বৈশাখে হাওরাঞ্চলের মাঠে মাঠে চলে বোরো ধান কাটার মহোৎসব। দিনমান কিষাণ-কিষাণীদের ব্যস্ততার শেষ নেই। গৃহস্থ পরিবারের আঙিনায় চলে ধান মাড়াই ও শুকানোর কাজ। এরপর জ্যৈষ্ঠ মাস। নদী উপচে নতুন পানি ডুবিয়ে দেয় মাঠ-ঘাট। সমুদ্রের রূপ নেয় পুরো হাওরাঞ্চল। যখন-তখন বৃষ্টি, ফলে কাদা-পানিতে থিকথিক করে গ্রাম-গ্রামান্তর। এই মৌসুমেই হাওরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে বসে বাউলগানের আসর। মঞ্চ কাঁপিয়ে হেলেদুলে বাউল-গায়কেরা রাত জেগে গান পরিবেশন করেন। এগ্রাম-ওগ্রাম থেকে ছুটে আসেন কিশোর থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত। এভাবেই চলে আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক মাস।
আষাঢ় ও কার্তিক মাসের কথা উঠলেই মনে পড়ে উকিল মুনশির কথা। হাওরাঞ্চলে যিনি ‘বিরহী বাউল গাতক’ নামে সুপরিচিত। একটু আগে যে বললাম — আষাঢ় ও কার্তিক মাসের কথা এলেই তাঁর কথা মনে পড়ে, সেটা কেন? কারণ একটাই — উকিল মুনশির লেখা বহুল প্রচলিত সেই গান :
আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে
পুবালি বাতাসে —
বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি
আমারনি কেউ আসে রে
যেদিন হতে নতুন পানি
আসলো বাড়ির ঘাটে
অভাগিনীর মনে কত শত কথা ওঠে রে
কত আসে কত যায় রে
নায়-নাইওরির নৌকা
মায়ে ঝিয়ে বইনে বইনে
হইতেছে যে দেখা রে
আমি যে ছিলাম ভাই রে
বাপের গলায় ফাঁস
আমারে যে দিয়া গেল
সীতা বনবাস রে
আমারে নিলো না নাইওর
পানি থাকতে তাজা
দিনের পথ আধলে যাইতাম
রাস্তা হইত সোজা রে
ভাগ্য যাহার ভালো নাইওর
যাইবে আষাঢ় মাসে
উকিলেরই হইবে নাইওর
কার্তিক মাসের শেষে রে
এই গানটি এতই জনপ্রিয় যে, বর্ষা মৌসুমে হাওরের গ্রামগুলোতে অনুষ্ঠিত প্রায় বাউলগানের আসরে এটাই প্রথম গীত হয়। গানের আবেদনও অসম্ভব। গানের পদে পদে এক অভাগিনী গৃহবধূর চরম আর্তনাদ আর বেদনা ফুটে উঠেছে। এ যেন এক দুঃখগাথা। ‘নাইওরি’ যাওয়ার আশায় দিন গুনছেন সেই গৃহবধূ। কিন্তু বাবার বাড়ির কেউ নাইওর নিতে আসছেন না। ‘তাজা পানি’ ধীরে ধীরে কমছে, পুবালি বাতাসে পাল উড়িয়ে কতশত নৌকা আসছে-যাচ্ছে, কিন্তু কারও দেখা নেই। তাই তো গৃহবধূর আফসোস — ‘কত আসে কত যায় রে, নায় নাইওরির নৌকা, / মায়ে ঝিয়ে বইনে বইনে, হইতেছে যে দেখা রে।’
এ গানটি প্রসঙ্গে অধুনা উকিল মুনশির লেখা গান গেয়ে ব্যাপক পরিচিতি অর্জনকারী গায়ক বারী সিদ্দিকী বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সরাসরি সম্প্রচারিত গানের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি’ বললেই মনে বিরহভাব চলে আসে। গানের কথায় পল্লিগাঁয়ের এক নারীর দুঃখ-বেদনার কাহিনি লুকিয়ে আছে। তার দুঃখ নাইওর যেতে না-পারার দুঃখ। ‘আমারে নিলো না নাইওর, পানি থাকতে তাজা’। কী করুণ কথা!’
গানটির প্রসঙ্গে গবেষক গোলাম এরশাদুর রহমান লিখেছিলেন : ‘এ গানটি হাওরাঞ্চলের জীবন ও সংস্কৃতির জীবন্ত রূপ। যে কোনোদিন হাওরাঞ্চল দেখে নাই, এ গানটি তার হৃদয়েও আঘাত করতে সক্ষম। আধুনিককালের কোনও কবি-সাহিত্যিকের রচনায় হাওরাঞ্চলের চিত্র এমন সুন্দর জীবন্ত করে ফুটে ওঠেনি। কারণ উকিল মুনশির রচনায় ছিল হৃদয়ের পরশ। আবদুল হক আকন্দ ওরফে উকিল ইমামতি করে উপাধি লাভ করলেন “মুনশি”। আর বাউলগানে প্রবেশ করে সবার নিকট থেকে লাভ করলেন বিরহী সনদ। মনে হয় তাঁর কণ্ঠে অত্রাঞ্চলের সমস্ত প্রেমিক-প্রেমিকার সুর ধ্বনিত হয়েছে।’
এই তো সেদিন সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে এক গানের অনুষ্ঠানে জনৈক সুপরিচিত শিল্পী এই গানটি গেয়েছিলেন, কিন্তু কেন যেন তাঁর সুর আমাকে স্পর্শ করেনি। যেমনটা স্পর্শ করেছিল নেত্রকোনার অখ্যাত এক শিল্পী আফসার উদ্দিনের কণ্ঠে। আহা, সে কী টান — ‘উকিলেরই হইবে নাইওর, কার্তিক মাসের শেষে রে’ … আফসার উদ্দিনের কণ্ঠে আরও একটি গান শুনেছিলাম, সেটিও উকিল মুনশির লেখা। টেলিভিশন-বেতারের কল্যাণে এই গানটিও ব্যাপক জনশ্রুত —
আমার শ্যাম শোক পাখি গো
ধইরা দে ধইরা দে।
পাখি দেয় না ধরা, কয় না বুলি, কয় না কথা গো
ধইরা দে, ধইরা দে।।
কত দুগ্ধ-কলা খাওয়াইলাম
কী যতনে পুষিলাম গো।
তবু পাখি দিয়া ফাঁকি
উইড়া বেড়ায় ডালে ডালে গো
ধইরা দে ধইরা দে।।
পাখির প্রেমে জীবন-যৌবন
উকিল মুনশি দেয় বিসর্জন গো
পাখি পাশে থাকে, মাথায় বসে
ধরতে গেলে যায় দূরে।।
এই গানটি নাকি উকিল মুনশি মৃত্যুর আগে সবসময়ই বিড়বিড় করে গাইতেন। নেত্রকোনার বাউলগীতি বইয়ের লেখক গোলাম এরশাদুর রহমান এমনটাই জানিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘প্রখ্যাত বাউলসাধক উকিল মুনশি ষাটের দশকে এসে আসরে গান পরিবেশন থেকে অবসর নেন। […] বৃদ্ধ বয়সে ঘরে বসে একা একা শুধু গান করতেন। আর গানে আপন মনে কাঁদতেন। শেষ জীবনে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় গান ছিল এটি।’
একই লেখক উকিল মুনশির শেষ বয়সের কণ্ঠের বর্ণনা জানাতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘তাঁর কণ্ঠের বিচ্ছেদ শোনার জন্য, সেই সময়েও রাত্রিকালে গ্রামবাসীর ভিড় জমতো।’ প্রায় একই ধরনের কথা শাহ আবদুল করিমের কাছ থেকে আমি শুনেছিলাম। ২০০২ সালের দিকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি আমার কাছে উকিল মুনশির গান সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। আমি বরং সেটুকু তুলে দিচ্ছি :
প্রশ্ন : আপনি তো উকিল মুনশির সঙ্গে একমঞ্চে গান করেছেন। সে-সম্পর্কিত কিছু স্মৃতি শুনতে চাচ্ছি।
শাহ আবদুল করিম : উকিল মুনশি বয়সে আমার অনেক বড় ছিলেন। বেশ কয়েকবার বাউলগানের আসরে উকিল মুনশির সঙ্গে গান গাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। অসম্ভব ভালো ছিল তাঁর গানের গলা, গানে টান দিলেই মানুষ চুপ হয়ে যেত। এই ধরনের কণ্ঠ এ অঞ্চলে আর একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না।
প্রশ্ন : উকিল মুনশি তো মালজোড়া গানও গাইতেন।
শাহ আবদুল করিম : গাইতেন, তবে শেষ বয়সে উনি আর মালজোড়া গাইতেন না। ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে বাউলগান গাইতেন।
প্রশ্ন : আর তাঁর ছেলে আবদুস সাত্তার?
