিয়াস কমল প্রণীত কবিতাগ্রন্থ। প্রচ্ছদপ্রণেতা রাজীব দত্ত। প্রকাশকর্তা আরিফুর রহমান নাইম। ঐতিহ্য প্রকাশনী ঢাকা থেকে ২০১৭ বইমেলায় প্রকাশিত।
প্রতিবেদন / সুবর্ণ বাগচী
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS