উর্দু ভাষায়, ফারসি ভাষায়, আরবি ভাষায়, এমনকি ইংরেজি ভাষাতেও মহানবি হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর জীবনীগ্রন্থের অভাব নেই। বাংলা ভাষায় নবিজির জীবনী লেখা শুরু হয়েছিল কাহিনিকবিতার মাধ্যমে। মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি সৈয়দ সুলতানের ‘নবীবংশ’ এবং ‘রসুল বিজয়’ নামে নবি মুহম্মদ (সা.)-এর জীবনভিত্তিক দু’টি কাহিনিকাব্য রচনা করেছেন। বলা যায় বাংলা ভাষায় কবিতার মাধ্যমে রাসুলের ব্যক্তিত্ব ও মহিমাকে তিনি প্রথম প্রচার করেন। কাহিনিকাব্যের মহত্তম উত্তরাধিকারে বিংশ শতাব্দীর কবি রওশন ইজদানী রাসুল (সা.)-এর উপর একটি পুরো কাব্য ‘খাতামুন নবীঈন’ রচনা করেন ১৯৬০ সালে। ইসলামিক পুনর্জাগরণের কবি ফররুখ আহমদ ‘সিরাজাম মুনীরা’ নামে ৩০২ পঙক্তির একটি দীর্ঘ কবিতা লেখেন ১৯৫২ সালে। কিন্তু এর কোনোটিকেই মহানবি হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ বলা যাবে না।
বাংলা ভাষায় গদ্যে হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর জীবনী প্রথম কে লিখেছেন — এ সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। মুহম্মদ রেয়াজউদ্দিন আহম্মদ তাঁর ‘হযরত মুহম্মদ মোস্তফার জীবন চরিত’ গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন যে ভাই গিরিশচন্দ্র সেনই সর্বপ্রথম রাসুলের জীবনচরিত বাংলা ভাষায় লিখে প্রকাশ করেন। গ্রন্থটি বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য। শেখ আবদুর রহিম দ্বিতীয় জীবনীলেখক। শেখ আবদুর রহিমের গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ সালে। ‘হযরত মুহম্মদ’ শিরোনামে তৃতীয় গ্রন্থটি লেখেন রামপ্রাণ গুপ্ত। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এই জীবনী প্রকাশিত হয় ১৯০৪ সালে। কাছাকাছি সময়ে কৃষ্ণকুমার মিত্রের লেখা ‘মুহম্মদ চরিত’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ১৯০৮ সালে আবুল হোসেনের লেখা ‘হযরত মুহম্মদের জীবনী’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। তসলীম উদ্দিন আহমদের লেখা ‘সম্রাট পয়গম্বর’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে। মাওলানা আকরম খাঁর ‘মোস্তফা চরিত’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯২১ সালে। কবি গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবী’ প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে। মাওলানা আবদুল খালেকের লেখা ‘ছাইয়েদুল মুরছালীন’ গ্রন্থটি দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। দুই খণ্ড মিলিয়ে গ্রন্থটির পৃষ্ঠাসংখ্যা ৮০৮। সৈয়দ আলী আহসানের মতে বাংলা ভাষায় লেখা এটিই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং রাসুলুল্লাহর সর্ববৃহৎ জীবনী।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর লেখা ‘শেষ নবীর সন্ধানে’ গ্রন্থটি রাসুলের পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ নয়। মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর ‘মরু ভাস্কর’ সহজ ভাষায় তরুণদের উপযোগী করে লেখা একটি প্রাণবন্ত রসুলজীবনী। ইয়াকুব আলী চৌধুরীর ‘মানব মুকুট’ এবং ‘নূরনবী’ গ্রন্থদ্বয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের বিভিন্ন দিক বর্ণিত হয়েছে। শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হকের ‘হযরত মুহাম্মদ’ এবং কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘মরু ভাস্কর’ গ্রন্থদ্বয়ও উল্লেখযোগ্য রাসুলজীবনী। ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত কাজী আব্দুল ওদুদের ‘হযরত মুহম্মদ ও ইসলাম’ নামে গ্রন্থটি রাসুলের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচিত হয়েছে।