শাহ আবদুল করিম : আবদুস সাত্তার আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি বাপের মতোই মালজোড়া গানে খুব পটু ছিলেন। আমরা দুইজনে মিলে নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জে অনেক আসরে মালজোড়া গেয়েছি। আমাদের দুজনের মধ্যে এই গানটা জমতোও বেশ। অবশ্য আবদুস সাত্তার বাউলগানও খুব ভালো গাইতেন-লিখতেন।
প্রশ্ন : এবার আবার উকিল মুনশি সম্পর্কে জানতে চাইছি।
শাহ আবদুল করিম : কি জানতে চাইছ?
প্রশ্ন : এই যেমন তার গায়নভঙ্গি, জনপ্রিয়তা, কেমন মানুষ ছিলেন?
শাহ আবদুল করিম : মানুষ তো ভালোই। বিরহের গান বেশি গাইতেন বলেই তার নামও পড়ে গিয়েছিল ‘বিরহী উকিল মুনশি’। তাঁর গান হাওরাঞ্চলের মানুষ খুব ভালোবাসত।
শাহ আবদুল করিমের কথোপকথন থেকে উকিল মুনশির বিরহী সত্তার বিষয়টি ফুটে ওঠে। একই ধরনের ইঙ্গিত আমরা গোলাম এরশাদুর রহমানের কাছেও পাই। এ পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর মতামত নিম্নরূপ :
বন্ধু আমার নির্ধনিয়ার ধন রে
তোরে দেখলে জুড়ায় জীবন আমার
না দেখলে মরণ রে।।
এ গানে সমস্ত ব্যর্থ প্রেমিকের আর্তনাদ পুঞ্জিভূত হয়েছে। তাই গান গেয়ে গেয়ে কেঁদেছে উকিল। অশ্রুবিন্দু পড়ছে টপ টপ করে গড়িয়ে। উপস্থিত দর্শকশ্রোতারাও নয়নের জলে ভাসিয়েছে বুক। এ গানের ‘চিতার অনল জ্বলে চিত্তে’ উপমাটি সত্যি অপূর্ব। প্রিয় হারানোর ব্যথায় হৃদয়যন্ত্রণা প্রকাশে এর চেয়ে সুন্দর উপমা খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাই তাঁর গানের আবেদন নিঃশেষ হবার নয়। তার পাশাপাশি প্রেমপিয়াসীর আকাঙ্ক্ষা প্রকাশেও তাঁর রচনা অতুলনীয়। তাঁর কণ্ঠের এসব বাউলগান ছিল অত্রাঞ্চলের প্রাণ।
এমন শুভ দিন আমার কোনদিন হবে
প্রাণনাথ আসিয়া আমার দুঃখ দেখিয়া
নয়নের জল বন্দে-নি মুছিয়া নিবে।
বাউল উকিলের কণ্ঠের এ গান আর মৈমনসিংহ গীতিকার তালাকনামাপ্রাপ্ত মদিনার আকাঙ্ক্ষার মাঝে তফাৎ কোথায়? মদিনা যেমন তালাকনামা পেয়েও স্বামীর আগমন-অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে দিন গুনছেন। এ গানে উকিল মদিনার মতো সকলের আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এক-কথায় তাঁর অসংখ্য গানে বিরহ এক জীবন্ত সত্তা লাভ করেছে। বিরহের এমন সুন্দর প্রকাশ আধুনিক বাংলাসাহিত্যেও বিরল। বিরহের গভীরদেশে ছিল উকিলের বিচরণ। তাই তিনি ছিলেন বিরহী উকিল। গভীরভাবে চিন্তা করলে মনে হবে মৈমনসিংহ গীতিকার মহুয়া, মলুয়া, কমলা, সোনাই, মদিনা সহ সমস্ত মানবপ্রেমের হৃদয়ের যন্ত্রণা ধ্বনিত হয়েছে উকিলের মরমি সুরে। তাই উকিল ছিলেন মৈমনসিংহ গীতিকার মানবপ্রেমের চেতনার উত্তরাধিকার। তাঁর কণ্ঠে গীত —
বন্ধু বিফলে গেল নবযৌবন
আগে দিয়া প্রতিশ্রুতি
হবে চিরসাথী
কেড়ে নিলে অবলার মন।।
এ গানটি যারা উকিলের কণ্ঠে একবার শুনেছেন, তাঁরা সহজেই বুঝে নিতে সক্ষম, কেন তিনি ছিলেন অত্রাঞ্চলের বিরহী উকিল। বাউলগানে বিরহের বাস্তব প্রকাশে উকিল মুনশি ছিলেন তুলনাবিহীন। সেই ক্ষেত্রে লালন শাহ, কালু শাহ, হাসন রাজা পর্যন্ত হার মানতে বাধ্য।
শাহ আবদুল করিম আমাকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে উকিল মুনশিকে ‘বিরহী’ অভিহিত করলেও তাঁর আত্মস্মৃতিতে তাঁকে ‘ভাবের সাগর’ অভিধায়ও চিহ্নিত করার পাশাপাশি তৎকালীন নেত্রকোনা ও সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার বাউলগানের বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। সেটা তাঁর আত্মস্মৃতি থেকে তুলে দিচ্ছি :
ময়মনসিংহে বাউল তখন ছিল বিস্তর।
রাত্রে নয়, দিনের বেলা বসিত আসর।।
এই পরিবেশে তখন মিশে পড়লাম।
বিভিন্ন গানের আসরে যোগদান করলাম।।
তৈয়ব আলী, মিরাজ আলী, আবদুস সাত্তার।
খেলু মিয়া, দুলু মিয়া, মজিদ তালুকদার।।
নীলগঞ্জের ফজলুর রহমান, আবেদ, আলাল।
উহাদের পূর্বসূরি রশিদ-জালাল।।
বেশ কয়েকটা আসরে গান তখন গাইলাম।
ভাবের সাগর উকিল মুনশির দেখা পাইলাম।।
থানা জামালগঞ্জ লক্ষীপুর গ্রামেতে।
আসর হলো উকিল মুনশি সাহেবের সাথে।।
ময়মনসিংহ জেলাতে বাউল যারা ছিল।
তারা আমায় ভালোবেসে কাছে টেনে নিলো।।
বাউলগণ বাউল গান গায় পঞ্চরসে।
গ্রাম গঞ্জে প্রচুর গানের আসর বসে।।
উকিল মুনশির হাওরাঞ্চলে এই যে এত জনপ্রিয়তা — এর কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তৎকালীন হাওরাঞ্চলের বাউল-গায়কদের প্রায় সবাই বিভিন্ন আসরে উকিল মুনশির লেখা গান গেয়েছেন। মানুষজনও উকিল মুনশির গান শুনতে শুনতে অনেকটা মুখস্ত করে ফেলতেন। ফলে এই ‘সময়ে অত্রাঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত ছিল উকিলের গান’।
সিলেটের প্রয়াত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ রামকানাই দাশের ‘সিলেট, ভাটি অঞ্চলের লোকগান’ শিরোনামে একটি লেখা পড়েছিলাম। লেখাটি সনজীদা খাতুন সম্পাদিত ত্রৈমাসিক বাংলাদেশের হৃদয় হতে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে তিনি উকিল মুনশির গানকে ছড়িয়ে দিতে যাঁর ভূমিকা ছিল সর্বাগ্রে তাঁর সর্ম্পকে বলতে গিয়ে জানিয়েছিলেন :
“[…] গায়ক হিসেবে সে-সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অমিয় ঠাকুরের অশেষ খ্যাতি ছিল। কিন্তু তাঁর কবিত্বটা অর্থাৎ সঙ্গে সঙ্গে রচনা করে প্রশ্নোত্তরপর্ব মোকাবেলা করার কৌশলটা খানিক দুর্বল ছিল। তিনি উকিল মুনশির গানকে এতদঞ্চলে জনপ্রিয় করেন। শাল্লায় ১৯৬১ সালের তাঁর গাওয়া উকিল মুনশির একটি গানের উল্লেখ করার লোভ এখানে সংবরণ করতে পারছি না —
বন্ধু তুই আমারে এত দুঃখ দিলে রে
বন্ধু রে, তোর রাজত্ব জগৎজুড়ি,
আমার নাই রে ঘরবাড়ি
দিবানিশি থাকি পরার ঘরে।।
তোমার প্রেমের ভাণ্ড হতে
তোর উকিলকে কিছু দিতে
না জানি তোর কত-বা কম পড়ে রে বন্ধু।।
নেত্রকোনার আলী নওয়াজের সঙ্গে অমিয় ঠাকুরের ওই অনুষ্ঠানে আমি তবলা বাজিয়েছিলাম।”
অন্যদিকে গবেষক আলী আহাম্মদ খান আইয়োব ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত তাঁর নেত্রকোনা জেলার ইতিহাস বইয়ে উকিল মুনশি প্রসঙ্গে লিখেছিলেন :