যাদের কথা উল্লেখ করেছি এরা প্রত্যেকেই বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠতম মনীষা। মহানবির প্রতি শ্রদ্ধায় প্রত্যেকটি গ্রন্থই অনন্য। কবি গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবি’ যারা পড়েছেন তাদের অনুরোধ করবো সৈয়দ আলী আহসানের ‘মহানবি’ গ্রন্থটি পড়ার জন্য। বাংলা ভাষায় লেখা দুটোই পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ। আমার বিবেচনায় নবিপ্রেমে সমর্পিত হয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পূর্ণাঙ্গ একটি জীবনী লিখেছেন মুস্তফা জামান আব্বাসী। কী লেখনীর বিস্তারে, কী দরদী মহিমায়, কী ভাষাসৌন্দর্যে তাঁর লেখা ‘মুহাম্মদের নাম’ নিঃসন্দেহে একটি অনন্য গ্রন্থ।
সম্প্রতি আমার অত্যন্ত সুহৃদ-সহচর এনাম আহমেদ উপহার দিয়েছেন ‘তোমাকে ভালোবাসি হে নবী’ বইটি। তিনি আমেরিকায় থাকেন। আরেকজনের মাধ্যমে আমাকে বইটি উপহার দিয়েছেন। গ্রন্থটি পড়তে পড়তেই এই লেখাটি লিখেছি। মূলত গুরুদত্ত সিংয়ের উর্দুতে লেখা ‘রাসুলে আরাবি’ গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ। অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে নবিপ্রেমে মুগ্ধ একজন শিখ লেখক পরম আত্মীয়তা দিয়ে নবি মুহম্মদ (সা.)-এর জীবন ও শিক্ষাকে তুলে ধরেছেন। গ্রন্থটি শুধু জীবনী নয়, বরং নবির প্রতি লেখকের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার এক অনন্য নিদর্শন। অনুবাদক আবু তাহের মিছবাহ সাহেব যথাসম্ভব মূল রচনার ভাব ও আবেগকে অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। গ্রন্থটি মানবতার, ভালোবাসার, সহিষ্ণুতার, পারস্পরিক শ্রদ্ধার এক উজ্জ্বল স্মারক। হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর জীবনী লেখার পাশাপাশি তাঁর প্রেমে সমর্থিত হয়ে কবিতার মতো করে গুরুদত্ত সিং লিখেছেন :
“প্রিয়তম! তোমার দর্শনসৌভাগ্য লাভে না-হয় বঞ্চিত হলাম, তাই বলে স্বপ্নের বাতায়নপথেও কি একবার নসিব হতে পারে না তোমার দিদার!
হে মুহাম্মদ। তোমার দর্শনসৌভাগ্য একবার যে লাভ করেছে, শুনেছি হৃদয় তার তোমাতেই চিরসমর্পিত হয়েছে। চোখে তোমার প্রেমের সুরমা একবার যে মেখেছে স্বর্গমর্ত্যের সকল সৌন্দর্যের মোহ থেকে তার চিরমুক্তি ঘটেছে। পাথরও নাকি সোনা হতো তোমার পরশগুণে! পাষাণ হৃদয়ও নাকি মোম হতো তোমার ‘দৃষ্টি’ পেয়ে! তাহলে এদিকে হোক-না একবার সে-করুণাদৃষ্টি! তোমার নূর তাজাল্লির একটুখানি ‘প্রসাদ’ লাভের আশায় দুয়ারে তোমার হাত পেতেছে হিন্দুস্তানি এ ভিখারী। দোহাই তোমার প্রেমের! বঞ্চনার দহনে আর দগ্ধ করো না এ অভাগাকে!” (হৃদয়ের আকুতি, ‘তোমাকে ভালোবাসি হে নবী’)
সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
গানপারে বইরিভিয়্যু
- ভাট কবিতার দিনলিপি || সরোজ মোস্তফা - June 1, 2025
- ফকিরের রত্নরাজি || সরোজ মোস্তফা - May 21, 2025
- মুস্তাফা জামান আব্বাসী : অবদান তাঁর অবিনাশী - May 14, 2025
COMMENTS