“নেত্রকোনার বাউলদের মধ্যে ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তাধারার বাউল উকিল মুনশি শুধু মারেফাততত্ত্ব নিয়েই গবেষণা করে গান রচনা করেননি। তিনি মারেফাত সহ শরিয়ত সম্পর্কিত অনেক গান রচনা করে গেছেন। তাছাড়াও নেত্রকোনার জলবায়ু ছিল তাঁর অতি প্রিয়, তাই তাঁর অনেক গানের ভিতর দেখা যায় ভাটিয়ালি সুরে পানি-অধ্যুষিত নেত্রকোনার হাওর অঞ্চলের সংস্কৃতি বিরাজমান। প্রেমরসিক উকিল মুনশি বাউল সুরে অসংখ্য বিরহপূর্ণ গান হৃদয়ের পরশ দিয়ে সৃষ্টি করে নেত্রকোনার বাউলগানের ভুবনকে অলঙ্কৃত করেছেন।
বাংলার অসংখ্য গানের মাঝে উকিল মুনশির ওই বিরহ-বিধুর গানগুলো সুররসিক মাত্রই তন্ময় হয়ে শ্রবণ করে দু ফোঁটা অশ্রুত্যাগ করবে।”
প্রায় সবাই উকিল মুনশির গানের কণ্ঠ এবং কথার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। তিনি মারা গেছেন সেই ১৯৭৮ সালে, কিন্তু এখনও হাওরাঞ্চলের মানুষজন গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় উকিল মুনশির নাম উচ্চারণ করেন এবং এ প্রজন্মের বাউল-গায়কেরা তাঁর লেখা গান গেয়ে আসর মাতান। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে নিজের ব্যক্তিগত কিছু স্মৃতি। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে এক সহপাঠিনী আমার প্রতি বেশ দুর্বল ছিল — সেটা তার আচার-আচরণে প্রায়শই বুঝানোর চেষ্টা করত। এমনিতে সরাসরি কখনও সে আমাকে ভালোবাসা কিংবা ভালোলাগার কথা বলেনি। তবে আমি সেটা বেশ অনুভব করতে পারতাম। আমি যা যা পছন্দ করতাম সেটাই সে করার চেষ্টা করত। সে জানত — লোকগানের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। একদিন একটা খাকি খামের ভেতরে ছোট্ট একটা বই ঢুকিয়ে আমাকে উপহার দেয়। খাম খুলে দেখি — বহু পুরনো একটা গানের বই, নাম ‘উকিল মুন্সীর গান’। এই সংকলনটিতে ২৪টি গান রয়েছে। বইটি পেয়ে স্বভাবতই আমি খুশি হই। আমাকে খুশি হতে দেখে সহপাঠিনীর চোখেমুখে আনন্দ খেলা করছিল — সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম।
সেদিনের ওই দৃশ্য আমার এখনও স্পষ্ট মনে পড়ছে। অনেকদিন ওই সহপাঠিনীর সঙ্গে আমার দেখা নেই, জানি না সে এখন কোথায় কিংবা কেমন আছে? তবে তার দেওয়া সেই বইটি পরম যত্নে আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে সংরক্ষিত রয়েছে। ভালোবাসায়-মোড়ানো এই বইয়ের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে কিছু ব্যক্তিগত অনুভূতি, কিছু বিরহ আর কিছু না-বলা অব্যক্ত কথা। উকিল মুনশির সেই গানের মতোই যেন আমার অবস্থা — ‘আমায় ঠেকাইয়া দারুণ পিরিতে, করলে না স্মরণ রে, দারুণ বিধি হইল বাদী, হারাইলাম শ্যাম নিধি গো।’
… …
- রবীন্দ্রনাথের দুটি গান : ব্যক্তিগত পাঠ || সুমনকুমার দাশ - May 8, 2020
- লোককবি গিয়াস : কয়েকটি স্মৃতিটুকরো || সুমনকুমার দাশ - January 23, 2020
- কোকা পণ্ডিত ও তাঁর ‘বৃহৎ ইন্দ্রজাল’ || সুমনকুমার দাশ - January 8, 2020
COMMENTS